তিনে দুয়ে দশ: দশম পর্ব

ড. মোহাম্মদ আমীন

আপনি কয়েকদিনে অনেক স্মার্ট হয়ে উঠেছেন।

ড. মোহাম্মদ আমীন

স্মার্ট কী? আমি জানতে চাইলাম ওমরের কাছে।
একটু চেষ্টা করলে সবাই যা হতে পারে, সেটিই স্মার্ট। এর চেয়ে সহজ কাজ আর কিছু নেই। কেউ যদি আপনাকে স্মার্ট বলে- তো আপনি হয়ে গেলেন।  প্রথম দিন আপনাকে বিশ্বকর্মার ছেলে মনে হয়েছিল। বিশ্বকর্মার ছেলের নাম কী জানেন?
কী?
চিকা। কী বিশ্রী; চিকার মতো শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল।
গতকালের হোমটাস্কগুলো করেছ?
আপনার সামনে আছে।
দেখলাম ওমর খুব সুন্দরভাবে হোমটাস্কগুলো করেছে। অসাধারণ কয়েকটি বাক্য দিয়ে সুন্দর একটা ভাবকে সম্প্রসারিত করেছে। “বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।” সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ গ্রন্থের একটি বাক্য। তবে সে যা লিখেছে তা পরীক্ষার খাতায় লিখলে পরীক্ষক শূন্য ছাড়া কিছুই দেবে না। আমি হলে দশে দশ দিতাম। ভালো লাগল। তার দিকে তাকালাম। ওমরের চোখ খাতায়, মন দিয়ে অঙ্ক করছে। হাতের ফাঁক গলে কলমের মাথা নব্বই ডিগ্রি কোণ হয়ে যেন পিথাগোরাসের জ্যামিতি। 
ওমর?
বলুন।
মাথাটা এদিকে আনো।
সে মাথাটা এগিয়ে দিল। আমি পরম আদরে মাথার চুলগুলো ভীষণভাবে এলোমেলো করে দিলাম।
চুলের ভাঁজটা নষ্ট করে দিলেন?
দিলাম।
কাজের বুয়া আর মাম মিলে কত যত্ন করে সাজিয়ে দিয়েছিল। মাম দেখলে কী বলবে?
কিছু বলবেন না।
সবাই আমার চুল সাজিয়ে দেয়, কেউ নষ্ট করে দেয় না। আপনার কত বড়ো সাহস, নষ্ট করে দিলেন।

নষ্ট করতে সাহস লাগে না, যে কেউ নষ্ট করতে পারে। বোকারাই বেশি নষ্ট করে। হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে ভেঙে যায় কাদের? বোকাদের। রাস্তায় হাতপা ভাঙে কাদের?  বোকাদেরকষ্ট পেয়েছ?
ওমর আয়নার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, প্রতিদিন আমার চুলের ভাঁজ এভাবে এলোমেলো করে দেবেন টিচার। দেবেন তো?
ভালো লাগছে?
মনে হচ্ছে  নতুন সজ্জা দিয়েছেন। এতদিন আমার চুল ছিল ডিআইজি সাহেবের বাগানের মতো। 

এখন?

আকাশের মেঘের মতো এলোমেলো খাপছাড়া, স্বাধীনতার ডাক; টিচার বাদ দেন লেখাপড়া, আসুন বইপত্র বন্ধ করে গল্প করি। প্রতিদিন আমার চুলগুলো এভাবে এলোমেলো করে দেবেন তো?

আমার চোখ কেন জানি আর্দ্র হয়ে গেল। বললাম, দেব। তবে শর্ত আছে?
যারা আমার চুল সাজিয়ে দেয় তারা কোনো শর্ত দেয় না। বরং আমিই শর্ত দিই। তারা শুধু সাজিয়ে দেয়। আপনি কেন শর্ত দেবেন?
শর্ত নেই বলে স্বত্বও নেই। শর্ত কর্তব্যের প্রাণ। বিনা স্বার্থে এবং বিনা স্বত্বে যা করা হয় তাতে আন্তরিকতা থাকে না। ক্ষুধা না থাকলে যেমন স্বাদ আসে না, তেমনি স্বার্থ-স্বত্ব না থাকলে থাকে না আগ্রহ। আগ্রহ না থাকলে কোনো কাজই সুচারু হয় না।

