৪১. অবিকৃত ও বিকৃত ‘এ’ : বাংলায় ‘এ’ বা ‘এ-কার’ দ্বারা অবিকৃত ‘এ’ এবং বিকৃত বা ‘বাঁকা অ্যা’ উভয় উচ্চারণ বা ধ্বনি নিষ্পন্ন হয়। তৎসম বা সংস্কৃত ব্যাস, ব্যায়াম, ব্যাহত, জ্যামিতি প্রভৃতি শব্দের বানান অনুরূপভাবে লেখা বিধেয়। তৎসম এবং বিদেশি শব্দ ছাড়া অন্য সব বানানে অবিকৃত-বিকৃত নির্বিশেষে ‘এ’ বা ‘এ-কার’ হবে। যেমন দেখে, যেন, কেন, গেল, গেছে প্রভৃতি। বিদেশি শব্দে অবিকৃত উচ্চারণের ক্ষেত্রে ‘এ’ বা ‘এ-কার’ ব্যবহৃত হবে। যেমন এন্ড (ঊহফ), নেট (ঘবঃ), বেড (ইবফ)। বিদেশি শব্দে বিকৃত বা বাঁকা উচ্চারণে ‘অ্যা’ বা ‘্যা’ ব্যবহৃত হবে। যেমন অ্যান্ড (অহফ), অ্যাডভোকেট (অফাড়পধঃব), অ্যাসিড, ম্যাচ, প্যাঁচ, হ্যাট, ব্যাক। তবে এমন কিছু তদ্ভব, বিশেষভাবে দেশি শব্দ রয়েছে যার ‘্যা’ কারযুক্ত-রূপ বহুল প্রচলিত। যেমন ব্যাঙ, চ্যাঙ, ল্যাঙ, ল্যাঠা, জ্যাঠা এসব শব্দে ‘্যা’ অপরিবর্তিত থাকবে।
৪২. ত্ব-প্রত্যয়যুক্ত শব্দের মধ্যাংশ : ‘ত্ব’ প্রত্যয়যুক্ত শব্দের মধ্যাংশে ই-কার হবে। যেমন একাকী > একাকিত্ব, দায়ী > দায়িত্ব, সখী > সখিত্ব, মন্ত্রী > মন্ত্রিত্ব প্রভৃতি।
৪৩. প্রায়, প্রধান, বহুল, বিশেষ : ‘প্রায়, প্রধান, বহুল, বিশেষ, অনেক, কয়েক, কিছু, নানা, নানান, বহু, বিচিত্র, বিভিন্ন, সব, সারা, হরেক’ ইত্যাদি শব্দ সম্পর্কযুক্ত শব্দ হতে ফাঁক রেখে বসে। যেমন প্রায় প্রতিদিন, প্রায় স্থানে, প্রধান ডাকঘর, বহুল প্রচলিত, বহুল আলোচিত, বিশেষ বাহক, বিশেষ ঘটনা, অনেক বছর, কয়েক দিন, কিছু গান, নানা মত, নানান রং, বহু দেশ, বিচিত্র পাখি, বিভিন্ন জাতি, সব কথা, সারা দেশ, হরেক রকম। তবে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন নানারূপ, নানাবিধ, বহুকাল, বহুক্ষণ, সবকিছু, সারাক্ষণ, কয়েকজন, অনেকক্ষণ, কিছুকাল, অনেকজন, সবশেষে ইত্যাদি।
৪৪. একাধিক বানানসিদ্ধে করণীয় : সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী কোনো তৎসম শব্দে ‘হ্রস্ব বা দীর্ঘ’ উভয় স্বরের ব্যবহার শুদ্ধ বলে গণ্য হলে প্রমিত বানানে সে সব শব্দে শুধু ‘হ্রস্ব-স্বর’ ব্যবহার করা হবে; ‘দীর্ঘ-স্বর’ নয়। যেমন ভঙ্গী নয়, ভঙ্গি; শ্রেণী নয়, শ্রেণি; সূচী নয়, সূচি; ঊষা নয়, উষা; ঊর্বর নয়, উর্বর; অন্তরীক্ষ নয়, অন্তরিক্ষ; ঊনিশ নয়, উনিশ প্রভৃতি।
৪৫. তৎসম স্ত্রীবাচক শব্দ : তৎসম শব্দে স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ‘দীর্ঘ ঈ-কার বসে। যেমন কল্যাণী, কিশোরী, নর্তকী, সুন্দরী, তরুণী প্রভৃতি।
