দাপ্তরিক প্রমিত বানান-কৌশল
নানা কারণে বাংলা বানানে ভুল হয়। সামান্য শ্রম, কিছুটা মনোযোগ ও বাংলা অভিধান দেখার মনোবৃত্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে বানান ভুল বহুলাংশে দূরীভূত করা যায়। আর একটি বিষয় হলো বানান কৌশল ও বানানের সূত্র সম্পর্কে অবগত হওয়া। এ অধ্যায়ে এমন কিছু নিয়ম দেওয়া হলো যে সব নিয়ম জানা থাকলে প্রাত্যহিক কাজে বানান ভুলের আশঙ্কা বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
১. ‘ও’ বর্ণের ফাঁক-অফাঁক : ‘ও’ বর্ণের অর্থ যখন ‘এবং’ কিংবা বর্ণটি যখন সংযোজক অব্যয় হিসাবে কাজ করে তখন ‘ও’ অন্য কোনো শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে না। যেমন কামাল ও জামাল দুই ভাই। তবে ‘ও’ যখন ‘আরও, এরপর’ প্রভৃতি অর্থ প্রকাশ করে তখন অন্য শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে। যেমন (ক) জামালের সঙ্গে কামালও বাজারে যাবে। (খ) শুধু ধন থাকলে হবে না; মনও থাকা চাই।
২. ক্রিয়াপদে ‘ও-কার’ : সাধারণ মধ্যম পুরুষের (তুমি/তোমরা) বর্তমান কালের রূপের (কর/ধর/বল) সঙ্গে বর্তমান অনুজ্ঞার রূপের (করো/ধরো/বলো) পার্থক্য স্পষ্ট করার জন্য বর্তমান অনুজ্ঞার রূপে ক্রিয়াপদের অন্তে ‘ও-কার’ বিধেয়। যেমন (ক) তুমি এখন কী কর? (সাধারণ বর্তমান) (খ) কাজটা এক্ষুনি করো (বর্তমান অনুজ্ঞা)। সাধারণ-বর্তমান অনুজ্ঞার সঙ্গে পার্থক্য নির্দেশের জন্যও সাধারণ-মধ্যম পুরুষের বর্তমান-অনুজ্ঞার রূপের সঙ্গে ও-কার বিধেয়। যেমন তুমি/তোমরা, বসো, চলো, বলো, করো, ধরো, পড়ো প্রভৃতি।
বর্তমান অনুজ্ঞার সঙ্গে ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার অর্থে যেন জটিলতা সৃষ্টি না-হয় সেজন্য ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় একাধিক ‘ও-কার’ দেওয়া বিধেয়। যেমন (ক) বইটা তুমি পড়ো (বর্তমান অনুজ্ঞা)। (খ) আগামী তিন দিনের মধ্যে তুমি বইটা শেষ কোরো (ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা)। কোনো শব্দের পরে ‘দাস’ শব্দ যুক্ত হলে তার পূর্বেও ই-কার বসে। যেমন কালিদাস, ষষ্টিদাস, দেবিদাস ইত্যাদি।
৩. ‘দু’ নাকি ‘দূ’ : অনেকে বাংলা বানানে ‘দু’ ও ‘দূ’ নিয়ে সমস্যায় পড়ে যান। কোথায় ‘দু’ হবে আর কোথায় ‘দূ’ হবে এ জটিলতা অনেক সময় বানান ভুলের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা জানি, দূরত্ব লিখতে ‘দূ’ লাগে। তাই যে সব শব্দে দূরত্ব বোঝায় না সে সব শব্দে উ-কার যোগে ‘দুর’ (উপসর্গ) বা ‘দু + রেফ’ হবে। যেমন দুরবস্থা, দুরন্ত, দুর্বার, দুরাকাক্সক্ষা, দুরারোগ্য, দুরূহ, দুর্গা, দুর্গতি, দুর্গ, দুর্দান্ত, দুর্নীতি, দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, দুর্নাম, দুর্ভোগ, দুর্দিন, দুর্বল, দুর্জয়, দুঃসময় ইত্যাদি। অন্যদিকে, যে সব শব্দে দূরত্ব বোঝায় সে সব শব্দে ঊ-কার যোগে ‘দূর’ হবে। যেমন দূর, দূরবর্তী, দূরদূরান্তর, দূরালাপন, দূরীকরণ, অদূর, দূরত্ব, দূরবীক্ষণ, দূরাগত, দূরদৃষ্টি ইত্যাদি।
