ড. মোহাম্মদ আমীন
ভগবান নামের এক সাধু ব্যক্তি রাজার খুব বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছিলেন। রাজা তাঁকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করতেন। ভগবান সাধুর প্রস্তাব ও পরামর্শ রাজা অনেক সময় উচ্চপদস্থ অনুচরদের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন আর মানতেন।রাজার অন্যান্য অনুচরগণ ভগবানের এমন উত্থান ও মর্যাদা সহ্য করতে না পেরে তাঁকে (ভগবান) হেয় করার ষড়যন্ত্র করলেন। কিন্তু তেমন কোনো সুযোগ অনুচরগণ পাচ্ছিলেন না, তবে সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন। সুযোগের অপেক্ষায় থাকলে সুযোগ না-এসে পারে না। একদিন সুযোগ এসে গেল। ভগবান দূরগ্রামে যজমান বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গেলেন। দূরের পথ, আসতে আর যেতে পক্ষকাল লেগে যাবে। ভগবান যেদিন যজমান বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন তার পরদিন অনুচরগণ প্রচার করে দিলেন—“ভগবান মরে গিয়েছেন।” ভগবানের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে রাজা দুঃখ প্রকাশ করলেন। রাজ্যের সবাই জানলেন, ভগবান মরে গিয়েছেন।
এই ঘটনার পনেরো দিন পর ষোলো দিনের মাথায় ভগবান রাজ দরবারে এলেন। যজমান বাড়িতে অনেক উপহার পেয়েছেন— এর কিছু রাজার জন্য নিয়ে এসেছেন। রাজা ভগবানকে দেখে তাঁর মৃত্যু বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে অনুচরগণ এক বাক্যে বলে উঠলেন, “ ইনি ভগবান নন, ভগবান মরে ভূত হয়ে এসেছেন।” ভগবান বললেন, “হুজুর আমি মরিনি। আমি ভূত-ভগবান নই, মানুষ-ভগবান।”
হাজার হাজার অনুচর ভগবানের সত্য কথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য সমকণ্ঠে চিৎকার দিয়ে বললেন— “হুজুর, আমরা দেখেছি ভগবান মরে গিয়েছেন।” রাজ্য সচিব বললেন, “ভগবানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় রাজ দরবারের অনেকে অংশগ্রহণ করেছেন। মহারাজ, ইচ্ছে হলে আপনি তাদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন।” রাজা অনুচরদের দিকে তাকালেন, কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করার আগে শত শত অনুচর চিৎকার দিয়ে বললেন, “হুজুর, আমরা ভগবানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিলাম।”
ভগবান আবার প্রতিবাদ করলেন, “হজুর, আমি মরিনি, আমি ভূত নেই, রক্তমাংসের মানুষ।” কিন্তু একজন ভগবানের কথা হাজার ভগবান বিরোধীদের কথার মধ্যে হারিয়ে গেল। রাজাও শেষ পর্যন্ত অনুচরগণের কথা বিশ্বাস করে নিলেন। হাজার লোকের কথায় জীবিত ভগবান সাধু মরে ভূত হয়ে গেলেন। এভাবে দশে যা বলে তা মিথ্যা হলেও সত্য হয়ে যায়। হুজুগে বাঙালিতে এটি বেশি দেখা যায়। জনপ্রিয় অনেক গণমাধ্যম এভাবে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করে।
নীতিবাক্য : (১) নিজের চোখকে অবহেলা করে দশজনের কেন, হাজার জনের কথাও বিশ্বাস করতে নেই। (২) গুজবে কান দেবেন, কিন্তু মন দেবেন না।
——————————————————————————————————————————————–
তথ্য-নির্যাস: বিবিধার্থ অভিধান, শ্রীসুধীরচন্দ্র সরকার, প্রথম প্রকাশ, বৈশাখ ১৮৮৪ শকাব্দ, প্রকাশক : শ্রীজিতেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ৯, অ্যান্টনী বাগান লেন, কলিকাতা,- ৯, মূল্য : ছয় টাকা পঞ্চাশ নয়া পয়সা।
——————————————————————————————————————————————–