ঠিক বলেছেন টিচার। মা যদি আমাকে বিনাশর্তে ভালোবাসতেন তাহলে পথের ছেলেগুলোকেও তো আমার মতো ভালোবাসতেন।আপনার শর্ত কী বলুন?
হোমটাস্ক নিয়মিত করতে হবে।
করব। তবে আমারও শর্ত আছে।
কী?
প্রতিদিন আমাকে ওই দিনের মতো ডাবল-করণ গল্প বলতে হবে। আমি টিচার হব না। আইডিয়া বিক্রেতা হব। তাই কথা বলব, ইচ্ছেমতো বলব। আপনি যদি বাচাল ডাকেন, ডাকুন।
কথা জ্ঞানের বিজ্ঞাপন।
গালি?
গাল-এর স্ত্রী হচ্ছে গালি।
আজ অনেকক্ষণ পড়লাম স্যার।
আটে দুইয়ে কত হয়?
ষোলো।
খুব ভালো।
ভালো না স্যার।
কী হয়েছে?
আপনি এলেন বিশ দিন হয়ে গেল, এখনও আসল কথাটা বলা হয়নি।
আসল কথা কী?
আছে।
বলো।
আপনি নতুন, নতুনেরা সবুজ থাকে। পাকলে ফলের দিকেই সবার নজর চলে যায়। গাছের দিকে খেয়াল থাকে না। তাই গাছকে বেশ সমস্যায় থাকতে হয়। বিড়ালটা এখনও যে মারা হলো না।
তুমি এ বয়সে অনেক গভীর কথা বলতে পার।
পাম্পু দিয়েন না টিচার। আমি ডিআইজি নই, ওমর। আগে আমার কথা শোনেন।
বলো।
যার বেশি আছে তারই বেশি লাগে। যেমন গাছ তেমন বাতাস।
ঠিক। মানুষ তেলে মাথায় তেল দেয়। টাকার ঘরে টাকা যায়, গরিবের ঘরে যায় গরিব। সমুদ্রের দিকে ছুটে যায় সব নদী। অথচ হাজার হাজার খালবিল শুকিয়ে মরে একটু জলের জন্য। কোনো নদী তাদের ফিরেও তাকায় না।
মানুষ তেলে মাথায় তেল দেয়, কেন জানেন টিচার?
কেন?
শুকনো মাথায় তেল দিলে সর্দি এসে যাবে। তেল ধোয়ার জন্য আবার সাবান কিনতে হবে। সর্দির জন্য কিনতে হবে ওষুধ।
এবার একটা ভাবসম্প্রসারণ কলো।
ওমর বলল, আগের কথা আগে বলে নেওয়া ভালো।
বলে ফেলো।
আমার একটা প্রস্তাব আছে।
কী প্রস্তাব?
আমার প্রস্তাব বিদঘুটে নয়, মনঘুটে। আপনি কষ্ট পাবেন। কষ্ট পেলেও কিছু যায় আসে না। শিকার কষ্ট পাবে বলে কি শিকারি বন্দুক বন্ধ করে রাখে? রাখলে আমারও লাভ, আপনারও লাভ। নইলে দুজনেরই ক্ষতি। আমি চাই না আপনার ক্ষতি হোক। আমার ক্ষতি হলে ডিআইজির ক্ষতি, আমার কিছু হবে না। আপনার ক্ষতি আপনার নিজের ক্ষতি। ক্ষতি সহ্য করার ক্ষমতা থাকলে আপনি টিউশনি করতে আসতেন না।
বাজে কথা বাদ দাও। গতকালের হোমটাস্কগুলো দেখে নিই। তুমি ততক্ষণে ভাবসম্প্রসারণ করো।
কোনটা করব?
অর্থই অনর্থের মূল।
অর্থ মানে কী ‘অর্থ’?
টাকা।
তাহলে অনর্থ মানে অ-টাকা, যা টাকা নয়। অর্থই অনর্থের মূল, মানে টাকাই অ-টাকার মূল। মূল মানে শেকড়। অর্থ কী হলো?
টাকাই অ-টাকার শেকড়।
তাহলে টিচার, ডিআইজি কেন টাকার জন্য চাকরি করছে, আপনি কেন ঘামে ভিজে টিউশনি করছেন? এমন মিথ্যা একটা ভাবের সম্প্রসারণ আমি করব না।
এটা বাদ দাও। তুমি পারবে। ‘মানুষ মরণশীল’ এটা করো।
মানুষ মরে কেন?
জন্মায় বলে মরে।
আপনি কিছুই জানেন না।
তুমি বলো?
যারা দুনিয়াতে আসার জন্য লাইনে থাকে, তারা জায়গা খালি করার জন্য গভীর রাতে এসে মানুষ খুন করে যায়। এ যেমন