৪৬. ব্যক্তি বা পুরুষ প্রকাশে তৎসম শব্দে দীর্ঘ ঈ-কার : ব্যক্তি বা পুরুষ প্রকাশ করলে তৎসম শব্দের শেষে ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ বসবে। যেমন অপরাধী, দোষী, বিরহী, মানবী, ত্যাগী, প্রণয়ী, বিদেহী, সঞ্চয়ী, সাহসী, সন্ন্যাসী প্রভৃতি।
৪৭. ফাঁক রাখে বহুদল : টা, টি, টে, টো, খান, খানা, খানি, টুকু, গুলি, গুলো, রা, এরা, আবলি, কুল, গণ, গুচ্ছ, চয়, দল (বহুবচন অর্থে), পুঞ্জ, বর্গ, বৃন্দ, মণ্ডলী, রাজি, রাশি, মালা, সকল, সমুচ্চয়, সমূহ প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে। কখনো পৃথক বসে না। যেমন আমটি, দশখানা, আমগুলো, মেঘমালা, গল্পসমূচ্চয়, গ্রন্থসমূহ ইত্যাদি। তবে খান, সমূহ, সকল ইত্যাদি শব্দের শুরুতে বসলে কখনো একসঙ্গে সেঁটে বসে না। যেমন খান বিশেক, সমূহ বিপদ, সকল শিক্ষক প্রভৃতি।
৪৮. আ-কার লোপ-কাহিনি : ‘আ-কার’ নিয়ে বানান-সমস্যা ব্যবহারগত বিবেচনায় জটিল না-হলেও ক্ষেত্রবিশেষে ‘আ-কার’ কখনো কখনো মহা ঝামেলার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিছু বিশেষ্যপদ বিশেষণে পরিণত হওয়ার সময় ‘আ-কার’ ছেড়ে দেয়। মনে হয় যেন ভুলবশত আ-কার বাদ পড়েছে। অতিপরিচিত ও চেনা শব্দে ‘আ-কার’ বিলুপ্তির বিষয়টি অনেককে দ্বিধায় ফেলে দেয়। ফলে ‘আ-কার’-যুক্ত শব্দে এরূপ ‘আ-কার’-চ্যুতির ঘটনা বানানে ভুলের অবতারণা ঘটায়।
যেমন যথেচ্ছা, চেতনা, প্রতিজ্ঞা প্রভৃতি বিশেষ্য পদ বিশেষণে পরিবর্তন করলে যথাক্রমে যথেচ্ছ, চেতন, প্রতিজ্ঞ হয়ে যায়। এরূপ আরও কিছু শব্দের উদাহরণ দেওয়া হলো : আকাক্সক্ষা > আকাক্সক্ষ, দূরাকাক্সক্ষা > দূরাকাক্সক্ষ, আশা > আশ, হতাশা > হতাশ, ইচ্ছা > ইচ্ছ, যথেচ্ছা > যথেচ্ছ, কুণ্ঠা > কুণ্ঠ, ব্যয়কুণ্ঠা > ব্যয়কুণ্ঠ, চেতনা > চেতন, পরিবেশচেতনা > পরিবেশচেতন, চেষ্টা > চেষ্ট, সচেষ্টা > সচেষ্ট,
দয়া > দয়, সদয়া > সদয়, নিদ্রা > নিদ্র, বিনিদ্রা > বিনিদ্র,
প্রতিজ্ঞা > প্রতিজ্ঞ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা > দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, বাধা > বাধ,
অবাধা > অবাধ, বিদ্যা > বিদ্য, কৃতবিদ্যা > কৃতবিদ্য, ভাষা > ভাষ, মিতভাষা > মিতভাষ, রেখা > রেখ, নিম্নরেখা > নিম্নরেখ, লজ্জা > লজ্জ, সলজ্জা > সলজ্জ, লীলা > লীল, সলীলা (ভঙ্গি) > সলীল, শ্রদ্ধা > শ্রদ্ধ, সশ্রদ্ধা > সশ্রদ্ধ, সংখ্যা > সংখ্য, অসংখ্যা > অসংখ্য প্রভৃতি।
