১৪. অ্যা-এ : বিদেশি শব্দের বাংলা বানানে বাঁকা শব্দের উচ্চারণে ‘অ্যা’ ব্যবহার হবে। যেমন অ্যান্ড (অহফ), অ্যাড (অফ/অফফ), অ্যাকাউন্ট (অপপড়ঁহঃ), অ্যাম্বুলেন্স (অসনঁষধহপব), অ্যাসিস্ট্যান্ট (অংংরংঃধহঃ), অ্যাডভোকেট (অফাড়পধঃব), অ্যাকাডেমিক (অপধফবসরপ), অ্যাডভোকেসি (অফাড়পধপু) ইত্যাদি। তবে, অবিকৃত বা সরলভাবে উচ্চারণে ‘এ’ হয়। যেমন এন্টার (ঊহঃবৎ), এন্ড (ঊহফ), এডিট (ঊফরঃ), বাংলা একাডেমি (ইধহমষধ অপধফবসু) প্রভৃতি।
১৫. ইংরেজি বর্ণ ঝ-এর প্রতিবর্ণ : ইংরেজি বর্ণ ঝ-এর বাংলা প্রতিবর্ণ ‘দন্ত্য-স’ এবং ংয, -ংরড়হ, ও -ঃরড়হ শব্দগুচ্ছে ‘তালব্য-শ’ বসবে। যেমন সিট (ঝবধঃ/ঝরঃ), শিট, (ঝযববঃ), রেজিস্ট্রেশন (জবমরংঃৎধঃরড়হ), মিশন (গরংংরড়হ), স্টেশন (ংঃধঃরড়হ) প্রভৃতি।
১৬. আরবি বর্ণের প্রতিবর্ণিকরণ : আরবি বর্ণ ش (শিন)-এর বাংলা বর্ণরূপ হবে ‘তালব্য-শ’ এবং ث (সা), س (সিন) ও ص (সোয়াদ)-এর বাংলা বর্ণরূপ হবে ‘দন্ত্য-স’। ث (সা), س (সিন) ও ص (সোয়াদ)-এর উচ্চারণ মূলশব্দের মতো হবে এবং বাংলা বানানের ক্ষেত্রে ‘দন্ত্য-স’ ব্যবহার করতে হবে। যেমন সালাম, শাহাদাত, শামস্, সূরা, সুন্নাত ইত্যাদি। তবে ফারসি, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষা থেকে আগত শব্দসমূহে ছ, ণ ও ষ ব্যবহার হবে না।
১৭. ণত্ববিধি : তৎসম শব্দে ণত্ব বিধান অনুসারে মূর্ধন্য-ষ ব্যবহার করতে হবে। খাঁটি বাংলা ও বিদেশি শব্দে ‘মধূর্ন্য-ষ’ ব্যবহার হবে না। বাংলা বানানে কেবল তৎসম শব্দে ‘মূর্ধন্য-ষ’ ব্যবহৃত হবে। যুক্তবর্ণ, ঋ-কার ও র-ফলা যোগে গঠিত যুক্তধ্বনিতে ‘দন্ত্য-স’-এর উচ্চারণ পাওয়া যায়। যেমন সৃজন, স্মৃতি, স্পর্শ, স্রোত, শ্রী, আশ্রম প্রভৃতি।
১৮. সমাসবদ্ধ পদে ফাঁক থাকবে না : সমাসবদ্ধ পদগুলো একসঙ্গে লিখতে হবে, মাঝখানে কোনো ফাঁক রাখা যাবে না। অর্থবিভ্রাট এড়ানোর স্বার্থে সমাসবদ্ধ শব্দটিকে একটি, কখনো বা একাধিক হাইফেন (-) দিয়ে যুক্ত করা যায়। যেমন মা-মেয়ে, বাপ-বেটা, সর্ব-অঙ্গ, স্থল-জল-আকাশ-যুদ্ধ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়স-নারী-পুরুষ ইত্যাদি। কিছু সমাসবদ্ধ পদের উদাহরণ দেখুন। যেমন