পুথিনিলয়, বাংলাবাজার।

ডিআইজি সাহেব, তিনি দুনিয়াতে আসার আগে একজন ডিআইজিকে খুন করে ফেলেছিলেন। ওই ডিআইজি জীবিত থাকলে ইনি ডিআইজি হতে পারতেন না। দুনিয়াতে আসার আগে যে যাকে খুন করতে পারে সে তার পদটা পেয়ে যায়। এজন্য কেউ অফিসার আবার কেউ হয় জনোয়ার।
দার্শনিক কথাবার্তা রাখ।
সাদা সাদা চিকন দাঁতগুলোয় মজার এক হাসি মিশিয়ে ওমর বলল, আপনার বেতন কত স্যার, আটশ টাকা। আসল কথা তাহলে বলেই ফেলি। মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনার বেতনের চল্লিশ পার্সেন্ট আমাকে দিতে হবে।
কী বললে? আমার কানের লতি মুহূর্তে রাগের গরমে কাঁপতে শুরু করে।
আপনার বেতন আটশ টাকা।
হ্যাঁ।
চল্লিশ পার্সেন্টে হয় তিনশ বিশ টাকা।
তুমি কী বলতে চাইছ?
আমাকে টিচার তিনশ টাকা দিলেই হবে, বিশ টাকা আপনার বকশিশ। আপনি জানেন শিক থেকে বকশিশ।
মনে হচ্ছিল আমি ভুল শুনছি। সন্দেহ তাড়ানোর জন্য বললাম, তুমি কী বলতে চাইছ?
আপনি টিচার কানে কম শোনেন?
আবার বলো।
আপনার বেতনের চল্লিশ পার্সেন্ট আমাকে দিতে হবে। চল্লিশ পার্সেন্ট মানে তিনশ বিশ টাকা, আমাকে তিনশ টাকা দিলে হবে। বুঝলেন? নাকি কানের কাছে গিয়ে চিৎকার দিয়ে বলতে হবে? দেওয়ার কথা কেউ শুনতে চায় না। নেওয়ার কথা বললে এতক্ষণে শোল মাছের মতো লাফিয়ে উঠতেন। অসহ্য!
প্রথমে মাথাটা ঝাঁ করে ওঠে। ইচ্ছে করছিল ঘুরিয়ে একটা চড় দিই। চড় ওমরের গালে লাগার আগে মত পরিবর্তন করে হাতটা তার মাথায় রাখি। মাথায় রেখে আবার এলোমেলো করে দিই তার চুল।
ওমর একটু চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল, মারলেন না যে? সবাই তো একই কাজ করেছে। টাকা চাইলে সবার মাথা গরম হয়ে যায়। নিতে পারলে খুশিতে সাব্বাস।
আমি কষ্টের হাসিটাকে আনন্দে ভরিয়ে দিলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আমার স্বাভাবিক কণ্ঠে অসহায়ত্বের কিছু আদর ঢেলে বললাম, কম নেবে কেন?
এমনি। রাজি?
রাজি। আমি পুরো তিনশ বিশ টাকাই দেব।
এমন করলে ভাঙতি দিতে হবে।
কেন?
একশ টাকার ছোটো কোনো নোট আমি পকেটে রাখি না। ওইসব ফকিন্নি-মকিন্নির কাজ। হাতির মুখে ছাগলের দাঁত মানায় না। ডিআইজির ছেলের পকেটে একশ টাকার নিচে কোনো নোট থাকা লজ্জার বিষয়।
আমি বললাম, ভাঙতি থাকলে পথে গরিব-দুখীদের সাহায্য করা যায়।
গরিব-দুখীদের সাহায্য করার জন্য ঈশ্বর গরিবদের সৃষ্টি করেছেন। আমার গাড়ির কাছে ভিক্ষুক কেন, অনুমতি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও যেতে পারে না। পিটিয়ে হাত-পা গুঁড়া করে দেব। ধনীদের সবকিছু ফরমাল। এক টাকা দান করতে গিয়ে দশ টাকা জাঁকজমকের পেছনে খরচ করে। আমার শিল্পপতি নানু এক লাখ টাকা গরিবদের দিতে গিয়ে দুই লাখ টাকা প্রচারের জন্য খরচ করেন।
ওমর, হাতের সবগুলো আঙুল কি সমান?
না।
কিন্তু কাজ করতে যাওয়ার সময় সবগুলো আঙুল সমান হয়ে যায়। নইলে তারা কোনো কাজ করতে পারবে না। চেষ্টা করে দেখ।
ওমর হাতের আঙুলগুলো সমান না করে একটা কলম তোলার চেষ্টা করল। পারল না।
টিচার, মানুষের দুই হাতে আঙুল কয়টি?
তুমি বলো।
তিনে দুয়ে পাঁচ হলে  দুই হতে কয়টা আঙুল হয় বুঝতে পারছি না।
আমি বললাম, এগারোটি।
কীভাবে?
প্রথমে ডান হাত থেকে উলটো শুরু করি। কনিষ্ঠা ১০, অনামিকা ৯, মধ্যমা ৮, তর্জনী ৭, বৃদ্ধা ৬; ঠিক আছে?
হ্যাাঁ।
এবার ছয়-এর সঙ্গে বাম হাতের পাঁচটি যোগ করো। কত হয়?
হয় এগারো।

——————————————–

শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com

All Link

All Links/1

All Links/2 শুবাচির পশ্ন থেকে উত্তর


———————————————–

——————————————-

তিনে দুয়ে দশ: দশম পর্ব

Language
error: Content is protected !!