অণু পরমাণু অ্যাংস্ট্রম ইলেকট্রন প্রোটন নিউটন : একনজরে অণু-পরমাণু
ড. মোহাম্মদ আমীন
অণু (Atom)
অণু কোনো পদার্থের এমন একটি ক্ষুদ্র্রতম একক যাতে ওই পদার্থের সকল গুণাবলি বিদ্যমান থাকে। অণুর গঠনে রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ যুক্ত দুই বা ততোধিক তড়িৎ-নিরপেক্ষ পরমাণু থাকে। দুই বা ততোধিক পরমাণু বা অণু যুক্ত হয়ে অণু গঠন করে। যেমন : অক্সিজেনের অণু: O2 , জলের অণু: H20অণুতে পরমাণুদি পরস্পর আয়নিক অথবা সমযোজী বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত থাকে। ম্যারিয়াম ওয়েবস্টার এবং অনলাইন এটিমোলজি ডিকশনারি অনুসারে অণুর ইংরেজি প্রতিশব্দ মলিক্যুল শব্দটি থেকে এসেছে। লাতিন শব্দ মোল থেকে যার অর্থ ভরের ক্ষুদ্র। অণুর চেয়ে ক্ষুদ্র কণাকে নাম দেয়া হয় পরম অণু বা পরমাণু। পরমানু বা এটমের থেকে ক্ষুদ্র কণা ইলেকট্রন, প্রোটন,নিউট্রন আবিষ্কৃত হয়েছে। ব্রিটিশ স্কুল শিক্ষক বিজ্ঞানী জন ডালটন সর্বপ্রথম অণু সম্পর্কে ধারণা দেন। অণু দুই প্রকার। যথা : ১.মৌল বা মৌলিক অণু ২.যৌগ বা যৌগিক অণু।
মৌলিক অণু ও যৌগিক অণু
একই মৌলের দুই বা ততোধিক পরমাণু একত্রে যুক্ত হয়ে যে অণু গঠন করে তাকে বলে মৌল বা মৌলিক অণু। দুই বা ততোধিক মৌলিক পরমাণু একত্রে যুক্ত হয়ে যে অণু গঠন করে তাকে বলে যৌগ বা যৌগিক অণু।
অণুর আকৃতি
অধিকাংশ অণু অতিক্ষুদ্র, খালি চোখে দেখা যায় না। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য আছে; যেমন পলিমার। অণুর আকৃতি কয়েক এংস্ট্রম থেকে কয়েক ডজন এংস্ট্রম হতে পারে। বড়ো অণুকে রসায়নের ভাষায় বলা হয় ম্যাক্রো মলিক্যুল বা সুপার মলিক্যুল। দ্রবনের কার্যকর আণবিক ব্যাসার্ধই হচ্ছে অণুর আকৃতি।
ক্ষুদ্রতম ও বৃহত্তম অণু
দ্বি আণবিক হাইড্রোজেন হচ্ছে সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির অনু (H2), এর বন্ধন দূরত্ব ০.৭৪ Å. সবথেকে বৃহত্তম অনু মেসোপোরাস সিলিকার ব্যাস ১০০০ এংস্ট্রম। ( ১০০০ Å) (১০০nm)।
অ্যাংস্ট্রম
অ্যাংস্ট্রম একক ব্যবহার করে অণু-পরমাণুর আকার, বন্ধন দৈর্ঘ্য ইত্যাদি প্রকাশ করা হয়। এক অ্যাংস্ট্রম হলো, এক সেন্টিমিটারের দশ কোটি ভাগের এক ভাগ। যেমন, কার্বন-কার্বন( C—C) একক বন্ধনের দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৫৩ অ্যাংস্ট্রম। লেখার জন্য Å দিয়ে, এককটি প্রকাশ করা হয়। সুইডিশ পদার্থবিদ এন্ডার ইয়োনাস অ্যাংস্ট্রম (Anders Jonas Ångström)এই এককটির উদ্ভাবক। সুইডিশদের বর্ণমালায় Å হলো একটি বর্ণ, এর উচ্চারণ ইংরেজী O-এর মতো। সুইডেনের উপসলা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিজ্ঞানীর নামে রয়েছে একটি সুবিশাল ল্যাবরেটরি যেটি Ångströmlaboratoriet নামে পরিচিত।
পারমাণবিক সংখ্যানুসারে পর্যায় সারণী
১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক সংখ্যার ক্রমানুসারে মৌলসমূহকে পর্যায় সারণীতে সজ্জিত করা হয়। এক বছরের মধ্যে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত বাহাত্তরটি মৌলের সন্ধান মেলে এবং কৃত্রিমভাবেও বেশ কিছু মৌল তৈরী করা হয়। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ১০১তম মৌলটি আবিষ্কৃত হয় এবং পর্যায় সারণী তৈরীতে দিমিত্রি মেন্দেলিভের অবদানের জন্য তার নামানুসারে মৌলটির নাম রাখা হয় মেন্দেলিভিয়াম।
