২৭. ব্যঞ্জনবর্ণের দিত্ব নিষিদ্ধ : রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন অর্চনা, অর্জন, অর্থ, অর্ধ, কর্দম, কর্তন, কর্ম, কার্য, গর্জন, মূর্ছা, কার্তিক, বার্ধক্য, বার্তা, সূর্য প্রভৃতি। আগে এ সকল শব্দের মধ্যকার দিত্ব বর্ণের সঙ্গে রেফ ব্যবহার করা হতো।
২৮. সমাসজনিত সমস্যা : ইন্-ভাগান্ত শব্দের প্রথমার এক বচনের রূপ হিসেবে বাংলায় ‘ধনী, পাপী, গুণী, জ্ঞানী’ ইত্যাদি শব্দ এসেছে। কিন্তু ‘নিঃ’ (নির) উপসর্গযোগে সমাসবদ্ধ হলে এ শব্দগুলোর অন্তে ‘ঈ-কার’ যুক্ত করা ভুল হবে। কারণ, এ-সব ক্ষেত্রে ‘ধনী, পাপী, গুণী, জ্ঞানী’ ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে সমাস হয় না। সমাস হয় ‘ধন, পাপ, গুণ, জ্ঞান’ প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে। যেমন নেই ধন যার = নির্ধন; নেই পাপ যার = নিষ্পাপ; নেই গুণ যার = নির্গুণ ইত্যাদি। অনেকে লিখে থাকেন, নির্ধনী, নিষ্পাপী, নির্গুণী ইত্যাদি। এমনটি বিধেয় নয়। প্রমাদ এড়ানোর সুবিধার্থে এরূপ আরও কিছু শব্দের উদাহরণ ভুলসহ নিচে দেওয়া হলো :
(১) ভুল : নির্জ্ঞানী; শুদ্ধ : নির্জ্ঞান; (২) ভুল : নিরভিমানী; শুদ্ধ : নিরভিমান; (৩) ভুল : নির্বিরোধী; শুদ্ধ : নির্বিরোধ; (৪) ভুল : নির্দোষী; শুদ্ধ : নির্দোষ; (৫) ভুল : নিরপরাধী; শুদ্ধ : নিরপরাধ; (৬) ভুল : নীরোগী; শুদ্ধ : নীরোগ; (৭) ভুল : অহোরাত্রি; শুদ্ধ : অহোরাত্র; (৮) ভুল : দিবারাত্রি; শুদ্ধ : দিবারাত্র; (৯) ভুল : মহারাজা; শুদ্ধ : মহারাজ এবং (১০) ভুল : অহর্নিশি; শুদ্ধ : অহর্নিশ।
উল্লেখ্য, ‘দিনরাত্র‘ শব্দটি ব্যাকরণসিদ্ধ নয়। এর ব্যাকরণগত ও শুদ্ধ-প্রয়োগ হবে দিনরাত্রি।
২৯. ‘ভাষা ও জাতি’-সমূহের বানান হ্রস্ব ই-কার : ভাষা ও জাতির নামের বানানে সাধারণত ‘হ্রস্ব ই-কার’ ব্যবহার করা হবে। যেমন বাঙালি/ বাঙ্গালি, জাপানি, ইংরেজি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, আরবি, ফারসি, গুজরাটি প্রভৃতি।
