ড. মোহাম্মদ আমীন
আমি বললাম, আমার কোনো দেশ্ নেই, আপনাদেরও কোনো দেশ্ থাকা উচিত নয়। দেশ্ খুব খারাপ জিনিস। যার দেশ্ আছে সে জানোয়ার তুল্য। আমি দেশ্কে প্রচণ্ড ঘৃণা করি, আপনারাও আপনাদের দেশ্কে ঘৃণা করুন। দেশ্কে পরিত্যাগ না-করা পর্যন্ত দেশ্* মর্যাদাসম্পন্ন হবে না।আমার কথার সঙ্গে আপনারা কি একমত?
শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই বললেন, না।
সুসানা আর ফাউজিয়া আমার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বললেন, যার দেশ্ আছে প্রকৃত অর্থে সে কোনো মানুষই নয়।
২.
দেশ্ শব্দের অর্থো কি? (উচ্চারণ-নির্দেশক লেখা)
দুজন ছাড়া সবাই বললেন, country.
ইসরাইলি সুসানা ও ইসরাইলি ফাউজিয়া রেহমান বললেন, envy.
আমি আসলে দেশ্ হিসেবে উচ্চারিত বাংলা শব্দের (দ্বেষ) দ্বিতীয় অর্থটাই জানতে চেয়েছিলাম, তবু বাকিদের উত্তর প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হলো না। কেননা, বাংলায় ‘দেশ্’ দুটি; একটির বানান ‘দ্বেষ’ এবং অন্যটির বানান ‘দেশ’। দুটোর উচ্চারণই ‘দেশ্’। উচ্চারণ অভিন্ন হলেও বানান এবং অর্থ ভিন্ন। দেশ এর বিপরীত ‘বিদেশ’ এবং ‘দ্বেষ’ এর সমার্থক ‘বিদ্বেষ’।
কখন দ্বেষ এবং কখন বিদ্বেষ?
বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত দ্বেষ (√দ্বিষ্+অ) শব্দের অর্থ- ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, বৈরীভাব, বিরাগ প্রভৃতি। অন্যদিকে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত বিদ্বেষ (বি+√দ্বিষ্ +অ) শব্দের অর্থ- ঈর্ষা, বৈরিতা, শত্রুতা প্রভৃতি।
অর্থ থেকে বোঝা যায়, উভয় (দ্বেষ ও বিদ্বেষ) শব্দ সমার্থক; কিন্তু সর্বক্ষেত্রে সমপ্রায়োগিক নয়। একশব্দ আর ভিন্নার্থক শব্দের পার্থক্য রয়েছে। একই রকম চেহারার একাধিক ব্যক্তি কখনও ব্যক্তি হিসেবে অভিন্ন হতে পারে না, কিছু কিছু পার্থক্য থাকেই। না-থাকলে তারা অভিন্ন মানুষই হয়ে যেত। শব্দের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। কেবল সমার্থক হলে একাধিক শব্দ অভিন্নভাবে প্রয়োগ করা যাবে- তা ঠিক নয়। অতএব, সমার্থক শব্দ হলেই কেবল একটি শব্দ অভিন্নার্থে সকল বাক্যে প্রয়োগ করা যাবে- তা ঠিক নয় এবং একই সঙ্গে সমীচীনও নয়।
৩
অর্থ অভিন্ন হলেও বাংলায় এমন কিছু শব্দ আছে যেগুলো খুব হিসেব করে অন্য শব্দের পাশে বসে। মনে হয় যেন যার-তার পাশে বসলে জাত যায়। ‘বাঘ’ ও ‘শার্দুল’ একই অর্থ বহন করে; তবু ‘বাঘের বাচ্চা’ হয় কিন্তু ‘শার্দুলের বাচ্চা’ হয় না। বলতে হয় শার্দুলশাবক।‘মড়া’ ও ‘শব’ অভিন্ন অর্থ-দ্যোতক। তারপরও ‘মড়া-পোড়ানো’ বলা যায় কিন্তু ‘শবপড়ানো’ বলা যায় না; বলতে হয়ে শবদাহ।