প্রাচীন মৌল
কার্বন, তামা, সোনা, রূপা, লোহা, গন্ধক, সীসা, পারদ, টিন ও দস্তা এই দশটি মৌলের ব্যবহার চলে আসছে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আরও তিনটি পদার্থ, আর্সেনিক, অ্যান্টিমনি ও বিসমাথ প্রভৃতিকে মৌল হিসাবে সনাক্ত করা হয়। ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আবিষ্কৃত হয় ফসফরাস, কোবাল্ট ও প্লাটিনাম। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আবিষ্কৃত হয় মৌলিক গ্যাসসমূহ (হাইড্রোজেন, আক্সিজেন, হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন), হ্যালোজেনসমূহ (ফ্লোরিন, ক্লোরিন, ব্রোমিন ও আয়োডিন), কিছু তেজষ্ক্রিয় মৌল (ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, রেডিয়াম ও রেডন), কিছু বিরল মৃত্তিকা মৌল (সেরিয়াম, নিওডাইমিয়াম, ল্যান্থানাম ইত্যাদি), লিথিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, ক্রোমিয়াম, নিকেল, টাংস্টেন ইত্যাদি।
আধুনিক ও সর্বশেষ মৌল
১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের পর আবিষ্কৃত হয় ফ্রান্সিয়াম, প্লুটোনিয়াম, নেপচুনিয়াম, হাফনিয়াম, অ্যাস্টেটিন ইত্যাদি। একবিংশ শতকে কৃত্রিমভাবে অনেকগুলো মৌল তৈরী হয়েছে। যেমন, ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে রাশিয়ায় তৈরী হয়েছে ১১৮তম মৌল, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে তৈরী হয়েছে ১১২তম মৌল যা ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে কোপারনিসিয়াম নামে স্বীকৃতি পায়, ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে ১১৪ ও ১১৬তম মৌলদ্বয় আবিষ্কৃত হয় এবং ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে তাদের যথাক্রমে ফ্লেরোভিয়াম ও লিভারমোরিয়াম নামে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে ১১৩, ১১৫, ১১৭ ও ১১৮তম মৌলগুলোকে চিহ্নিত করা হয়, যদিও এগুলো এখনও অনুমোদিত নয়।
পরমাণু
রাসায়নিক মৌলের ক্ষুদ্রতম অংশ যার স্বাধীন অস্তিত্ব নেই (নিস্ক্রিয় গ্যাসের পরমাণু ব্যতীত), কিন্তু রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সরাসরি অংশ গ্রহণ করতে পারে সেসব আণুবীক্ষণিক কণিকাই পরমাণু। পরমাণুর আকার খুবই ক্ষুদ্র; সাধারণত এরা দৈর্ঘ্যে ১০০ পিকোমিটার (১ মিটারের ১০,০০০,০০০,০০০ ভাগ বা চুলের ১ লাখ ভাগের ১ ভাগ)। কোনো পদার্থের পারমানবিক সংখ্যা হলো পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা।
কণাদ এবং অণু
ভারতীয় দার্শনিক কণাদ খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দে পরমাণুর ধারণা দেন । তিনিই প্রথম বলেন, সকল পদার্থই ক্ষুদ্র এবং অবিভাজ্য কণিকা দিয়ে তৈরী। গ্রিক দার্শনিক মিলেতুসের লেউকিপ্পুস (খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতক)-এর বিখ্যাত শিষ্য আবদেরার ডেমোক্রিটাস খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দে পদার্থ যেসব অতিক্ষুদ্র অবিভাজ্য কণা দিয়ে গঠিত তার নাম দেন এটমস'(Atomos) যার আভিধানিক অর্থ “অবিভাজ্য”(indivisible)।
পরমাণুর গঠন