৩০. কারী ও কারি : ব্যক্তি বুঝালে ‘কারী’-যুক্ত শব্দের বানানে ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ হবে। যেমন সহকারী, আবেদনকারী, ছিনতাইকারী, পথচারী, কর্মচারী, অর্জনকারী প্রভৃতি। তবে, এমন ‘কারী’-যুক্ত শব্দ দিয়ে ব্যক্তি ছাড়া অন্য কিছু বুঝালে এ সব শব্দের ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ পরিবর্তন হয়ে ‘হ্রস্ব ই-কার’ হয়ে যাবে। যেমন সরকারি, দরকারি, জমিদারি প্রভৃতি।
৩১. বহুবচনবাচক পদ ও বানান পরিবর্তন : বাংলা প্রমিত বানানে শব্দের শেষে ‘ঈ-কার’ থাকলে বহুবচন-বাচক ‘গণ’- অনুপদযোগে গঠিত শব্দের ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ পরিবর্তন হয়ে ‘হ্রস্ব ই-কার’ হবে। যেমন
মন্ত্রী > মন্ত্রিবৃন্দ, সহকারী > সহকারিগণ, কর্মচারী > কর্মচারিগণ,
কর্মী > কর্মিগণ, আবেদনকারী > আবেদনকারিগণ, যাত্রী > যাত্রিগণ প্রভৃতি।
৩২. প্রত্যয়ান্ত হ্রস্ব ই-কার : ত্ব, তা, নী, ণী, সভা, পরিষদ, জগৎ, বিদ্যা, তত্ত্ব প্রভৃতি শব্দাণু কোনো শব্দের অন্তে যোগ হলে ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ পরিবর্তন হয়ে ‘হ্রস্ব ই-কার’ হয়ে যাবে। যেমন দায়িত্ব (দায়ী), প্রতিদ্বন্দ্বিতা (প্রতিদ্বন্দ্বী), প্রার্থিতা (প্রার্থী), দুঃখিনী (দুঃখী), অধিকারিণী (অধিকারী), সহযোগিতা (সহযোগী), মন্ত্রিত্ব (মন্ত্রী), মন্ত্রিসভা (মন্ত্রী), মন্ত্রিপরিষদ (মন্ত্রী), প্রাণিবিদ্যা (প্রাণী), প্রাণিতত্ত্ব (প্রাণী), প্রাণিজগৎ (প্রাণী), প্রাণিসম্পদ (প্রাণী), স্থায়িত্ব (স্থায়ী) প্রভৃতি।
৩৩. ঈ, ঈয়, অনীয় প্রত্যয়ের প্রভাব : ঈ, ঈয়, অনীয় প্রভৃতি প্রত্যয়-যুক্ত হলে শব্দের ‘হ্রস্ব ই-কার’ পরিবর্তন হয়ে ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ হয়। যেমন জাতীয় (জাতি), দেশীয় (দেশি), পানীয় (পানি), জলীয় (জল), স্থানীয় (স্থানিক), স্মরণীয় (স্মরণ), বরণীয় (বরণ), গোপনীয় (গোপন), ভারতীয় (ভারত)। তেমনি মাননীয়, বায়বীয়, প্রয়োজনীয়, পালনীয়, তুলনীয়, শোচনীয়, রাজকীয়, লক্ষণীয়, করণীয়, মার্জনীয় প্রভৃতি।
৩৪. খণ্ড-ৎ ও স্বরচিহ্ন : ‘খণ্ড-ৎ’-এর সঙ্গে স্বরচিহ্ন যুক্ত হলে ‘খণ্ড-ৎ’ পরিবর্তন হয়ে ‘ত’ হয়ে যাবে। যেমন জগৎ > জগতে জাগতিক,
বিদ্যুৎ > বিদ্যুতে বৈদ্যুতিক, ভবিষ্যৎ > ভবিষ্যতে, রং > রঙে,
আত্মসাৎ > আত্মসাতে, সাক্ষাৎ > সাক্ষাতে প্রভৃতি।
