তিনে দুয়ে দশ: নবম পর্ব

ড. মোহাম্মদ আমীন

তিনে দুয়ে দশ: নবম পর্ব

আপনি আমার মামকে কেমন চোখে দেখেন?
মায়ের মতো, আমি বললাম, “সন্তানের চোখে।”
মানে?
তুমি যে চোখে তোমার মাকে দেখো।
টিচার, আমার চোখ কি আপনার চোখ?
না।

আপনার অক্ষিকোটরে যে দুটি চোখ শোভা পাচ্ছে তা কি আমার চোখ?

না।
তো আপনি আপনার চোখ দিয়ে আমার চোখে কীভাবে দেখবেন? তাছাড়া আমার মাই বা আপনার মা হতে যাবে কেন? আপনি কি আমার মায়ের সন্তান? এমন হলে আপনিও তো আমাদের বাসায় থাকতেন। 
তোমার মা তোমাকে বাবা ডাকে কেন?
স্নেহের প্রকাশ।
আমারটা সম্মানের প্রকাশ। আমার মা আমাকে এভাবে মূল্যায়ন করতেন, যেভাবে তোমাকে তোমার মা মূল্যায়ন করেন। প্রত্যেক মায়ের রূপ সন্তানের জন্য অভিন্ন। মা একটি আকাশ,  আকাশ সবার। প্রত্যেকের মা আছে, প্রত্যেকের মা শারীরিকভাবে আলাদা, কিন্তু তাদের মহিমা অভিন্ন।
তাই বলে আমার মা আপনার মা হয় কীভাবে? আমার মা কি আপনাকে আমার মতো ভালোবাসে?
কিন্তু তোমাকে তো ভালোবাসে।
তা তো বাসবেই। উনি আমার মা—  তাই।
মায়ের ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি স্বার্থপর। কারণ সে মা। একজন মা তার সন্তানের ভালোবাসার জন্য যত স্বার্থপর হতে পারে, অন্য কেউ হতে পারে না। তোমার মাকে যদি যমদূত এসে বলে—  আপনার ছেলেকে মারব অথবা পৃথিবীর সব শিশুকে মেরে ফেলব। কোনটায় রাজি? তোমার মা নির্দ্ধিধায় বলবে—  আগে আমার ছেলে। তারপর অন্য কেউ। আমার ছেলে থাকে যেন দুধেভাতে; সুখে আর শান্তিতে।
টিচার, আপনি তো দার্শনিক।
তুমি আমার চেয়ে বড়ো দার্শনিক।

দার্শনিক মানে কী?

বারবার দর্শিত হলেও, যে প্রতিদিন প্রতিবার নতুন দর্শনে নতুন জ্ঞানের ঈক্ষা পায়— সেই দার্শনিক। প্রতিদিন তুমি একই বিষয় দেখছ চারদিকে, কোনোদিন তোমার বিরক্ত এসেছে? কোনোদিন কি মনে হয়েছে তোমার আজন্ম চেনাজানা পরিবেশ প্রতিদিন নতুন করে সজ্জিত হোক আর অপরিচিত হয়ে যাক?

না তো।

মনে হয়েছে, একই জিনিসে প্রতিদিন নতুন কিছু দেখছি। কেন টিচার?

কারণ নতুন সূর্যের আলোতেই তুমি পুরানো জিনিসকে দেখছ। এই আলোটাই জ্ঞান। যা তোমাকে আমি গতকাল বলেছিলাম। তুমি অন্তরে জ্ঞানের আলো সৃষ্টি করতে পারলে একই বিষয়েও প্রতিমুহূর্তে নতুন কিছু পাবে।    

