বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে একটি টিউশনির ঘটনা নিয়ে ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা গল্পের সম্পূর্ণ অংশ নিয়ে লিখিত কিশোর উপন্যাস তিনে দুয়ে দশ। ধারাবাহিকতায় অন্য দুই ত্রয়ী উপন্যাস: নিউটনের ছাত্রী এবং অলৌকিক শিশু।
উচিত না হলেও ভালো হবে। রূপ-রস, থ্রিলিং, এক্সাইটিং সব পাবে নতুন টিউশনিতে।
কোথায়?
ষোলো শহর।
ছাত্র না ছাত্রী?
ছাত্র।
তাহলে রূপ-রস আর থ্রিলিং কীভাবে আসবে?
এখানেই তো রহস্য। তুমি আগে শুরু কর, তারপর বুঝতে পারবে।
ছাত্রের বাবা কী করেন?
পুলিশ অফিসার।
কোন ক্লাসে?
কার ক্লাস জানতে চাইছ— ছাত্র না ছাত্রের বাবার?
কথায় কথায় ঢং ধরো না। ছাত্র কোন ক্লাসে পড়ে?
নবম শ্রেণি, সবে অষ্টম শ্রেণি ছেড়েছে।
বাবার র্যাংক?
ডিআইজি। জানো, ডিআইজি কী! তোমার থানার ওসি যদি শোনে তুমি ডিআইজির ছেলের গৃহশিক্ষক, তাহলে সে চিংড়ি মাছের মাথার মতো তার মাথাটাও তোমাকে দিয়ে দেবে। ডিআইজি নাম শুনলে গাছের পাতা পর্যন্ত থমকে যায়। বিভাগের বাপ, এসপিদের বস। ডিসিদের সেকেন্ড গড।
বিভাগীয় কমিশনারই তো বিভাগের মা-বাপ।
ব্রিটিশ আমলের কথা বাদ দাও। এখন জেলার মা-বাপ এসপি, বিভাগের মা-বাপ ডিআইজি ।
বিভাগীয় কমিশনার?
ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার। তাঁর বডিগার্ডও পুলিশ।
এতসব কীভাবে জানো?
আমার এক কাকা বিভাগীয় কমিশনার অফিসে চাকরি করেন। তিনি বলেছেন— বিভাগীয় কমিশনারের অফিস জাস্ট পোস্ট অফিস। ডিআইজি একটা নিঃশ্বাস ছাড়লে ঝড় ওঠে। বিভাগীয় কমিশনার তুফান দিলেও কিছু হয় না; গাছের পাতাটি পর্যন্ত নড়ে না। অমন অফিসারের ছেলের হাউজ টিউটর, মানেটা বোঝ?
না ভাই, আমি পারব না।
কেন পারবে না।
বড়ো অফিসারের ছেলেরা বড়ো অফিসারের মতো দেমাকি হয়। শিক্ষকের ওপরও আমলাগিরি ফলাতে চায়। আর ভালো লাগে না। গৃহপালিত আর গৃহশিক্ষক দুটোর মধ্যে সূক্ষ্ম একটা মিল আছে।
ভালো বেতন দেবে। ভালো নাশতা পাবে। পুলিশ পর্যন্ত স্যালুট দেবে। এখন যে টিউশনি কর সেখানে খাওয়ায় মাস্টার বিস্কুট। এখনে পাবে শ্যালক বিস্কুট। মাস্টারের চেয়ে শ্যালকের দাম অনেক বেশি। শ্যালক, কলিজায় ঘা দিলেও ভালো।
মাস্টার বিস্কুট মানে বেলা বিস্কুট। শ্যালক বিস্কুট আবার কী?