পরমাণুর তিনটি উপাদান রয়েছে। যেসব কণিকা দিয়ে পরমাণু গঠিত, তাদের মৌলিক কণিকা বলে। এগুলো হচ্ছে ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন। এ তিনটি কণিকা বিভিন্ন সংখ্যায় একত্রিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু গঠন করে। ধনাত্মক আধানযুক্ত প্রোটন এবং আধানহীন নিউট্রন একত্রিত হয়ে নিউক্লিয়াস গঠন করে; এদের ঘিরে ঋণাত্মক আধানের ইলেকট্রন আবর্তিত হয়।
ইলেকট্রন
পরমাণুর ক্ষুদ্রতম কণিকা ইলেকট্রন। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে স্যার জে জে থমসন সর্বপ্রথম ইলেকট্রনের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। ইলেকট্রনকে সাধারণত ব প্রতীক দ্বারা প্রকাশ করা হয়। একটি ইলেকট্রনের ভর ৯.১০৮৫×১০–২৮g এবং আধান -১.৬×১০–১৯ কুলম্ব। ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুর্ণয়মান।
প্রোটন
প্রোটন হচ্ছে নিউক্লিয়াসে বিদ্যমান ধণাত্মক আধান বিশিষ্ট কণিকা। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড প্রোটনের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। একটি পরমাণুতে ইলেকট্রনের সমান সংখ্যক প্রোটন থাকে। প্রোটনের ভর ১.৬৭৩X১০–২৮g যা পারমাণবিক ভর স্কেল অনুসারে ১.০০৭২৭৬ amu। এখানে amu মানে atomic mass unit। একটি হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে একটি ইলেকট্রন সরিয়ে নিলেই প্রোটন পাওয়া যায় তাই একে H+ বলা যেতে পারে। একে সাধারণত p দ্বারা প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
নিউট্রন / পারমাণবিক ভর
নিউট্রন হচ্ছে আধানবিহীন মৌলিক কণিকা। আধানবিহীন( neutral) হওয়ায় এর এই নাম দেওয়া হয়েছে। নিউট্রন, নিউক্লিয়াসের মধ্যে অবস্থান করে। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে জেমস স্যাডউইক নিউট্রন আবিষ্কার করেন।
এর আসল ভর ১.৬৭৫X১০–২৪g যা পারমাণববিক ভর স্কেল অনুসারে ১.০০৮৬৬৫ amu। এর ভর ইলেকট্রনের ভরের প্রায় ১৮৩৭ গুণের সমান। একে সাধারণত n দ্বারা প্রকাশ করা হয়। নিউট্রন পরমাণুর কেন্দ্রে প্রোটনের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই দুই কণিকার সম্মিলিত ভরকে পারমাণবিক ভর বলা হয়ে থাকে। ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী স্যার জেমস চ্যাডউইক (২০ অক্টোবর ১৮৯১Ñ২৪ জুলাই ১৯৭৪) ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে নিউট্রন আবিষ্কার করেন এবং এই অবদানের জন্য তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
দৈনন্দিন বিজ্ঞান : অক্সিজেন আলো আলোর বেগ রঙ আলোর পথ ও আলোর নীতি
দৈনন্দিন বিজ্ঞান : উড়োজাহাজ, রাইট ভ্রাতৃদ্বয় উড়োজাহাজের আবিষ্কার : একনজরে উড়োজাহাজ
দৈনন্দিন বিজ্ঞান : মৌল মৌলের সংখ্যা মৌলিক পদার্থ আইসোটোপ ও পর্যায় সারণী
দৈনন্দিন বিজ্ঞান : সিলিকন ভ্যালি
দৈনন্দিন বিজ্ঞান : পানি এবং বিশ্বে পানির অবস্থান, পরিমাণ
দৈনন্দিন বিজ্ঞান : বিদ্যুৎ বা তড়িৎ প্রথম বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন ত্বড়িতের একক
দৈনন্দিন বিজ্ঞান : পারমাণবিক অস্ত্র : হাইড্রোজেন বোমা ও এটম বোমা : পরমাণু অস্ত্রের ব্যয়
দৈনন্দিন বিজ্ঞান : একনজরে নোবেল পুরস্কার জানা অজানা বিচিত্র তথ্য
দৈনন্দিন বিজ্ঞান : কোন ফলে কত ভিটামিন এবং কোন ফলে কী থাকে : দেশি ফল বেশি বল
দৈনন্দিন বিজ্ঞান : বিশ্বের প্রথম গ্রন্থাগার : উপমহাদেশের প্রথম গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক