তিনে দুয়ে দশ: বিংশ পর্ব

ড. মোহাম্মদ আমীন

তিনে দুয়ে দশ: বিংশ পর্ব

ডিআইজি সাহেবের ছেলের জন্মদিন। তিনি বিভাগের সব ওসি-এসপির বস। শহরের তামাম ধনী ব্যবসায়ীরা তাঁর খাতির চান। বড়ো-ছোটো সব রাজনীতিবিদ ডিআইজির প্রিয় হতে আগ্রহী। যদিও সবার পক্ষে তাঁর নৈকট্য লাভ সম্ভব হয় না। কিছুদিন আগে ডিআইজি দম্পতির  বিবাহ বার্ষিকীতে অংশগ্রহণ করে বুঝেছি— উৎসব কত মহোৎসব হতে পারে, কতো জাঁকজমক হতে পারে টাকায় টাকায়। পৃথিবীর প্রায় সব মানুষ ক্ষমতা আর টাকার। এ

ড. মোহাম্মদ আমীন

দুটো দিয়ে কুপোকাত করা যায় না এমন কুপো পৃথিবীতে বিরল।
ডিআইজি সাহেবের একমাত্র ছেলে ওমর। অনেক দামি উপহার আসবে তার জন্মোৎসবে। আমাকেও কিছু একটা দিতে হবে। আর্থিক মূল্যে দামি উপহার নিয়ে চিন্তা করা আমার জন্য হাস্যকর। ওমরকে কী উপহার দেব সেটাই আমার বিষয়।
টাকার মূল্যে দামি—এমন কিছু দেওয়ার সমার্থ্য আমার নেই। অমন অসংখ্য উপহারের ভিড়ে আমার উপহার হারিয়ে যাবে-এ আমি চাই না। যতই উপহার আসুক, যতই দামি হোক— আমি এমন উপহার দেব যা ওমরের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হবে,  ম্লান করে দেবে সবার উপহারকে।এমন উপহার কী হতে পারে? বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না, পেয়ে যাই সহজে। পরশু ওমর জানিয়েছে- তার জন্মদিনে সবাই আসবে। তবে নিহা নিশাত আসবে না।
সে না এলে খারাপ লাগবে?
মোটেও না। তবে প্র্যাস্টিজের বিষয়। 
এটা আবার কী?
নিহা নিশাতকে দাওয়াত দিতে গেলাম, প্রত্যাখ্যান করল। বললাম- তোমাকে আামার জন্মদিনে আসতে হবে। নিহা নিশাত বলল— “কখনো না, মরে গেলেও না। অনেক অপমান সহ্য করেছি, আর না।”

না এলে না আসবে!

তার প্রত্যাখান আমার জন্য অপমান। আমি কারো প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারি না।
তারপর কী হলো? 
আমি বলেছি— তোমাকে আমার জন্মদিনে নিয়েই ছাড়ব।

আসবে?

মনে হয় না। যদি না আসে,  আমার সব প্র্যাস্টিজ ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাবে। কী করি বলুন তো টিচার?
তোমার কোনো পরিকল্পনা আছে?
আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি।সে আসবে না- নিশ্চিত। আমি অপমানিত হওয়ার জন্য মনে মনে রেডি হয়ে আছি। সে না এলে তার বাবা-মাও আসবেন না। আমার সঙ্গে সঙ্গে ডিআইজি সাহেবের প্র্যাস্টিজও ফুটুস। আপনিই ঠিকই বলেছেন টিচার—বাবার সম্মান ছেলেতে, ছেলের সম্মান বাবাতে।
সিদ্ধান্ত নিলাম, উপহার হিসেবে ওমরকে একটা চিঠি দেব নিহা নিশাতের উদ্দেশে। নিহার জন্য ওমরের হয়ে অনেক চিঠি লিখেছি। নিহার উত্তর পড়ে পরের চিঠি লিখেছি। এভাবে নিহা নিশাতের মন-মানসিকতা আমার নখ দর্পণে এসে গেছে। এখন আমি ইচ্ছা করলে চিঠির মাধ্যমে নিহা নিশাতকে দিয়ে যে-

পুথিনিলয়, বাংলাবাজার।

কোনো কিছু করিয়ে নিতে পারি।
অনেক চিন্তাভাবনা করে ওমরের বান্ধবী নিহা নিশাতকে দেওয়ার জন্য একটা চিঠি লিখলাম। জন্মদিনে ওমরের সব বন্ধুরা এসেছে। চার জন বন্ধুকে আমার কাছে এনে ওমর বলল, এদের জামা-প্যান্টগুলো কেমন হয়েছে?
অনেক ভালো।
ওমর বলল, কে চুজ করেছে দেখতে হবে না।
কেমন লাগছে তোমার? আমি প্রশ্ন করলাম ওমরকে।
পুরো ২৮ গ্রাম এস্তেতিন একসঙ্গে পেলেও এমন আনন্দ পেতাম না। আমি প্রতিবছর জন্মদিনে আমার গরিব বন্ধুদের জামাকাপড় দেব। ইদে যে টাকা বিদেশ গিয়ে খরচ করি, সেগুলো দিয়ে টাইগার হিলসের বস্তির বাচ্চাদের জামা কিনে দেব। দানের চেয়ে আনন্দ আর কিছু নেই।
নিহা নিশাত এসেছে?
না।
ইজ্জত আর থাকল না।
ওমরের হাতে চিঠিটা গুঁজে দিয়ে বললাম, এটি তোমার রুমে কপি করে আগের মতো নিহা নিশাতের কাছে এক্ষুনি পাঠিয়ে দাও।
ওমর চলে গেল তার রুমে। পাশেই নিহা-নিশাতদের বাড়ি। পাঁচ মিনিটের হাঁটা-পথ।যদি আসে বেশিক্ষণ লাগবে না।আধ ঘণ্টা পর ওমর এসে তার বাবা-মা-সহ এক ঝাঁক অতিথির সামনে আমাকে প্রবল আবেগে জড়িয়ে ধরে বলল, টিচার পুরো পৃথিবী এনে দিলেও আমি এত খুশি হতাম না।
কী হয়েছে?
নিহা নিশাত চলে এসেছে। সঙ্গে তার পরিবারের সবাই।
পরদিন পড়া শুরু করার আগে ওমর আমার হাতে পাঁচশ টাকার একটা নোট দিয়ে বলল, টিচার এটা রাখুন।
কেন?
চিঠিটা একদম ফাটাফাটি হয়েছে।
কীসের লেখা?
কাল যে একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলেন।
পাঁচশ টাকা কী হিসেবে দিলে— উপহার?
না।
কৃতজ্ঞতা?
না।

সম্মানি।
আমি চমকে গেলাম। লেখার প্রথম আয়, মাই গড; এ তো বিশাল কারবার! তাহলে কেন এতদিন লিখিনি! ওমরের অনারিয়ামে উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে সেদিন রাতেই  পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটা লেখা লিখে ফেললাম। শিরোনাম সম্ভবত, কিশোর মনের কান্না।পরদিন ‘পূর্বকোণ’ পত্রিকায় লেখাটা দিয়ে আসি। কয়েকদিন পর দেখি, উপসম্পাদকীয় কলামে আমার লেখাটা প্রকাশিত হয়েছে।
এরপর ধীরে ধীরে লেখা আমার নেশা হয়ে যায়।

—————————————————-
——————————-
ওয়েব লিংক
—————————
অন্যান্য
Language
error: Content is protected !!