৪৯. বাংলা ভাষায় চন্দ্রবিন্দু একটি গুরুত্বপূর্ণ বর্ণ। চন্দ্রবিন্দু যোগে গঠিত শব্দগুলোতে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করতে হবে; না-করলে ভুল হবে। অনেক ক্ষেত্রে চন্দ্রবিন্দু বাদ দিলে শব্দার্থের পরিবর্তন ঘটে। এ ছাড়া চন্দ্রবিন্দু সম্মানসূচক বর্ণ হিসাবেও ব্যবহার করা হয়। যেমন তাহাকে > তাঁহাকে, তাকে > তাঁকে ইত্যাদি। বাংলা বানানে অধিকাংশ চন্দ্রবিন্দু আসে সংস্কৃত বানানের ঙ, ঞ, ণ, ন, ম এবং ং লোপের ফলে, অর্থাৎ তৎসম বানানের নাসিক্য ধ্বনি তদ্ভব শব্দে চন্দ্রবিন্দু রূপ লাভ করে। এই ঘটনাকে বলা হয় নাসিক্যভবন। যেমন
ঙ : পঙ্ক > পাঁক, অঙ্কন > আঁকা, কঙ্কন > কাঁকন, শঙ্খ > শাঁখ,
বঙ্কিম > বাঁকা, পঙক্তি > পাঁতি;
ঞ : পঞ্চ > পাঁচ, অঞ্চল > আঁচল, অঞ্জলি > আঁজলা;
ণ : ভাণ্ডার > ভাঁড়ার, ভাণ্ড > ভাঁড়, কণ্টক > কাঁটা, ষণ্ড > ষাঁড়,
শুণ্ড > শুঁড়, পলাণ্ডু > পেঁয়াজ, হণ্টন > হাঁটা, চণ্ডাল > চাঁড়াল;
ই : স্কন্ধ > কাঁধ, দন্ত > দাঁত, সন্তরণ > সাঁতার, বান্দর > বাঁদর,
বন্ধন > বাঁধন, ছন্দ > ছাঁদ, চন্দ্র > চাঁদ, গ্রন্থনা > গাঁথা,
বৃন্ত > বোঁটা, সন্ধ্যা > সাঁঝ, অন্ধকার > আঁধার, ক্রন্দন > কাঁদা;
এ : ধূম > ধোঁয়া, আমিষ > আঁষ, কম্পন > কাঁপা, ঝম্প > ঝাঁপ, চম্পক > চাঁপা, গ্রাম > গাঁ, সমর্পণ > সঁপা, গুম্ফ > গোঁফ;
অন্স্বুার (ং) : বংশী > বাঁশি, সংক্রম > সাঁকো, হংস > হাঁস,
বংশ > বাঁশ;
তবে, নাসিক্যধ্বনি বিলুপ্ত না হলে চন্দ্রবিন্দু হয় না। যেমন
ঘৃণা > ঘেন্না, রত্ন > রতন, মাণিক্য > মানিক, শাল্মলী > শিমুল,
গঙ্গা > গাঙ, বন্য > বুনো, মনুষ্য > মানুষ, বান্দর > বানর, যত্ন > যতন, স্বর্ণ > সোনা, কর্ণ > কান, রন্ধন > রান্না, লাঙ্গল > লাঙল, জন্ম > জনম, হাঙ্গর > হাঙর, ব্রাহ্মণ > বামুন প্রভৃতি।
ব্যতিক্রম : কখনো দেখা যায় নাসিক্যধ্বনি বিলুপ্ত হলেও চন্দ্রবিন্দু হয় না। যেমন কঙ্ক > কাক, টঙ্কা > টাকা, কর্দম > কাদা, কৃপণ > কিপটে, লম্ফ > লাফ, ঝঞ্ঝা > ঝড়, কৃষ্ণ > কালো, শৃঙ্খল > শিকল প্রভৃতি।
৫০. হস্ চিহ্ন বর্জন : আধুনিক বাংলা বানানে হস্-চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন কাত, মদ, চট, কলকল, তছনছ, চেক, ডিশ, টাক, টক। ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা থাকলে হস্ চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন হস্, আহ্, উহ্ ইত্যাদি। যদি অর্থ-বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে তা হলে তুচ্ছ অনুজ্ঞায় হস্ চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন র্ক, ধর, র্ম, বল্ প্রভৃতি। তবে কিছু কিছু শব্দে হসন্ত দিতে হবে, নইলে ভুল হবে। যেমন উদ্ঘাটন, উদ্বেগ, উদ্ভ্রান্ত, উদ্যাপন, দিক্পাল, দিক্ভ্রম, দিক্ভ্রষ্ট, দিগ্দর্শন, প্রাক্-কথন, বাক্-সর্বস্ব, বাগ্বিতণ্ডা, বাগ্দেবী।
