ড. মোহাম্মদ আমীন
ওমর এসে আমার সামনের সোফায় বসে পড়ল। বড়ো বড়ো চোখ থেকে আমার দিকে বিতৃষ্ণার বাণরশ্মি ছুড়ে দিয়ে বলল, প্রথম পরিচয়, প্রথম কথোপকথন কেমন লাগল টিচার?
কেমন আছ তুমি?
আগে পড়িয়ে নেন। তারপর প্রশ্ন। কেমন আছি এটা কোনো প্রশ্ন হলো?

কথাগুলো অত্যন্ত অপমানজনক হলেও তার নিঃস্পৃহ ভাব এবং স্বাভাবিক অবয়ব দেখে আমি হতভম্ব। বুঝতে পারলাম, খুব কুশলী হতে হবে। নইলে ত্রিশ জনে মতো আমাকেও আউট করে দেবে।
টিচার, আপনিই বলুন আমি কেমন আছি?
তুমি ভালো নেই। তুমি অসুস্থ।
কীভাবে বুঝলেন?
অকারণে এত অবান্তর কথা যারা বলে, এমন কিশোর বয়সে যারা মুরুব্বিদের সঙ্গে পাকনামো করেÑ, তারা ভালো থাকে না। তোমার সমস্যাটা কী?
আমার সমস্যা হচ্ছে, আমার সমস্যার কোনো সমাধান নেই।
সমাধান কী?
সমস্যা হলে যাকে জন্ম দেওয়ার জন্য মানুষ ভাদ্র মাসের কুকুরের মতো ছুটাছুটি করে, বেআক্কেল শিয়ালের মতো বিকালেও ডাকাডাকি সেটিই সমাধান।
তাহলে সমাধান কার ছেলে?
সমস্যার ছেলে। আমি যেমন ডিআইজির ছেলে। ডিআইজি আমার একটা সমস্যা, আমি তার সমাধান। টিচার, আপনার বাবা কী?
মানুষ।
আরে বাবা, সবাই তো মানুষ। তিনি কী করেন?
তুমি আমাকে বাবা ডাকলে কেন?
সরি।
সরি যত কম বলা যায় তত ভালো।
এখন বলুন আপনার বাবা কী করেন?
মাস্টারি করেন, সংসার করেন, মারেন, আরও অনেক কিছু করেন।
আপনি লোকটা বেশি কথা বলেন।
টিচারদের বেশি কথা বলতে হয়। নইলে ছাত্ররাই বেশি কথা বলা শুরু করে। এই যেমন তুমি।
আমি পিবি।
পিবি মানে কী?
প্রবলেম বয়।
আমি বললাম, প্রবলেম বয় যখন আছে, নিশ্চয় প্রবলেম ফাদারও আছে।
অনেকের ছেলেপেলে হয় না। যদি আমার সমস্যার ছেলেপেলে না হয়?
তেমন হলে ধরে নেব, তোমার সমস্যা জটিল কিছু না। যে সৃষ্টি করতে পারে না সে অথর্ব। তাকে সহজে দূর করে দেওয়া যাবে। এসব বাদ দাও, আজ কী পড়বে?
তার আগে বলুন, কতক্ষণ পড়াবেন?
যতক্ষণ ইচ্ছে।
টিচার আমার খেতে ভালো লাগে, কিন্তু কেউ খাইয়ে দিলে ভালো লাগে না। আমি বড়ো হয়েছি। আমার পড়তে ভালো লাগে, কিন্তু কেউ পড়িয়ে দিলে, এঁটো ভাতের মতো ঘিনঘিন লাগে। সবকিছুর একটা বয়স আছে, সময় আছে। আপনি চলে যান, আমি একা একা পড়ব।
ডিআইজি সাহেবের ছেলে ওমর আমাকে সালাম দিল না, শিক্ষক হিসেবে প্রাপ্য কোনো সম্মান প্রদর্শন করল না। বরং এমনভাবে কথা বলছে, শুনে মাথা চক্কর দিতে শুরু করেছে। আমি নিজেকে সংযত করলাম। মাথা চক্কর