৪. বিদেশি শব্দের বানানে ‘আস্ত-ত’ : বিদেশি শব্দের বাংলা বানানে সর্বদা ‘আস্ত-ত’ বসবে; খণ্ড-ৎ নয়। তৎসম শব্দের বানানে ‘ত’ ও ‘খণ্ড-ৎ’ উভয়ের ব্যবহার আছে। তবে বিদেশি শব্দের বানানে কোথাও ‘খণ্ড-ৎ’ হবে না। সবসময় ‘আস্ত-ত’ ব্যবহৃত হবে। যেমন আখেরাত, আদালত, আমানত, আয়াত, কিসমত, কুদরত, কেয়ামত, কৈফিয়ত, খেসারত, জালিয়াত, তফাত, তবিয়ত, দস্তখত, দৌলত, নসিহত, ফেরত, বজ্জাত, বেহেশ্ত, মওত, মজবুত, মতলব, মেহনত, শরবত, শরিয়ত, শাহাদত, সওগাত, সুন্নত, হিম্মত, হেফাজত প্রভৃতি।
৫. বিশেষণ পদ লেখার নিয়ম : বিশেষণ পদ সাধারণত সংশ্লিষ্ট পদ থেকে নিজেকে ফাঁক রেখে বসে। কোনো পদের পূর্বে বিশেষণ বসানো প্রয়োজন হলে কাক্সিক্ষত বিশেষণটি পরবর্তী পদের সঙ্গে যুক্ত না-করে পৃথক রাখা সমীচীন। যেমন নীল আকাশ, জ্যোৎস্না রাত, লাল শাড়ি, পাকা বাড়ি। তবে বিশেষ্যের সঙ্গে যে বিশেষণ বসানো হয় তার কোনো বিশেষণ থাকলে পদদ্বয় একত্রে বসে। যেমন বিশ্বসুন্দরী, রক্তলাল, দুগ্ধধবল ইত্যাদি।
৬. বিদেশি শব্দে দন্ত্য-স : বিদেশি শব্দে মূর্ধন্য-ষ ব্যবহার হবে না, সবসময় দন্ত্য-স ব্যবহার হবে। যেমন পোস্ট অফিস, স্টার, স্টাফ, স্টেশন, স্ট্যাটাস, মাস্টার, ডাস্টার, পোস্টার, স্টক, স্টিমার, ফাস্ট, ক্লাস, স্ট্রিট, বেস্ট প্রভৃতি। অন্যদিকে, ষত্ব-বিধি অনুযায়ী শব্দের বানানে ট-বর্গীয় বর্ণের সঙ্গে মূর্ধন্য-ষ যুক্ত হয়ে ‘ষ্ট’ বসবে। যেমন বৃষ্টি, কৃষ্টি, সৃষ্টি, দৃষ্টি, মিষ্টি, নষ্ট, কষ্ট, তুষ্ট, সন্তুষ্ট, দুষ্ট, স্পষ্ট, অতিষ্ঠ, নিষ্ঠ ইত্যাদি।
৭. পদন্তে জীবী ও জীব শব্দের বানান : পদের শেষে ‘-জীবী’-যুক্ত বাক্যে ঈ-কার হবে। যেমন কৃষিজীবী, চাকরিজীবী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, আইনজীবী, কলমজীবী, বুদ্ধিজীবী, শ্রমজীবী ইত্যাদি। তেমনি, জীব,
-জীবী, জীবিত, জীবিকা প্রভৃতি শব্দের ‘জীব’ বানানে ‘বর্গীয়-জ’ বর্ণে ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ হবে। যেমন সজীব, রাজীব, নির্জীব, জীবিত, জীবিকা, জীবন প্রভৃতি।
৮. বহুবচন-বাচক ‘বলি’ : পদের শেষে বহুবচন-বাচক ‘-বলি’ (আবলি) ই-কার-যুক্ত হবে। যেমন দৃশ্যাবলি, কার্যাবলি, শর্তাবলি, ব্যাখ্যাবলি, নিয়মাবলি, তথ্যাবলি, সমস্যাবলি, পদাবলি প্রভৃতি।