চিঠিপত্র, আবেদনপত্র, ছাড়পত্র, বিপদগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত, গ্রামগুলি/গ্রামগুলো, রচনামূলক, সেবাসমূহ, যত্নসহ, পরিমাপসহ, ত্রুটিজনিত, আশঙ্কাজনক, বিপজ্জনক, অনুগ্রহপূর্বক, উল্লেখপূর্বক, প্রতিষ্ঠানভুক্ত, গ্রামভিত্তিক, এলাকাভিত্তিক, শহরভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তকরণ, প্রতিবর্ণীকরণ, আমদানিকারক, রফতানিকারক, কষ্টদায়ক, আরামদায়ক, স্ত্রীবাচক, দেশবাসী, গ্রামবাসী, এলাকাবাসী, সুন্দরভাবে, ভালোভাবে, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী, সদস্যগণ, সহকারী, আবেদনকারী, ছিনতাইকারী, সন্ধ্যাকালীন, শীতকালীন, জ্ঞানহীন, বন্ধনহীন, দিনব্যাপী, মাসব্যাপী, বছরব্যাপী, যথাবিহিত, যথাসময়, যথাযথ, যথাক্রমে, পুনঃপুন, পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বহিঃপ্রকাশ প্রভৃতি।
১৯. বিদেশি শব্দে ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ বর্জিত : বিদেশি শব্দে ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ ব্যবহার হবে না, সর্বদা ‘হ্রস্ব ই-কার’ ব্যবহার হবে। যেমন পাকিস্তানি, কাবুলি, ক্রিম, স্টিমার, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, ডিগ্রি, চিফ, শিট, শিপ, নমিনি, কিডনি, ডাক্তারি, ফ্রি, ফি, ফিস, স্কিন, স্ক্রিন, স্কলারশিপ, স্টেশনারি, নোটারি, সরকারি, লটারি, সেক্রেটারি, জমিদারি, ট্রেজারি, ব্রিজ, প্রাইমারি, মার্কশিট, বিল্ডিং, আরবি, নামজারি প্রভৃতি।
২০. বাংলা শব্দে হ্রস্ব ই-কার : অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ও মিশ্র শব্দে ‘হ্রস্ব ই-কার’ ব্যবহৃত হবে। যেমন সরকারি, তরকারি, গাড়ি, বাড়ি, দাড়ি, শাড়ি, চুরি, চাকরি, মাস্টারি, মালি, পাগলামি, পাগলি, বোমাবাজি, দাবি, হাতি, বেশি, খুশি, হিজরি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, ইংরেজি, জাপানি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, ফিরিঙ্গি, সিঙ্গি, ছুরি, টুপি, দিঘি, কেরামতি, রেশমি, পশমি, পাখি, ফরিয়াদি, বেআইনি, কুমির, নানি, দাদি, বিবি, চাচি, মাসি, পিসি, দিদি, বুড়ি প্রভৃতি।
২১. ঙ ও বিসর্গ : সন্ধিতে প্রথম পদের শেষ বর্ণ ‘ম্’ হলে ক-বর্গের পূর্বে ‘ম্’ এর স্থানে ‘ং’ লেখা হবে। যেমন অহম্ + কার = অহংকার, সম + গীত = সংগীত ইত্যাদি। অবশ্য বিকল্পে ‘ঙ’ লেখা যায়। যেমন অহঙ্কার, সঙ্গীত ইত্যাদি। তবে, প্রমিত বানানে সাধারণত অনুস্বার লেখা হয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে ‘ক-বর্গ’ এবং ‘ক্ষ’ এর পূর্বে নাসিক্য বর্ণ যুক্ত করার জন্য সর্বদা ‘ঙ’ লেখা হবে। যেমন অঙ্ক, আকাক্সক্ষা, সঙ্গে ইত্যাদি। প্রত্যয় ও বিভক্তিহীন শব্দের সঙ্গে সাধারণত ‘ং’ ব্যবহৃত হবে। তবে প্রত্যয় বা বিভক্তি যুক্ত হলে কিংবা পদের মধ্যে বা শেষে স্বরবর্ণ থাকলে ‘ঙ’ বসবে। উদাহরণ : রং কিন্তু রঙের, বাংলা কিন্তু বাঙালি, ঢং কিন্তু ঢঙের ইত্যাদি।
প্রকৃতপক্ষে, চন্দ্রবিন্দু এবং অনুস্বার বর্ণের জ্ঞাতিভাই হচ্ছে : ক-বর্গের ঙ, চ-বর্গের ঞ, ট-বর্গের ণ, ত-বর্গের ন এবং প-বর্গের ম। অনুস্বার বর্ণের এ জ্ঞাতিভাইগুলো কখন কোথায় ব্যবহৃত হবে তা নির্ভর করবে ‘অনুস্বার’-বর্ণটি কোন বর্গভুক্ত বর্ণের আগে যুক্ত হবে তার ওপর । ক, খ, ক্ষ (ক+ষ) ও গ এর আগে যুক্ত হলে ক-বর্গের ‘ঙ’ হবে। যেমন অঙ্ক, আকাক্সক্ষা, বঙ্গ, সঙ্গ ইত্যাদি । চ-বর্গের আগে বসলে ঞ হবে। যেমন সঞ্চালক, বাঞ্ছারাম, অঞ্জন ইত্যাদি । ট-বর্গের আগে বসলে ‘মূর্ধন্য-ণ’ হবে। যেমন ডাণ্ডা, ঠাণ্ডা ইত্যাদি। বর্গীয় বর্ণের বাইরের বর্ণগুলোর আগে সাধারণত অনুস্বার অপরিবর্তিত থকে।
উঁয়ো (ঙ) আনুনাসিক শব্দ। যেখানে ‘ঙ’ এর ব্যবহার নির্ধারিত, সেখানে অনুস্বার (ং) ব্যবহার করা যাবে না। যেমন অঙ্ক, অঙ্কন, অঙ্কিত, অঙ্কুর, অঙ্গ, অঙ্গন, আকাক্সক্ষা, আঙ্গুলি, আঙুল, আশঙ্কা, ইঙ্গিত, উলঙ্গ, কঙ্কন, কঙ্কর, কঙ্কাল, কুঙ্কুম, গঙ্গা, চোঙ্গা, চোঙা, টাঙ্গা, ঠোঙ্গা, ঠোঙা, দাঙ্গা, পঙ্ক্তি, পঙ্কজ, পঙ্ক, পতঙ্গ, প্রাঙ্গণ, প্রসঙ্গ, বঙ্গ, বাঙালি, ভঙ্গ, ভঙ্গুর, ভাঙ্গা, ভাঙা, মঙ্গল, রঙ্গিন, রঙিন, লঙ্কা, লঙ্গরখানা, লঙ্ঘন, লিঙ্গ, শঙ্কা, শঙ্ক, শঙ্খ, শশাঙ্ক, শৃঙ্খল, শৃঙ্গ, সঙ্গ, সঙ্গী, সঙ্ঘাত, সঙ্গে, হাঙ্গামা, হুঙ্কার প্রভৃতি।
২২. ক্রিয়াপদে ও-কার : অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদ, বিশেষণ ও অব্যয়পদ বা যে সব শব্দের শেষে ‘ও-কার’ যুক্ত না-করলে সুস্পষ্ট অর্থ অনুধাবনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে সে সব শব্দে ‘ও-কার’ ব্যবহার করা সমীচীন। অন্যথায় ‘ও-কার’ ব্যবহার না-করা উত্তম। যেমন মতো, হতো, হলো, কেনো (ক্রয় করো), ভালো, কালো, আলো ইত্যাদি। তবে অর্থবিভ্রাট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা না-থাকলে ‘ও-কার’ ব্যবহার করা বিধেয় হবে না। যেমন ছিল, করল, যেন, কেন (কী জন্য), আছ, হইল, রইল, গেল, শত, যত, তত, কত, এত, রত, ব্রত, পথ, নত প্রভৃতি।
