তিনে দুয়ে দশ: ত্রয়োদশ পর্ব

ড. মোহাম্মদ আমীন
চার মাস হয়ে গেল, ডিআইজি সাহেবকে কোনোদিন সামনাসামনি দেখিনি। মাঝে মাঝে গলার আওয়াজ শুনেছি। ওমর বলতেন- “ডিআইজির গলা; গলা নয় ফাটা বাঁশের আর্তনাদ।
বেশ ভরাট গলা।
কয়েকটা অঙ্ক শেষ করার পর দরজার কড়া নড়ে উঠল। সঙ্গে পদধ্বনি এবং ভরাট গলার আওয়াজ, ওমর কেমন চলছে লেখাপড়া?
পুথিনিলয়, বাংলাবাজার।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। ওমর নির্বিকার, নিস্পৃহ।

ডিআইজি সাহেবের পেছনে পেছনে তানজিমা ম্যামও ঢুকলেন। মাথা নেড়ে সালামের জবাব নিয়ে ডিআইজি সাহেব বললেন, এতদিন নানা ব্যস্ততায় দেখা করতে পারিনি, ডোন্ট মাইন্ড ইয়াং ম্যান।
থ্যাংক ইউ।
আপনার ছাত্রের খবর কী?
বললাম, সে অসাধারণ। লক্ষ্মী ছেলে; খুব সূক্ষ্ম মেধার অধিকারী। আপনারা তার যথাযথ পরিচর্যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার দর্শন সামর্থ্য অবিশ্বাস্য।
আমি সচেতন মনে কথাটি বলেছি। লজ্জা পেলেও গর্বের খুশিতে কণ্ঠকে মোলায়েম করে ডিআইজি সাহেব বললেন, সরি।
তানজিমা ম্যাম বললেন, আমি বলেছিলাম না, আমার ছেলে আমাদের মতো ব্রিলিয়ান্ট হবে?
ডিআইজি সাহেব বললেন, বেয়াদবি করে না তো আবার?
কী যে বলেন, স্যার? আমার জীবনে এমন ভদ্র কিন্তু চৌকশ ছাত্র আর পাইনি। যেমন ভদ্র তেমন মেধাবী। এ বয়সে এমন সৌজন্য বিরল।
তানজিমা ম্যাম বললেন, থ্যাংক ইউ টিচার।
স্বাগত।
মনটা ভরে গেল। বড়ো দুশ্চিন্তায় ছিলাম ছেলেটাকে নিয়ে। অনেকে বলেছে, আমার ছেলে নাকি পাগল হয়ে গেছে। বড়ো হলে দস্যু হবে।
আমি বললাম, অসাধারণদের সাধারণ লোকেরা এমনই ভাবে। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের সবচেয়ে ভালো শিক্ষক তৃষিতরঞ্জনকে ঝাড়ুদার মোহন পাণ্ডে পাগল ডাকত। তার কথা শুনে আমরা হাসতাম। ওমর হীরা, আমাদের দায়িত্ব ঘষে দ্যুতি বের করা। কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। ধৈর্য নিয়ে একটু শ্রম দিলে হয়ে যাবে।
দয়িত্বটা আপনি নিন, ডিআইজি সাহেবের কণ্ঠে অনুরোধ।
আমি তাঁর আপাদমস্তক দেখে নিলাম। বেশ গম্ভীর চেহারা। চোখের চশমায় ভারি মুখটা পুলিশের পোশাকের মতো ঝিলিক মারছে। হাতের ঘড়িতে আরও বেশি জৌলুস। অসম্ভব সুন্দর করে চুল আঁচড়িয়েছেন। ওমরের ভাষায়-ডিআইজি স্টাইল। মোচটা যেন সমীহ টানার দড়ি- পুলিশের পদকের মতো খুব যত্ন করে বসিয়ে দিয়েছে সরকার।
ডিআইজি সাহেব ওমরের একটি খাতা হাতে তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, মাস্টার সাহেব, আপনার বেতন চারশ টাকা বাড়িয়ে দিলাম। প্রতিমাসে আপনার বেতন একশ টাকা করে বাড়িয়ে দেব।
কেন স্যার?
আমরা পুলিশের লোক। গুণীর কদর করতে জানি।
এ আপনার ঔদার্য।
ওদার্য দেখানোর অভ্যাস পুলিশের চরিত্রে নেই। এই পর্যন্ত কোনো শিক্ষক আমার ছেলের কাছে বিশ দিনের বেশি টেকেনি। পাগল বলেছে। আপনার চার মাস হয়ে গেছে। আপনার প্রশংসায় ওমর পঞ্চমুখ। ছেলে আগে ইলেকট্রনিক্স, ছবি-গানের সিডি আর চকলেট ছাড়া কিছু বুঝত না। এখন বইয়ের তালিকা দেয় আনার জন্য। নিজেই নিজের লেখা গানে সুর তোলে। আগামীকাল লন্ডন থেকে আরও বই আসবে। আপনার কোনো বইয়ের প্রয়োজন হলে তাও লিখে দেবেন।
তানজিমা ম্যাম বললেন, প্রত্যেকে আমার ছেলেটাকে বকা দিয়েছে, মেরেছে, অশ্রাব্য কথা বলেছে। বলেছে- পুলিশের এই ছেলে ডাকাত হবে।
ডিআইজি সাহেব বললেন, আপনার আগের টিচার এগারো দিনের মাথায় ছেলেটার মুখে চড় মেরে কালশিটে এনে দিয়েছিল। শিক্ষক বলে কিছু করিনি। গত চার মাসে ছেলে কেবল আপনারই প্রশংসা করেছে। আপনি তো কোনোদিন গায়ে হাত তুলেননি!
ওমর বলল, ডিআইজি সাহেব, এই টিচার আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। আমি তাকে তোমার চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করি। আমি তো তোমার জানোয়ার।