৫১. মাত্র শব্দের অবস্থান : ‘মাত্র’ শব্দে ‘প্রত্যেক’, ‘শুধু’, ‘পর্যন্ত’, ‘তখনই’ প্রভৃতি অর্থ বুঝালে এটি এর পূর্ববর্তী শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বসবে। যেমন আসামাত্র, এইমাত্র, একমাত্র, প্রাণীমাত্র, বলামাত্র প্রভৃতি। তবে ‘মাত্র’ শব্দ যদি কোনো শব্দের পূর্বে বসে তবে তা পৃথক বসবে। যেমন সে আমাকে মাত্র দশ টাকা দিয়েছে। সে মাত্র কটা টাকা চেয়েছে প্রভৃতি।
৫২. ওই/ঐ : তৎসম শব্দ ছাড়া অন্যান্য শব্দের ক্ষেত্রে ‘ঐ’ না-লিখে ‘ওই’ লেখা সমীচীন। যেমন ‘ঐ তো সে পাখিটি’ না-লিখে; লেখা উচিত ‘ওই তো সে পাখিটি’।
৫৩. ‘সমাপিকা’ ও ‘অসমাপিকা’ ক্রিয়া : ‘উ’ ও ‘ও’ এর একটি প্রসঙ্গ : উঠে/ওঠে? উপরে/ওপরে, উঠা/ওঠা, বুঝে/বোঝে, শুনে/শোনে, ফুটে/ ফোটে; কোনটি হবে?
সাধারণ সূত্র হচ্ছে, বাংলায় সমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ক্রিয়াপদের আদ্যস্বরের উচ্চারণ বিবৃত হবে। অসমাপিকা ক্রিয়ায় ক্ষেত্রে হবে সংবৃত। যেমন ১. ছেলেটি টিভি দেখে। এ বাক্যে ‘দেখে’ সমাপিকা ক্রিয়া। অর্থাৎ ‘দেখে’ পদটি দিয়ে বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ হয়েছে।
২. ছেলেটি টিভি দেখে ঘুমাবে। এ বাক্যে ‘ঘুমাবে’ সমাপিকা ক্রিয়া; ‘দেখে’ অসমাপিকা ক্রিয়া। কারণ, ‘ঘুমাবে’ পদটি দিয়ে অর্থ সম্পূর্ণ হয়েছে। ৩. ছেলেটি টিভি দেখে খাবার খেয়ে বই পড়ে ঘুমাবে। এ বাক্যে ক্রিয়াপদ ৪টি ‘দেখে’, ‘খেয়ে’, ‘পড়ে’, ‘ঘুমাবে’। কিন্তু সমাপিকা ক্রিয়া একটিই ‘ঘুমাবে’। অর্থাৎ ‘ঘুমাবে’ না বলা পর্যন্ত বাক্য সম্পূর্ণ হচ্ছিল না। বাকি ৩টি ক্রিয়াপদ অসমাপিকা ক্রিয়া।
প্রথম বাক্যে ‘দেখে’ যেহেতু সমাপিকা ক্রিয়া, তাই এর আদ্যস্বরের উচ্চারণ হবে বিবৃত। যেমন [দ্যাখে]। কিন্তু, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাক্যে ‘দেখে’ যেহেতু অসমাপিকা ক্রিয়া, তাই এর আদ্যস্বরের উচ্চারণ হবে সংবৃত। যেমন [দেখে]।
ক্রিয়া পদের শুরুতে কখন ‘উ’ আর কখন ‘ও’ হবে।
ওপরের আলোচনার সূত্র ধরে বলা যায়, অসমাপিকা ক্রিয়ার শুরুতে ‘উ’ (সংবৃত); এবং সমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ‘ও’ (বিবৃত) হবে। আরও দুটি বাক্য দেখুন : ৪. আকাশে পাখি ওড়ে। ৫. পাখিটা উড়ে গেল। এখানে চতুর্থ বাক্যে ‘ওড়ে’ সমাপিকা ক্রিয়া, তাই ‘ও’ হয়েছে। পঞ্চম বাক্যে ‘উড়ে’ অসমাপিকা ক্রিয়া, তাই ‘উ হয়েছে। পঞ্চম বাক্যে সমাপিকা ক্রিয়া হচ্ছে ‘গেল’।