২৩. ‘আলি’ ও ‘অঞ্জলি’ : বিশেষণবাচক ‘আলি’ প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ‘ই-কার’ হবে। যেমন সোনালি, রুপালি, বর্ণালি, হেঁয়ালি, খেয়ালি, মিতালি প্রভৃতি। অঞ্জলি দ্বারা গঠিত শব্দেও ‘ই-কার’ হবে। যেমন অঞ্জলি, গীতাঞ্জলি, শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রভৃতি।
২৪. ভূত-অদ্ভুত : অদ্ভুত ও ভুতুড়ে শব্দের বানান ছাড়া বাংলা ভাষার অনুরূপ সব শব্দের বানানে ভূত হবে। যেমন ভূত, কিম্ভূত, অভিভূত, ভস্মীভূত, বহির্ভূত, ভূতপূর্ব ইত্যাদি। ‘অদ্ভুত’ শব্দের বানানে ‘হ্রস্ব উ-কার’ কিন্তু ‘কিম্ভূত’ শব্দের বানানে দীর্ঘ ঊ-কার’। ‘অদ্ভুত’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ : অৎ + ভূ + উত = অদ্ভুত। এখানে অন্তে অবস্থিত ‘উত’ প্রত্যয়ের প্রভাবে ‘ভূ’ পরিবর্তন হয়ে ‘ভু’ হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে, কিম্ভূত = কিম্ + ভূত। এখানে ‘উত’ প্রত্যয়ের উৎপাত নেই বলে ‘কিম্ভূত’ শব্দের ভূত অবিকল রয়ে গেছে।
২৫. হীরা ও নীল : হীরা ও নীল অর্থ-প্রকাশক সব বানানে ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ বসবে। যেমন হীরা, হীরক, নীল, সুনীল, নীলক, নীলিমা, নীলময়, হীরণ¥য়, হীরকখণ্ড, নীলপদ্ম প্রভৃতি।
২৬. নাই, নেই, নি : বাংলা একাডেমি প্রমিত বানান রীতি পুস্তিকায় বলেছে, নঞর্থক পদগুলো (নাই, নেই, না, নি) প্রভৃতি আলাদা করে লিখতে হবে। যেমন বলে নাই, আমার ভয় নাই, তার কোনো বাড়ি নেই, হবে না, যাবে না, খাই নি, বলে নি প্রভৃতি। তবে ইদানীং বাংলা একাডেমিসহ অনেকে ‘নি’ পদটি মূল পদের সঙ্গে সেঁটে বসায়। যেমন যাননি, বলিনি, দেখিনি, পাইনি প্রভৃতি। তাদের যুক্তি হচ্ছে : ‘নি’ যেহেতু স্বাধীন কোনো শব্দ নয়, সেহেতু ‘নি’ পদকে মূল শব্দের সঙ্গে সেঁটে লেখা সমীচীন। পশ্চিবঙ্গের বাঙালিরাও এমনটি করে থাকেন। অবশ্য বাংলা একাডেমি ‘নি’ পদটি মূল পদের সঙ্গে ‘সেঁটে বসবে না কি পৃথক বসবে এ ব্যাপারে পরবর্তীকালে আর কোনো সুনির্দিষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেনি। তাই বাংলা একাডেমি হতে প্রকাশিত অনেক গ্রন্থেও ‘নি’ পদকে সংশ্লিষ্ট শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসাতে দেখা যায়। এ রকম আরও অনেক সাংঘর্ষিকতার উদাহরণ দেওয়া যায়।