ড. মোহাম্মদ আমীন
দেখেন টিচার, আমার ছেলে আসলেই একটা জানোয়ার। আমাকে ডাকে ডিআইজি সাহেব। এসপি থাকার সময় ডাকত এসপি সাহেব।
আমি বললাম, ওমর এক্সেপশনাল। হাজার হোক আপনার আর তানজিমা ম্যামের সন্তান। তার কাছ থেকে সাধারণ কিছু আশা করবেন কেন? সেও আপনাদের মতো অসাধারণ। শুধু বুঝে নিতে হবে। ডিআইজি সম্বোধনের পেছনে তার একটা যুক্তি আছে।
কী?
এখন আমি বলব না। সময় এলে বলব।
সময় কখন আসবে?
যেদিন আপনি ভুলে যাবেন ওমর আপনাকে ডিআইজি সাহেব ডাকত, ওমরও ভুলে যাবে, আপনি তাকে জানোয়ার ডাকতেন।
ওমর এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। জানোয়ার শব্দ শুনে বলল, ডিআইজি সাহেব, আমি যদি তোমাকে বাবা ডাকি তুমিও তো জানোয়ার হয়ে যাবে। তাই ডাকি না। আমি তোমাকে জানোয়ার দেখতে চাই না। ডিআইজি সাহেব, টিচারের সঙ্গে কথা শেষ করো। আমি ড্রয়িং রুমে গেলাম। তোমরা বের হলে আসব।
সেকেন্ডের মধ্যে ডিআইজি সাহেবের মুখটা লজ্জায় মলিন হয়ে গেল। তবে অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, ওমরের মুখে রাগের কোনো চিহ্ন নেই। খুব শান্তভাবে কীভাবে একজন কিশোর তার জাঁদরেল পিতাকে তার শিক্ষকের সামনে এমন কথা বলতে পারল-বিস্ময়কর।
ওমর বের হয়ে যাওয়ার পর তানজিমা ম্যাম বললেন, টিচার ওমরকে আর একটু বেশি সময় দিলে ভালো হয়।
আমি কি সময় কম দিচ্ছি মনে হচ্ছে?
ঠিক তা না।
তবে?
ওমর প্রায় সময় বলে- স্যার খুব তাড়াতাড়ি চলে যান।
আমি ইচ্ছে করে কম সময় থাকি।
ডিআইজি সাহেব বললেন, কেন?
ওমরের আগ্রহকে আগামী দিনের জন্য জাগিয়ে রাখতে না পারলে বিরক্তি এসে যেতে পারে। সে এখন পাঁচ ঘণ্টার কাজ দেড় ঘণ্টায় শেষ করতে পারে। বাকি আড়াই ঘণ্টা অন্য বই পড়বে। আমি না থাকলে সে আমার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারছে, কিন্তু উপলব্ধির রেশ কাটানোর আগেই আমাকে পেয়ে যাচ্ছে। এটাই প্রত্যাশা, প্রাপ্তির আনন্দ; ইচ্ছামাত্র পাওয়া যায় না, তবে দুর্লভ নয়। অনুগ্রহপূর্বক পড়ানোর বিষয়ে আমাকে ভালোমন্দ কোনো কথা বলবেন না। বিষয়টি আমার ভালো লাগে না। আমাকে আমার মতো পড়াতে দিন। কথাগুলি নির্দেশের মতো হয়ে গেল। ছাত্রের জন্য আমি কাউকে কষ্ট দিতে দ্বিধা করি না।
সরি, টিচার, ডিআইজি দম্পতি সমস্বরে বললেন।
বুঝতে পারার জন্য ধন্যবাদ।
ডিআইজি সাহেব আমাকে একটা কলম আর একটা ডায়েরি দিয়ে বললেন, নিন।
কী?
আপনার উপহার।
আমি জিনিসদুটো নিয়ে বললাম, ধন্যবাদ। আমি খুশি হয়েছি। উপহার আমাকে প্রীত করে।
আমি গেলাম। আবার দেখা হবে; বলেই ডিআইজি সাহেব বের হয়ে গেলেন। তার সঙ্গে বের হয়ে গেলেন তানজিমা ম্যাম।
ডিআইজি সাহেব বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওমর রুমে ঢুকে বলল, লোকটা আমার পনেরো মিনিট সময় নষ্ট করে দিল। অসহ্য।
তাতে কী?
কিছু একটা আছে।
কী?
আপনাকে পনেরো মিনিট বেশি থাকতে হবে। ক্ষতি পুষিয়ে দিয়ে যাবেন। তাদের অপরাধ আপনাকে সামাল দিতে হবে। উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চড়িয়ে দিলাম।
সময় নষ্ট হয় না। আমরা নষ্ট হয়ে যাই। কত মানুষ প্রতিদিন বৃদ্ধ হচ্ছে, মরে যাচ্ছে; সময়কে কখনো বৃদ্ধ হতে দেখেছ? নষ্ট হয়ে পচে যেতে দেখেছ?
না।
বাবার কথায় কষ্ট পেয়েছ?
ওমর হেসে বলল, টিচার, একটা গান করি; আমার লেখা।
———————–
শুবাচ গ্রুপ এর লিংক: www.draminbd.com
——————————-
ওয়েব লিংক
Language
error: Content is protected !!