৩৫. ইক-প্রত্যয়ের প্রভাব : কোনো শব্দের সঙ্গে ‘-ইক’ প্রত্যয় যুক্ত হলে যদি সংশ্লিষ্ট শব্দের প্রথমে ‘অ-কার’ থাকে তা পরিবর্তন হয়ে ‘আ-কার’ হবে। যেমন অর্থ > আর্থিক, অঙ্গ > আঙ্গিক, বর্ষ > বার্ষিক, মন > মানসিক, পরস্পর > পারস্পরিক, সংস্কৃত > সাংস্কৃতিক, পরলোক > পারলৌকিক, প্রকৃত > প্রাকৃতিক, ধর্ম > ধার্মিক, প্রসঙ্গ > প্রাসঙ্গিক, সংসার > সাংসারিক, সপ্তাহ > সাপ্তাহিক, সময় > সাময়িক, সংবাদ > সাংবাদিক, প্রদেশ > প্রাদেশিক, সম্প্রদায় > সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি।
৩৬. হয়তো ও নয়তো : ‘হয়তো’ ও ‘নয়তো’ বাদে সব তো আলাদা হবে। যেমন ভালো আছো তো? ‘সে তো অনেক আগেই চলে গিয়েছে’ ইত্যাদি।
৩৭. /-এর (ঢ়ড়ংংবংংরাব/মবহরঃরাব পধংব)/ ব্যবহার : যে শব্দের বানানে শুধু একটা অক্ষর থাকে, সে শব্দের বানানে ‘-র/-এর’ যোগ করতে হলে ‘য়ের’ বাদ দিয়ে -র/-এর/- (ড্যাশ/হাইফেন বাদ দিয়ে) লেখা বিধেয়। যেমন কবি- > কবির (কবি-র/কবি-এর/কবিয়ের নয়), বাংলাদেশ- > বাংলাদেশের (বাংলাদেশ-এর নয়), দাদা- > দাদার (দাদা-র/দাদায়ের/ দাদা-এর নয়), নেপাল- > নেপালের (নেপাল-এর/নেপাল-র/নেপালয়ের নয়), আমেরিকা- > আমেরিকার (আমেরিকা-র বা আমেরিকা-এর নয়), স্কুল- > স্কুলের (স্কুল-এর/ স্কুল-র নয়) প্রভৃতি।
বানানে শুধু একটা অক্ষর থাকলে বা শব্দের শেষে দ্বিস্বর (আই, আয়, আউ, আও, ঐ, ঔ ইত্যাদি) থাকলে, -য়-এর (ড্যাশ/হাইফেনটা বাদ দিয়ে) লেখা বিধেয়। যেমন চা- > চায়ের (চা-এর/চা-র/চার নয়),
ধাই > ধাইয়ের (ধাইএর/ধাইর/ধাই-এর/ধাই-র নয়), মা- > মায়ের (মা-এর/মা-র/মার নয়), ভাই- > ভাইয়ের (ভাইএর/ভাইর/ভাই-এর/ভাই-র নয়), হৈচৈ- > হৈচৈয়ের (হৈচৈ-এর/হৈচৈএর/হৈচৈর/ হৈচৈ-র নয়); তেমনি বউয়ের, ছাইয়ের ইত্যাদি।
শব্দের শেষে ং/ঙ থাকলে, -ঙের (ড্যাশ/হাইফেনটা বাদ দিয়ে) লেখা বিধেয়। -ংয়ের লেখা শুদ্ধ হবে না। যেমন রং/রঙ – > রঙের (রং-এর/রঙ্গের/রংয়ের নয়), ব্যাঙ- > ব্যাঙের (ব্যাঙ-এর/ব্যাঙ্গের/ব্যাঙয়ের নয়), নার্সিং- > নার্সিঙের (নার্সিঙ-এর/নার্সিঙ্গের/নার্সিংয়ের নয়)।