সব ঠিক আছে, কিন্তু বিড়ালটা যে মারা হলো না।
বিড়াল কোথায়?
কিছুক্ষণ আগেও যে ম্যাও ম্যাও করল এবং এখনো করছে। অসহ্য। সবগুলো মারতে হবে। এরা শুধু মরার জন্য অপেক্ষা করে, মরার জন্য আসে। মরবে কীভাবে, যদি মারার কেউ না থাকে? মানুষকে মারার জন্য যত হত্যাকারী আছে, পৃথিবীতে তত কীটপতঙ্গও নেই। মানুষের অনেক শত্রু। সবচেয়ে বড়ো শত্রু হচ্ছে মানুষ।
আমি বিড়াল মারব কেন?
আমি মারব, আপনি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবেন। বলার কিছুই থাকে না। প্রথম রাতে বিড়াল মারার মুরোদ অনেক ডিআইজিরও থাকে না। আপনি তো আটশ টাকা বেতনের নগণ্য এক গৃহশিক্ষক। না মারলে তারা ম্যাও ম্যাও করবে, শব্দদূষণ ভালো নয়। গৃহকর্মী আর গৃহশিক্ষকের পার্থক্য কী টিচার?
অঙ্কটা শেষ হয়েছে?
অঙ্ক বানান এত জটিল কেন? ঙ্ক-টা ভারী বিদঘুটে। অনুস্বার দিলে প্রবলেম কী?
অঙ্ক জটিল বলে তার বানানটাও জটিল।
অনুস্বার দেব না কেন?
অনুস্বার দিলে সহজ হয়ে যাবে।
আমি বললাম, তার আগে সন্ধি করতে হবে। সন্ধি মানে কী?
মিল-মহব্বত।
অঙ্ক শব্দের সন্ধি কী?
সন্ধি নেই। তাই ঙ্ক দিতে হয়। জীবন যদি সহজ করতে চাও তাহলে সন্ধি করে চলো।
ঠিক আছে টিচার, সন্ধিই করতে যাচ্ছি; হুদাইবিয়ার সন্ধি।
করো।
বিড়ালের বাচ্চা আর মানুষের বাচ্চাÑ দুটোর কান্না একই রকম। কান্না দিয়ে সহজে মন গলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা বিবেচনা করলে বিড়ালের বাচ্চার কান্না শতে শ নম্বর পাবে। মানুষের বাচ্চা পাবে তার অর্ধেক। মানুষের মল আর কান্না দুটোই আমার কছে ভয়ংকর মনে হয়।
তুমি অনেক কিছু জানো।
মানুষের বাচ্চারা বিড়ালের বাচ্চা থেকে কান্না শিখেছে। তাই মানুষের বাচ্চা বিড়ালের বাচ্চার মতো ম্যাও ম্যাও করে।
ক্লাসের পড়াটা শেষ করতে পারলে সারাদিন তোমার কথা শুনতে পারতাম। কিন্তু তুমি সে সুযোগ দিচ্ছ না। তুমি বেশি কথা বলো।
বেশি কথা বলি বলে, সবাই আমাকে ভয় পায়।
যারা বেশি কথা বলে তারা বাচাল।
আমি আসলেই বাচাল। শিক্ষক হব, তাই বাচলামি শিখছি। টিচার নামের চ-ট স্থানান্তর করে দিন, দেখেন কী হয়?
তুমি থামবে?
অঙ্ক শেখার জন্য শিক্ষক লাগে, বাচলামি শেখার জন্য কী লাগে?
এত কথা বলো কেন?
জানি না, তাই জানার জন্য বাচাল হই।
আমি ওমরের দিকে খুব মন দিয়ে তাকালাম। চোখ দিয়ে তার প্রতিভা ঝরে পড়ছে। চোখে বুদ্ধির দীপ্তি। মুখে লাবণ্যের সঙ্গে অগণিত অনুভবের ঢেউ আমাকে মোহিত করে দিল। কিন্তু সব শয়তানিতে ভরা।
টিচার, আপনি চুপ করে আছেন যে?
ঠিক বলেছ তুমি। বিড়াল প্রথম রাতেই মেরে ফেলা উচিত।
টিচার আমি যে এখনও মারতে পারলাম না।
তুমি আমাকে একটা লাঠি দাও।
কিন্তু টিচার, বিড়াল তো আপনি!
কী!
ভয় পেয়েছেন?


শুবাচ গ্রুপ এর লিংক: www.draminbd.com
————————————————

——————————————-

তিনে দুয়ে দশ: নবম পর্ব

Language
error: Content is protected !!