৯. পূর্ণ ও পুন : ‘সম্পূর্ণ’ বা ‘পুরো’ প্রভৃতি অর্থ বোঝালে ‘পূর্ণ’ শব্দটিতে ‘দীঘ ঊ-কার’ এবং ‘র্ণ’ ব্যবহার হবে। যেমন পূর্ণাবয়ব, পূর্ণরূপ, পূর্ণমান, সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ, পূর্ণমাত্রা, পূর্ণরাত্রি, পূর্ণমর্যাদা প্রভৃতি। তবে, ‘পুন’ শব্দাণু দিয়ে ‘পুনঃ/পুন+রেফ/পুনরায়’ বুঝালে শব্দটিতে উ-কার হবে এবং এটি সংশ্লিষ্ট শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসবে। যেমন পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা, পুনঃপুন, পুনর্জীবিত, পুনর্নিয়োগ, পুননির্মাণ, পুনর্মিলন, পুনর্মিলনী, পুনর্লাভ, পুনর্মুদ্রিত, পুনরুদ্ধার, পুনর্বিচার, পুনর্বিবেচনা, পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ইত্যাদি।
১০. ‘স্ত’ ও ‘স্থ’ : যে সব শব্দের শেষে ‘দন্ত্য-স’ আছে সে সব শব্দের শেষে ‘ত’ কিংবা সংস্কৃত ‘ক্ত’ প্রত্যয়যুক্ত হলে শব্দের শেষে ‘স্ত’ হবে এবং শব্দটি বিশেষণে পরিণত হয়। যেমন বিন্যাস-বিন্যস্ত, আশ্বাস-আশ্বস্ত, সন্ত্রাস-সন্ত্রস্ত ইত্যাদি। শব্দের অর্থ ‘যে বা যে স্থানে’ প্রকাশ করলে শব্দটির সঙ্গে ‘স্থ’ যুক্ত হবে। যেমন গ্রহস্থ, কণ্ঠস্থ, নিচস্থ প্রভৃতি।
কোনো শব্দে ‘স্ত’ বা ‘স্থ’ বসানো নিয়ে ঝামেলায় পড়লে প্রথমে শব্দটি হতে ‘স্থ’ বাদ দিয়ে দিন। এরপর অবশিষ্ট শব্দাংশ অর্থবোধক হলে ‘স্থ’ বসানো যাবে, অন্যথায় ‘স্ত’। যেমন অধীনস্থ, অন্তঃস্থ, নিকটস্থ, পকেটস্থ, দ্বারস্থ, পরিবারস্থ, কণ্ঠস্থ, ভূগর্ভস্থ, মনস্থ, মুখস্থ, সভাস্থ, সমাধিস্থ, মনস্থ ইত্যাদি শব্দগুলো হতে ‘স্থ’ বাদ দিলেও প্রত্যেকটি শব্দ অর্থবোধক থাকে। অন্যদিকে অভ্যস্ত, অস্ত, আশ্বস্ত, নিরস্ত, ন্যস্ত, পরাস্ত, পর্যুদস্ত, প্রশস্ত শব্দগুলো হতে ‘স্ত’ বাদ দিলে শব্দগুলো আর অর্থবোধক থাকে না।
১১. ‘কে’ এর ফাঁক-অফাঁক : বাক্যে ‘কে’ ও ‘-কে’ কখন কোথায় বসবে এ নিয়ে অনেকে দ্বিধায় পড়ে যান। বস্তুত প্রশ্নবোধক অর্থে ‘কে’ (ডযড় অর্থে) প্রয়োগ করা হলে তা সংশ্লিষ্ট শব্দ হতে ফাঁক রেখে বসাতে হবে। যেমন নাছিম আবার কে? যদি প্রশ্ন না-বোঝায় তা হলে ‘কে’ পদটি একত্রে বসে। যেমন নাছিমকে আমি দেখিনি।
১২. ক্রিয়াপদে ‘না’ অব্যয় : ক্রিয়াপদের পূর্বে ব্যবহৃত হলে ‘না’ অব্যয়ের পর হাইফেন বসবে। যেমন না-দেখা, না-খাওয়া, না-যাওয়া। তবে ক্রিয়াপদ ছাড়া অন্য কোনো শব্দের আদিতে ব্যবহৃত ‘না’ অব্যয়ের পর হাইফেন দেওয়া বিধেয় নয়। যেমন নাবালক, নাহক, নাজায়েজ, নাপাক।
১৩. বিদেশি শব্দে ঈ ণ ছ ষ : বিদেশি শব্দে দীর্ঘ ঈ-কার, মূর্ধন্য-ণ, ছ, মূর্ধন্যÑষ প্রভৃতি বর্ণ ব্যবহার হবে না। যেমন ইংরেজি, টেলিভিশন, সরকারি, হর্ন, কর্নার, গভর্নর, স্টার, সালাম, ইনসান, বাসস্ট্যান্ড ইত্যাদি।