ড. মোহাম্মদ আমীন
কলমটা ছিল ওমাস ফাউন্টেন পেন। পরে জেনেছি বিশ্বের দামি কলমগুলির অন্যতম। তখন মোবাইল ছিল না, ওই সময় পার্কার ছিল আমাদের কাছে বর্তমান সর্বশেষ মডেলের আই ফোনের চেয়েও লোভনীয়, কিন্তু সাধ্যাতীত। ওমাস ফাউন্টেন পেন কল্পানারও অতীত। প্যাকেট খুলে দেখছি আর দেখছি।

সামনে যে ওমর আমার কাণ্ড দেখে হাসছেÑ তাও বেমালুম ভুলে। এমন দামি লেখনী আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের এক হাউজ টিউটরকে অপ্রত্যাশিত আনন্দে হতভম্ব করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সোনালি রঙের কলমটার দাম কত তা আমার ধারণার অনেক বাইরে।
ওমর বলল, টিচার?
সম্ভিত পেয়ে বললাম, তুমি কি কলম আর ডায়েরি হতেও ভাগ চাইছ? ওই সামর্থ্য আমার নেই। বরং তুমি ডায়ারিটা নিয়ে নিতে পার। কলমটা থাক, অনেক সুন্দর। হাত দিতেই পুরো শরীরটা আমার কলম হয়ে গেছে।
ওমর হেসে বলল, না। বস্তুতে আমার আগ্রহ নেই। টাকা হলে সব পাওয়া যায়। ওই রকম কলম আমার অনেক আছে।
তবে?
আপনার বেতন কত হলো?
বারোশ টাকা।
আমার পাওনা এখন চারশ আশি টাকা। আমাকে দিতে হবে পাঁচশ টাকা। এতদিন আপনি বিশ টাকা কম দিয়েছেন, এখন বিশ টাকা বেশি দিতে হবে। মাইনাসে মাইনাসে প্লাস।
তার মানে পাঁচশ টাকা দিতে হবে।
একটা নোট দিলে ভালো।
একশ টাকার পাঁচটি হলে সমস্যা কী?
ছোটোখাটো নোট ছোটোখাটো অফিসারের মতো সস্তা। একশজন এসআই-এর চেয়ে একজন ডিআইজি-র দাম বেশি।
বিশ টাকা খুব বেশি না, আমি বললাম, “তুমি আমার শিক্ষক, তোমাকে বিশ টাকা বেশি দিতে না পারলে আমার জ্ঞান অর্জন হবে কীভাবে?”
ওমর হাসিটা আরও বিস্তৃত করে বলল, আমি যদি আপনার শিক্ষক হয়, তো আমাকে স্যার ডাকবেন। বলুন তো টিচারÑ মুরগি আগে না ডিম আগে?
মুরগি। প্রশ্নটি অনেকে করে। উত্তর সহজ বলে কেউ জানে না। সহজ কথা যায় না বলা সহজে, সহজ কথা বলতে আমায় কহ যে- – -।
কীভাবে সহজ?
পাড়ার সময় মানে পৃথিবীতে আসাসম ডিম সবসময় মুরগির পেছনে থাকে। মুরগি থাকে আগে। তাহলে কে আগে?
তাই তো টিচার, এতদিন একথা মাথায় এলো না কেন? আগামীকাল স্কুলে গিয়ে ফাটিয়ে দেব।
দিও।
কিন্তু টিচার, নিউটনের সামনে যে আপেলটা পড়েছিল, সেটি পাকা ছিল না কি কাঁচা ছিল?
নিউটন এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেননি।
আপেলটা পাকা ছিল।
কীভাবে বুঝলে?
পাকা ছিল বলে, নিউটন ওটা খেয়ে ফেলেছিলেন। ক্ষুধার্ত ছিলেন তো। ক্ষুধা কাঁচা কচুর শক্ত লতিকেও সুধা বানিয়ে দেয়।
তোমাকে কে বলল?
সেলিমা আপু। তাকে আপনি চিনবেন না। সে অনেক মেধাবী। আপনার মতো নয়শ জন টিচারকে নয় হাজার ঘাটের পানি খাওয়াতে পারে।
তার যুক্তি কী?
না খেলে, আপেলটা কোথায়? এর চেয়ে ঢের কম গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সংরক্ষিত আছে মিউজিয়ামে। এত দামি আপেলটি নয় কেন? আসলে খুব বোকা ছিলেন নিউটন; আমার চেয়েও। আপেলটা এখন থাকলে তাঁর উত্তরসূরিরা কয়েক হাজার কোটি ডলার নিলামে তুলতে পারত।
ওমরের কথার মাঝে দরজার কড়া নড়ে উঠল। ওমর বলল, কাম ইন। রুমে ঢুকল জমির, তার পেছনে আরও দুজন। প্রত্যেকের হাতে দুটো করে ঢাউস সাইজের প্যাকেট।
ওমর বলল, আপনার পুস্তক-তালিকার তৃতীয় চালান এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা-সহ। গতকাল আমেরিকা থেকে মামা পাঠিয়েছেন।
প্যাকেটের সাইজ দেখে বুঝে নিলাম জমিরের হাতে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা। আমি পাগলের মতো নিজেই প্যাকেটগুলো খুলতে শুরু করি। ঝকঝক

করছে। উলটাতে উলটাতে অবাক। পুরো পৃথিবী চব্বিশটা বইয়ে বন্দি। আহ্, আমি যদি ডিআইজির ছেলে হতাম!