দিক, তা ওমরকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। এসে যখন পড়েছি, শেষ দেখে তারপর যাব। প্রতিজ্ঞা আমার দৃঢ় হলো।
ওমর বলল, আপনি আমার আচরণ নিয়ে ভাবছেন, তাই না?
তুমি আমার চেয়েও বেশি কথা বলো।
বড়ো হয়ে আমি টিচার হব। তাই প্র্যাকটিস করছি। প্র্যকটিস করলে প্রেস্টিজ বাড়ে। টিচার, আপনি মোটেও স্মার্ট নন। আপনাকে আমার ফুটপাতের ক্যানভাসার মনে হচ্ছে। সব টিচার অ্যাজ লাইক আ্যজ ফুটপাতের ক্যানভাসার। সারাক্ষণ ঘ্যনঘ্যান করে। উহ!
কী বললে?
আপনি একটা আনস্মার্ট ম্যান। স্মার্ট হতে পারেন না?
কী করলে স্মার্ট হওয়া যায়?
মুখে ঘাম থাকবে না। সুন্দর জামাকাপড় পরবেন। জামায় থাকবে সোনালি বোতাম, গলায় রুপালি টাই, পকেটে পার্কার কলম। পায়ে চকচকে সু যুবতি কাকের পালকের মতো চকচক করবে, চুলের ভাঁজে থাকবে ডিআইজির স্টাইল। হাতে সিগারেট, চোখে আই-লিপ।
ডিআইজি স্টাইল কী?
আমার বাবার চুল আঁচড়ানো দেখেছেন?
উনার সঙ্গে আমার এখনও দেখা হয়নি।
আপনি কী অনেক দূর থেকে হেঁটে আসেন?
কেন?
আপনার শরীর থেকে গন্ধ বের হচ্ছে। নিশ্চয় কয়েকদিন গোসল করেননি। প্রতিদিন গোসল করবেন। আমি একটা বডি স্প্রে নিয়ে আসি। আপনি ততক্ষণ ফ্যানের নিচে গিয়ে বসুন। ঘাম শুকিয়ে যাক। আমি কারও ঘামের গন্ধ সহ্য করতে পারি না। বমি আসে। যত্তসব!
অনেক কষ্টে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। বুঝতে পারছিলাম, ওমর আমাকে রাগিয়ে দিয়ে হারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। রাগলে আউট। তবে অপমানে ঘামছিলাম, বের হয়ে যাক অপমান তরল ঘাম হয়ে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো ওমর। হাতে একটা বডি স্প্রে। ওটি আমার সামনে রেখে বলল, এসি ছেড়ে দেব?
লাগবে না।
আপনি কিন্তু ঘামছেন।
গরম লাগছে একটু।
এগুলো গরমের ঘাম নয়, লজ্জার ঘাম। ঘাম দেখলে আমি বুঝি। আমার কথা শুনে লজ্জা পেয়েছেন। পুরুষ মানুষের এত লজ্জা কীসের? সবসময় একটা বডি স্প্রে রাখবেন। টিচার এটা নিয়ে যাবেন। দাম দেওয়ার সামর্থ্য আপনার নেই। প্যারিস থেকে এসেছে। আপনার তিন মাসের বেতন।
পড়বে, নাকি ফুটপাতের ক্যানভাসারের সহায়কের মতো বকবক করবে?
আজ আপনাকে পড়াব।
কী পড়াবে?
অনেক কিছুই পড়িয়েছি। আর কত? আগামীকাল আপনার কাছ থেকে পড়ব। একদিন আমি পড়াব আর একদিন আপনি। ফিফটি ফিফটি।
তোমার বেতনটা দেবে কে? আমি দিতে পারব না।
আপনার বাপ দেবে। কত চালাককে জল খাইয়েছি। আপনি তো স্পঞ্জ।
ঠিক আছে। আমি তাহলে যাই।
যান, ডোজ অনেক হয়ে গেছে।
আমি দরজার বাইরে গিয়ে জুতো পরছি। এ সময় ওমর ডাক দিল, টিচার?
কিছু বলবে?
বডি স্প্রেটা নেবেন না?
তুমি এটা ফটকে রেখে এসো। আমি তোমাদের বাসায় ঢোকার আগে পুলিশের পোশাক পরা লোকদের কেউ একজন আমার শরীরে দিয়ে দেবে।
নিয়ে গেলে অসুবিধা কোথায়?
আমি বডি ¯েপ্র দিতে জানি না। বোতল থেকে গ্যাসগুলো যখন বের হয়ে আসে মনে হয়Ñ বিসুভিয়াস আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে।
এসেছেন যখন একটা কিছু পড়িয়ে যান।
কী পড়াব? জুতো না পরে আবার ঢুকে গেলাম কক্ষে।
বলুন তো, পুলিশ আগে না পোশাক আগে?
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছে করছে দুটো কষে থাপ্পড় লাগাই। কিন্তু এমন কিছু করা যাবে না। রাজিব আমাকে বড়ো আশা করে দিয়েছে। বললাম, আমার শরীরে একটু স্প্রে করো।
বুঝেছি, বিসুভিয়াস দেখলে আমার ভয়টা কেটে যাবে।
আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, বয়সের চেয়ে তুমি অনেক বেশি জানো, অনেকের চেয়ে অনেক বেশি



ভালো। অনেক বেশি বুদ্ধিমান। আই লাভ ইউ।
পাম্পুটা কিন্তু ঠিক সময়ে দিয়ে গেলেন। খারাপ লাগেনি টিচার।
এ সময় ঘেউঘেউ শব্দে বাঘের মতো একটা কুকুর আমার সামনে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি ভয়ে একটু সরে যেতে ওমর খিলখিল করে হেসে বলল, এটাই আমার একমাত্র বন্ধু।
কুকুর বন্ধু হতে যাবে কেন?
জানোয়ারের বন্ধু কি মানুষ হয়? টিচার, আপনি কি পাগল?
পাগল না হলে তোমাকে এতক্ষণ সহ্য করলাম কীভাবে?
আমি যদি জানোয়ার না হতাম, আপনার মতো পাগলকে… টিচার, গুড বাই। আগামীকাল দেখা হবে, যদি আসেন। তবে না আসাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মনে হচ্ছে আসবেন না। নিজের ভালো পাগলও বুঝে।
ওমর, এদিকে এসো। তোমাকে একটা চুমো খাই।
ওমর সত্যি সত্যি এগিয়ে এলো, টিচার, মেয়ে হলে আমি আসতাম না চুমো নিতে। আপনিও ডাকতেন না দিতে, ঠিক বলছি না?
তিনে দুয়ে দশ: তৃতীয় পর্ব ও চতুর্থ পর্ব