এমদাদ সাহেবকে বলছিলাম, ডিআইজি সাহেবও আমাকে জানোয়ারের বাচ্চা ডাকে। আজ থেকে আপনাকে ওমর নামের জানোয়ারের সঙ্গে আমাদের বাসভবনের চিড়িয়াখানায় কুকুর-বিড়াল আর শিয়াল-ঘোড়া এবং গোরু-ছাগল নামের জানোয়ারদের পড়াতে হবে। চলুন-চিড়িয়াখানায়।
না। ডিআইজ সাহেব জানতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছি, এই টিচার জানোয়ারের বাচ্চা পড়ান না, মানুষের বাচ্চা পড়ান। আমি তো জানোয়ারের বাচ্চা।
তারপর?
ডিআইজি সাহেবের মুখটা যদি দেখতেন। ফর্সা মুখটা পচা ফেনার রঙের মতো বিদঘুটে হয়ে গিয়েছিল। সুড়সুড় করে বিড়ালের মতো চলে গেল। তার কোনো বেইল আছে না কি!
অতীত তোমাকে পীড়া দেয় না?
জানোয়ারের আবার অতীত কী।
তুমি জানোয়ার নও।
জানোয়ারের বাচ্চা।
না।
কী?
আমার ছাত্র।
ছাত্র আর জানোয়ারে তফাত?
অনেক মানুষ জানোয়ারের মতো কেবল বাঁচার জন্য খায়। ভোগের জন্য বাঁচে। ছাত্র কেবল শেখার জন্য খায়, চিন্তা করার জন্য বাঁচে। Thinking is his staple food.
ছাত্রজীবন চলে গেলে?
ছাত্রের কোনো বয়স নেই, সময় নেই, প্রতিষ্ঠান নেই। জানোয়ার না হলে মানুষ আমৃত্যু ছাত্র থেকে যায়। সুনির্মল বসুর সবার আমি ছাত্র পড়নি?
“বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র, নানান ভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র।
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়, পাঠ্য যেসব পাতায় পাতায় শিখছি সে সব কৌতূহলে, নেই দ্বিধা লেশমাত্র।”
আদর্শ ছাত্রের বৈশিষ্ট্য কী? ওমর প্রশ্ন করল।
তুমি যা করতে পারবে, তাকে যা করতে পারবে না তা দিয়ে ঢেকে দিও না। বরং তুমি যা করতে পার তা দিয়ে যা করতে পার না তাকে ঢেকে দাও। এটাই আদর্শ ছাত্রের বৈশিষ্ট্য।
কলিং বেলের শব্দ হলো টুং। উঠে গেল ওমর।তাকে পড়ার সময় এভাবে ডাকে।ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে ফিরে এল সে বলল, আপনার সঙ্গে ডিআইজি সাহেব কথা বলবেন।
ডিআইজি বল কেন, বাবা ডাকতে পার না?
বাবার চেয়ে ডিআইজি অনেক বড়ো।
কী!
বাবা হওয়া খুব সহজ।
যেমন?
বিয়ে করলেই হলো। ভিক্ষুকও বাবা হতে পারে, কনস্টেবলও বাবা হতে পারে। আমাদের মালী মোহন দাসের নয় ছেলেমেয়ে। সে কি ডিআইজির চেয়ে প্রভাবশালী? ডিআইজি হওয়া কঠিন। তাই বাবা না বলে ডিআইজি ডাকি।
বাবা তার সন্তানের গর্ব।
বাবা কারও গর্ব নয়, বাবার পদবিটাই গর্ব। টিচার, আমি হাসনাত সাহেবকে বড়ো করে তোলার জন্য ডিআইজি ডাকি। ইটস গ্রেট রেসপেক্ট টু হিম। তিনিপুথিনিলয়, বাংলাবাজার।
কিন্তু আমাকে জানোয়ার বলে গালি দেন। আমি তাকে কখনো জানোয়ার ডাকিনি। আচ্চা টিচার, বলুন তো ছেলে জানোয়ার হলে বাবা কী হবে?
তুমি বলো।
জানোয়ার।তিনি যখন নিজে নিজে স্বীকার করে নিয়েছেন, কষ্ট করে আমি ডাকতে যাব কেন। কী বলেন টিচার? আপনি আমাকে জানোয়ার ডাকলে আপনি জানোয়ার না-ও হতে পারেন। জানোয়ারের টিচারের জানোয়ার না হলেও চলে। কিন্তু জানোয়ারের জন্মদাতার জানোয়ার হতে হয়। আমাদের কুকুর মহিকে যে পড়ায় সে কিন্তু মানুষ।
তোমাদের মহি লেখাপড়া করে?
করবে না? বাবা আমাকে ডাকে জানোয়ার, কুকুরকে ডাকে মহি। আমি পড়ি সে পড়বে না!
কী পড়ে সে?
ডিআইজি সাহেব বলেন, কুকুর নাকি মানুষের চেয়ে কৃতজ্ঞ। তাই মানুষের চেয়ে উত্তম। আমি মানুষ, তাই কুকুরের চেয়ে অধম। তুমি মানুষ বলিয়া আমি কুকুর হইব না কেন?
তুমি কী মনে কর?
আমিও তাই মনে করি। আপনি কী মনে করেন টিচার?
কুকুর মানুষের চেয়ে কৃতজ্ঞ- এতে কোনো ভুল নেই। মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টির সেরা, অন্যথায় সর্বনিকৃষ্ট। A dog is the only thing on earth that loves you more than you love yourself.”
টিচার, কুকুরের পক্ষে কোনো কবিতা আছে?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘—আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখব বলে—।’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কুকুর হতেন কীভাবে?
টিচার কখনো কোনো কুকুরের সঙ্গে মানুষের বিয়ে হয়েছে?
অঙ্কগুলো কর।
করে ফেলেছি।
13 Reasons Why সিরিজের বইগুলো আনা হয়েছে?
কয়েকটা পড়ে ফিনিশ করে দিয়েছি।
কেমন লেগেছে?
অসাধারণ। আরও কয়েকটা বইয়ের নাম লিখে দিন।
ওমরের আলমারির দিকে তাকালাম। ক্রেস্ট আর ছবির অনেক জায়গা বই দখল করে নিয়েছে। আরও অনেকগুলো বই নিচে। কয়েকজন মিস্ত্রি সেগুন কাঠের দুটি শেলফ তৈরি করছে বাইরে। ওমর বই রাখবে।
এতগুলো বই! আমি অবাক হয়ে বললাম।
আপনি যাঁদের নাম লিখে দিয়েছেন তাঁদের লেখা সব বই আনিয়ে নিয়েছি।যতগুলি পেয়েছি। ইংল্যান্ড থেকে আসবে বাকিগুলো।
এত বই পড়বে কখন?
যা পারি পড়ব। অনেক মানুষের কোটি কোটি টাকা। তারা কি সব ভোগ করতে পারে? তবু আয় করে। আমিও তা করব।
তোমার অনেক ক্রেস্ট ছিল।
টিচার, ক্রেস্ট গর্বের, কিন্তু বই গর্ভের। আপনি আসার পর জেনেছি। বইয়ের সৃজন ক্ষমতা আছে, ক্রেস্ট নপুংসক।সে গর্ব দিতে পারে, জন্ম দিতে পারে না। বাজা গাভিকে গোয়ালে কেউ রাখে না, কসাই খানায় পাঠিয়ে দেয়।