ওমর, তুমি অনেক ভালো ছেলে।
আপনি স্যার আমাকে দিয়ে আপনার ইচ্ছাগুলো পূরণ করে নিচ্ছেন। আপনার ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে আমি আপনার ইচ্ছার কাছে নত হয়ে পড়ছি। এমন করছেন কেন, স্যার?
তোমাকে বুদ্ধিমান হতে হবে না?
আপনার চেয়ে যদি বেশি বুদ্ধিমান হয়ে যাই?
তোমাকে ছেড়ে তোমার মতো আরেক জনকে বুদ্ধিমান করতে চলে যাব।
রোমান এ হরফের এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাটি নিয়ে ওমরকে বললাম, এটি নিয়ে যাচ্ছি।
ওমর বলল, এগুলো তো আপনিই আমাকে দিয়েছেন, আপনি নেবেন না তো কে নেবে?
আমি কোথায় দিলাম?
আপনি না এলে এগুলো আমার কাছে অচেনা থেকে যেত। বাজে সিডি দেখে সময় কাটাতাম।
ডিআইজি সাহেবের বাসা থেকে বের বাসে উঠলাম। দেখি ফরহাদ। সে এমদাদের ছোটো ভাই। এমদাদ কিছুদিন পড়িয়েছে ওমরকে। সে আর আমি একই বিভাগের একই বর্ষের শিক্ষার্থী। থাকিও পাশাপাশি। ফরহাদ অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। বেশ চৌকশ ছেলে। সাবজেক্টটা ঠিক মনে পড়ছে না এখন। সম্ভবত অ্যাকাউন্টিং।
সালাম দিয়ে বলল, ভাইজান, আমাকে একটা লজিং দেবেন?
বললাম, এমদাদের কাছে অনেকগুলো লজিং আছে। আমাকেও বলেছে, কাউকে পেলে খবর দেওয়ার জন্য। তাকে গিয়ে বলো।
সে আমাকে লজিং দেবে না।
কেন?
আমাকে আগে শিবিরের সমর্থক ফরমে স্বাক্ষর করতে হবে। আমি শিবির করব না, সেও আমাকে লজিং দেবে না। এমদাদ ভাইয়া একটা জানোয়ার।
শিবির করবে না কেন? বাঁচার জন্য হারাম খাওয়াও জায়েজ।
শিবির করলে আমি মরে যাব। মানে, আমার মানবীয় আত্মাটা ওরা খেয়ে ফেলবে। ভাইয়া, যদি সম্ভব হয় আমাকে একটা লজিং দেবেন।
অক্সিজেনের মোড়ে এমদাদের সঙ্গে দেখা। সেও আমার মতো একটা টিউশনি হতে ফিরছিল।
বললাম, তোমার লজিং আছে?
আছে।
কয়টা?
ছয়টা।
আমার এক ছোটো ভাই আছে। তার জন্য একটা দাও।
ভোলা সওদাগরের বাড়িতে থাকতে পারে। তবে শিবিরের সমর্থক ফরম পূরণ করতে হবে।
ফরহাদকে একটা দাও।
বলেছি দেব কিন্তু সে শর্ত মানতে রাজি নয়।
কী শর্ত?
শিবিরের সমর্থক ফরমে স্বাক্ষর করতে হবে। শিবির করতে হবে।
কেন?
আমাদের দলের ছেলেকে প্রোভাইড করতে হবে। লজিংগুলো দলের।
ফরহাদ, তোমার ভাই।
বাপ হোক, তাতে কী? শিবির করলে দেব। নইলে দেব না। ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকগণ বলেছেনÑ শিবির করে, এমন হাউজ টিচার লাগবে। যারা শিবির করে তারা চরিত্রবান। ছাত্রীদের দিকে কুনজর দেয় না।
অন্য দল যারা করে?
চরিত্রহীন।
আমি বললাম, আসলেই তুমি জানোয়ার। চরিত্রহীনেরও কিছু চরিত্র থাকে। তোমার কোনো চরিত্র নেই।
পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে ভোলা সওদাগরের বড়ো ছেলে শাহেদকে কথাটা বললাম। তিনি ফরহাদকে তাদের বাসায় লজিং দিতে রাজি হয়ে গেলেন।
খবর পেয়ে ফরহাদ অনেক খুশি হলো।
দুদিন পর এমদাদ আমার রুমে এসে বলল, তুমি একটা প্রতারক।
আমি কী করলাম?
আমার দলের একটা ক্ষতি করে ফেললে।