তেমনি বলা যায় না মড়াদাহ। এমন আরও কিছু উদাহরণ:
বাঘের বাচ্চা কিন্তু শার্দুলশাবক, কুকুরের বাচ্চা কিন্তু সারমেয়শাবক, সাদাকাপড় কিন্তু শ্বেতবস্ত্র, ফুলের তোড়া কিন্তু পুস্পস্তবক, মড়া-পড়ানো কিন্তু শবদাহ, খবরের কাগজ কিন্তু সংবাদপত্র, সাগরপাড়ি কিন্তু সমুদ্রযাত্রা, লালরঙ কিন্তু লোহিতবর্ণ, কালোরঙ কিন্তু কৃষ্ণবর্ণ, বিয়েবাড়ি কিন্তু বিবাহবাসর, ফুলের বাগান কিন্তু পুষ্পোদ্যান, শুয়োরের বাচ্চা কিন্তু বরাহশাবক। জলপ্রপাত, জলযোগ, জলখাবার হয় কিন্তু পানিপ্রপাত, পানিযোগ ও পানিখাবার হয় না।
কিন্তু কেন? অন্যতম কারণ হচ্ছে, দীর্ঘকাল থেকে ব্যবহার।
তাহলে, কখন দ্বেষ এবং কখন বিদ্বেষ শব্দ ব্যবহৃত হয়? কবি সাহিত্যিক কিংবা সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক লেখায় কিংবা বলায় ‘দ্বেষ’ শব্দটি খুব একটা দেখা যায় না, যতটা দেখা যায় বিদ্বেষ।
কিন্তু কেন?
৪
এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, ‘দেশ’ আর ‘দ্বেষ’ সমোচ্চারিত। ‘দ্বেষ’ শব্দের প্রমিত উচ্চারণ ‘দেশ’, যা অবিকল ‘দেশ’ শব্দের উচ্চারণের মতো। দেশ প্রিয় অভিব্যক্তি, কিন্তু দেশ ঘৃণার। উচ্চারণগত অবিকলতার কারণে গিয়ে মৌখিক ভাষ্যে ‘দ্বেষ’ বলতে ‘দেশ’, আবার ‘দেশ’ বলতে ‘দ্বেষ’ হয়ে যেতে পারে। তাই বাংলায় প্রথম থেকে ‘দ্বেষ’ শব্দটির একক ব্যবহার কম ছিল। অধিকন্তু, ‘দেশ’ এর সঙ্গে ‘দ্বেষ’ থাকতে পারে না, কিন্তু বিদেশ-এর সঙ্গে ‘বিদ্বেষ’ থাকতেই পারে। তাই, দ্বেষ শব্দটি সাধারণত কম ব্যবহৃত হয়। তবে দিত্ব শব্দ হিসেবে বিদ্বেষ বা অন্য শব্দের সঙ্গে দ্বেষ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেমন :
“কেন এ হিংসা দ্বেষ, কেন এ ছদ্মবেশ, কেন এ মান অভিমান …।”
শ্রুতু ঐহিক এবং পারত্রিক বিষয়সমূহে রাগ দ্বেষ সত্ত্বে কদাপি তত্ত্ব জ্ঞানাধিকার হইতে পারে না .। (আত্মবোধ)
দ্বেষ-বিদ্বেষ শেষ করে দিল, মানুষের মহিমা।
দ্বেষ আছে যার, সে একটা জানোয়ার।
‘দ্বেষ’ শব্দের একক ব্যবহার করা যায়, তবে কেউ খুব একটা করে বলে মনে হয় না। আমি কখনও একভাবে ‘দ্বেষ’ শব্দটা ব্যবহার করেছি– এমন মনে পড়ে না। এটি ব্যবহার করা আবশ্যক হলে ‘বিদ্বেষ’ বা সমার্থক অন্য কোনো যুতসই শব্দ ব্যবহার করি।
আমার বলা প্রথম বাক্যে স্টারযুক্ত ‘দেশ’ শব্দটির অর্থ country বাকি দেশ্-সমূহের অর্থ envy.