পুলিশ সবাইকে শ্যালক ডাকে। গৃহশিক্ষকও শ্যালক। পুলিশের বাসায় গৃহশিক্ষকদের চায়ের সঙ্গে যে বিস্কুট দেওয়া হয়, সেটাই শ্যালক বিস্কুট। একটা শ্যালক বিস্কুট দিয়ে তুমি একশটা মাস্টার বিস্কুট পাবে। মুখে ঢুকালে তানসেনের গানের মতো সুর তোলে। স্বাদে পায়ের তালু পর্যন্ত মিষ্টি হয়ে যায়। ডায়াবিটিস হওয়ার আগে খেয়ে নাও। সময় পাবে না পরে।
লোভ দিও না।
ডিআইজির বাসার মলা মাছের পেটি আমাদের রুই মাছের মাথার চেয়ে বড়ো। আমার বাবা, ডিআইজি সাহেবের বাসায় প্রতিমাসে যতগুলো মাছ পাঠায় তত মাছ কর্ণফুলি নদীতেও নেই।
এত দেয় কেন?
বড়শিতে কেন মাছ গাঁথা হয়?
বড়ো মাছ ধরার জন্য।
আমার বাবাও একই কারণে ডিআইজি সাহেবের বাসায় মাছ দেয়। অত কথা বলে লাভ নেই, তুমি রাজি হয়ে যাও।
ডিসি অফিসের এক কেরানির বাসায় টিউশনি করেছিলাম কিছুদিন। কেরানির বউয়ের দেমাক দেখে শরীরে আগুন ধরে যেত। আমার দিকে এমনভাবে তাকাত, যেন আমি একটা গৃহপালিত পশু। তোমার মা আমার সঙ্গে এমন আচরণ করেন কেন? জানতে চেয়েছিলাম ছাত্রীর কাছে। ছাত্রী বলেছিল, বাবা ডিসির সিএ না? ডিআইজির বউ কেমন হবে বোঝো।
এরা এমন না। অনেক ভালো।
আর একজনকে দাও। আমার একার পক্ষে তিনটা টিউশনি অসম্ভব।
তুমি ছাড়া এই ছেলেকে আর কেউ পড়াতে পারবে না। যেমন মেধাবী, তেমন বিপজ্জনক। শয়তানিতে হিটলার, বুদ্ধিতে স্মাগলার আর ভদ্রতায় ট্রাফালগার।
আমার যে সময় নেই।
সময় বের করে নাও।
আমি বললাম, কীভাবে?
সময় জমিদার বাড়ির ষোড়শী না যে বের করতে ঘাম ফেলতে হবে। মানুষ লেবু চিপে রস বের করতে পারে, শুকনো সরিষা থেকে গ্যালন গ্যালন তেল বের করতে পারে, আর তুমি সামান্য সময় বের করতে পারবে না। এটা কোনো কথা হলো?
সময়ের অপর নাম জীবন।
এই রকম লাখ লাখ জীবন যানজটে হারিয়ে যাচ্ছে। অত কথা বলে লাভ নেই। তুমি টিউশনিটা করবে। নইলে আমার ইজ্জত থাকবে না।
পুলিশে ছুঁলে নাকি ছত্রিশ ঘা। এক ঘা সওয়ার শরীর আমার নেই। ছত্রিশ ঘা! সাদি একটা টিউশনি খুঁজছে, তাকে দাও। সে পুলিশের ছেলে।
দিয়েছিলাম। একুশ দিন টিকেছিল সে। ছাত্র এমন নাকানিচুবানি খাইয়েছে, জীবনে মনে হয় সে আর টিউশনিই করবে না।
সত্যজিৎকে দাও।
পারবে না। ওই ছাত্রের সামনে গেলে সে ভয়ে প্রস্রাব করে দেবে।
তরুণকে দাও।
তরুণ সতেরো দিন ছিল। আঠারো দিনের মাথায় পালিয়ে চলে এসেছে।
আমি কয়দিন পারব?
তুমি শেষ ওষুধ। তুমি না পারলে স্বয়ং সরস্বতীও পারবে না। এত বড়ো পুলিশ অফিসারের বাড়ির মাস্টার-না, ঝাড়ুদার হতে পারাও ভাগ্যের। তার সুপারিশে তোমার চাকরিও হয়ে যেতে পারে। দুদিন পর তিনি আইজিপি হবেন। তখন তার এক অনুরোধে হাজার হাজার লোক এসআই হবে। পারলে আমিই করতাম। আমার তো সে যোগ্যতা নেই।
টিউশনি শুধু টাকার জন্য নয়। এটি টাকার চেয়ে বড়ো কিছু। বিসিএস প্রস্তুতির একটা মোক্ষম কোচিং, টাকা তো আছেই। কোথায় কার ভাগ্য লুকিয়ে আছে কে জানে। বিভিন্ন কিছু চিন্তা করে আমি টিউশনিটা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
রাজীব বলল, এখনই চলো।
আমি যে কিছু খাইনি?