৩৮. চলিত ভাষায় কোমলরূপ : সাধু থেকে চলিতরূপে পরিবর্তন করা হলে কিছু কিছু শব্দ কোমলরূপ ধারণ করে। যেমন আঙ্গিনা > আঙিনা, আঙ্গুল > আঙুল, ভাঙ্গা > ভাঙা, রাঙ্গা > রাঙা, রঙ্গিন > রঙিন,
বাঙ্গালি > বাঙালি, লাঙ্গল > লাঙল প্রভৃতি।
৩৯. শব্দের শেষে বিসর্গ বিধেয় নয় : শব্দের শেষের বিসর্গ উচ্চারিত হয় না, বরং উচ্চারণে বিঘ্ন ঘটায়। তাই আধুনিক বাংলা বানানে বিস্ময়সূচক শব্দ ছাড়া (আঃ উঃ) অন্ত্য-বিসর্গ বর্জিত। বাংলা ভাষায় মূলত বিস্ময়, আকস্মিকতা, তীব্র অনুভূতি প্রভৃতি প্রকাশে বিসর্গ (ঃ)-এর উচ্চারণ প্রকাশ পায়। যেমন আঃ (আহ্), উঃ (উহ্্), ওঃ (ওহ্্), ছিঃ (ছিহ্্), বাঃ (বাহ্্) প্রভৃতি। তাই প্রমিত বানানে পদের বানানের অন্তে বিসর্গ (ঃ) ব্যবহার হবে না। যেমন প্রথমত, অন্তত, অংশত, ইতস্তত, ক্রমশ, তৃতীয়ত, প্রায়শ, নভ, পয়, প্রধানত, বক্ষ, বস্তুত, গৌণত, তপ, বিশেষত, মুখ্যত, যশ, সাধারণত, প্রকাশ্যত, স্বত, স্বভাবত ইত্যাদি, ধর্মত, কার্যত, আইনত, ন্যায়ত, দৃশ্যত, করত, বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ, মূলত প্রভৃতি। তবে, বাংলা ব্যাকরণের রীতি অনুসারে পদমধ্যস্থ বিসর্গ অবিকৃত থাকবে। যেমন প্রাতঃকৃত, প্রাতঃক্রিয়া, প্রাতঃস্নান, প্রাতঃস্মরণীয়, বয়ঃক্রম, বয়ঃসন্ধি, বহিঃপ্রকাশ, বহিঃশুল্ক, বহিঃসমুদ্র, মনঃকষ্ট, মনঃক্ষুণ্ন, মনঃপীড়া, মনঃপুত, মনঃপ্রাণ, মনঃসংযোগ, মনঃসমীক্ষা, শিরঃপীড়া, স্বতঃপ্রবৃত্ত, স্বতঃপ্রণোদিত, স্বতঃসিদ্ধ, স্বতঃস্ফূর্ত, অতঃপর, অধঃপতন, অন্তঃকরণ, অন্তঃকোণ, অন্তঃক্রীড়া, অন্তঃপুর, অন্তঃরাষ্ট্রিক, অন্তঃসার, দুঃশাসন, দুঃসংবাদ, দুঃসময়, দুঃসহ, দুঃসাহস, দুঃস্বপ্ন, নিঃশঙ্ক, নিঃশব্দ, নিঃশর্ত, নিঃশেষ, নিঃসঙ্কোচ, নিঃসংশয়, নিঃসঙ্গ, নিঃসন্তান, নিঃসন্দেহ, নিঃসম্বল, নিঃসরণ, নিঃসহায়, নিঃসাড়, নিঃসীম, পয়ঃপ্রণালি, পুনঃপুন, পুনঃপ্রবেশ, পৌনঃপুনিক, প্রাতঃকাল।
৪০. তৃচ প্রত্যয়ান্ত তা-তৃ : তৃচ প্রত্যয়ান্ত শব্দ একবচনে ‘তা’-রূপ লাভ করে। যেমন নেতৃ হতে নেতা, ভ্রাতৃ হতে ভ্রাতা, শ্রোতৃ হতে শ্রোতা প্রভৃতি। তবে বহুবচনে শব্দগুলোর ‘তৃ-রূপ বহাল থাকবে। যেমন নেতা- নেতৃবৃন্দ, কর্মকর্তা- কর্মকতৃবৃন্দ, শ্রোতা- শ্রোতৃবৃন্দ, মাতা- মাতৃবৃন্দ, দাতা- দাতৃবৃন্দ, ভ্রাতা- ভ্রাতৃবৃন্দ প্রভৃতি।