ডিআইজির বাসায় এমন খাবার খাওয়াবে, রাতেও আর খেতে হবে না। পুলিশ মানুষ তারা, যেমন খায় তেমনি খাওয়ায়।
২
ইউনিভার্সিটি থেকে রাজিবের গাড়িতে করে সোজা ডিআইজি সাহেবের বাসায়। ফটকে কয়েকজন মানুষ পুলিশের পোশাক পরে পাহারা দিচ্ছে। রাজিবকে দেখে ফটক খুলে দিল।
ভিতরেও পুলিশের পোশাকপরা কয়েকজন লোক দেখলাম। উঠানের ডান পাশে বাগান। একজন মালী কাঁচি হাতে আগাছা পরিষ্কার করছে। দুজন মানুষ বারান্দায় বসে তিনজন পুলিশের সঙ্গে কানাকানি করছিল। আমি সকৌতুকে চারদিকে তাকিয়ে রাজীবকে বললাম, এটি কি ডিআইজি সাহেবের বাসা? অফিস-কাম বাসা। এটার আলাদা নাম আছে, ডিআইজি ভবন। শুধু ডিআইজির জন্য বিশেষভাবে নির্মিত। এমন বাড়িকে বাসা বলে না, অপমান বোধ করে।
কী বলব?
বাসভবন বলা হয়। সৌন্দর্যের চেয়ে দাপট বেশি কেন? এমন জায়গা শিশুর বাসযোগ্য হতে পারে, কিন্তু কিশোরদের নয়। অনেকটা কয়েদখানার মতো। আমি আর রাজীব অতিথি রুমে গিয়ে বসলাম। এখানেও ক্ষমতার দাপট। ক্রেস্ট আর দামি পাথরের ভাস্কর্যে রুম ভর্তি।
আমাদের যাওয়ার কিছুক্ষণ পর নাশতা এলো। নাশতা এলো বলতে নিয়ে এলো এক ভদ্রলোক। নাশতা তো আর হাঁটতে পারে-না! নাশতার বহর দেখে আমার চোখ কপালে। এত নাশতা কেন? রাজীব ফিসফিস করে বলল, চুপ। এটা ডিআইজির বাসা। কয়েক মিনিট পর এক ভদ্রমহিলা ঢুকলেন। রাজীব উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ভাবি সালাম। আমি রাজীবকে অনুসরণ করলাম। ভদ্রমহিলা সবুজ-গোলাপি রঙের পাটাতনের উপর বিচিত্র চিত্র আঁকা শাড়ি পরেছেন। গোলাকার মুখে হাসি আর ব্যক্তিত্ব, দুটোই ভারিক্কি সৌজন্যে সজাগ। আমি একবার তাকিয়ে একটা ইংরেজি ম্যাগাজিন টেনে নিয়ে চোখ বুলাতে শুরু করি। ভদ্রমহিলা আমাদের অদূরে একটা সোফায় বসতে বসতে বললেন, আপনারা কেমন আছেন? রাজীব বলল, ভালো। পথে কষ্ট হয়নি তো? না। আপনারা কেমন আছেন? ওমর কোথায়? ছেলেটার জন্য ভারি চিন্তায় আছি। ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে রাজীব আমাকে বলল, ইনি ডিআইজি ভাবি। মানে, তোমার ছাত্র ওমর সুলতানের মা। আমি আবার সালাম দিলাম, আসসালামু আলাইকুম। রাজীব আমাকে দেখিয়ে বলল, ভাবি এই আপনার ছেলের নতুন টিচার। অসাধারণ বুদ্ধি, প্রবল মেধা রাখে। টিচার তো ভাই কম দেননি। ছেলেটাকে পড়ানোর মতো একজনও পাওয়া গেল না। এত বড়ো শহরে একটাও কি ভালো টিচার নেই? লজ্জা পেয়ে গেল রাজীব। আমি তার চেয়েও বেশি।
আত্মরক্ষার গলায় রাজীব বলল, ভাবি, শেষবারের মতো দেখুন। এ যদি না পারে তাহলে, আই অ্যাম সরি। সরি, কেন ভাই? আর কেউ আপনার ছেলেকে পড়াতে পারবে না। যদি আমার এ বন্ধু না-পারে। মিসেস ডিআইজি বললেন, কেন যে ছেলেটাকে কোনো শিক্ষক পড়াতে পারছে না, বুঝতে পারছি না। সীমাবদ্ধতাটা কার? আমি বললাম, অবশ্যই শিক্ষকের। রোগ ধরতে না পারলে চিকিৎসা করবে কীভাবে? মিসেস ডিআইজি বললেন, পনেরো-বিশ দিনের বেশি কোনো টিচার টিকছে না। গত এক বছরে ত্রিশ জনের অধিক শিক্ষক বদলাতে হয়েছে। স্কুলের টিচার আনলে দুই দিনও পড়াতে পারে না। একজন স্কুল টিচারকে থাপ্পড় পর্যন্ত মেরেছে।
মহিলা টিচার আনেন? এনেছিলাম, আরও ভয়ংকর অবস্থা হয়েছে। একদিন পর চলে গেছে কেঁদে কেঁদে। সবাই আমার ছেলেটাকে বকাবকি করে, মারে। টিচার শাসন করবে ঠিক আছে। শাসনের নামে পুলিশ হয়ে যেতে হবে কেন? রাজীব হেসে বলল, ভাবি, পুলিশের বাসায় ঢুকলে সবাই পুলিশ হয়ে যায়। আমি বললাম, ওমর কী বলে? মিসেস ডিআইজি বললেন, তার অভিযোগ একটাই। শিক্ষক পড়াতে পারছে না, বোঝাতে পারছে না। শুধু মারে।
রাজীব আমাকে উদ্দেশ করে বলল, সমস্যা আছে। তবে তোমার কাছে সমাধান আশা করছি। মিসেস ডিআইজি বললেন, কী যে করি? ডিআইজি সাহেবকে প্রতিদিন জবাবদিহি করতে হয়। বেচারা রাতদিন ডিউটি করেন। রাতে বাসায় এসে ছেলের খবরাখবর নিয়ে রেগে যান। আমি চিন্তায় সারারাত ঘুমাতে পারি না। কিছু খেতে পারি না, অস্থির লাগে। শুধু ছেলেটার কথা মনে পড়ে। এত বড়ো অফিসারের ছেলে, শেষ পর্যন্ত গণ্ডমূর্খ হয়ে থাকবে বুঝি! আমি বললাম, চিন্তা করবেন না ম্যাম। আমি চেষ্টা করব। আশা করি ওমর সবার প্রত্যাশিত ছেলে হয়ে উঠবে। রাজীব বলল, এখন ভাবি আমি আসি? মাঝে মাঝে আসবেন ভাই।
To provide the best experiences, we use technologies like cookies to store and/or access device information. Consenting to these technologies will allow us to process data such as browsing behavior or unique IDs on this site. Not consenting or withdrawing consent, may adversely affect certain features and functions.
Functional
Always active
The technical storage or access is strictly necessary for the legitimate purpose of enabling the use of a specific service explicitly requested by the subscriber or user, or for the sole purpose of carrying out the transmission of a communication over an electronic communications network.
Preferences
The technical storage or access is necessary for the legitimate purpose of storing preferences that are not requested by the subscriber or user.
Statistics
The technical storage or access that is used exclusively for statistical purposes.The technical storage or access that is used exclusively for anonymous statistical purposes. Without a subpoena, voluntary compliance on the part of your Internet Service Provider, or additional records from a third party, information stored or retrieved for this purpose alone cannot usually be used to identify you.
Marketing
The technical storage or access is required to create user profiles to send advertising, or to track the user on a website or across several websites for similar marketing purposes.