ড. মোহাম্মদ আমীন
দ্বেষ ও বিদ্বেষ এবং দয়া ও করুণা
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘দ্বেষ(√দ্বিষ্+অ)’ শব্দের অর্থ— ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা। বৈরীভাব। বিরাগ। অন্যদিকে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘বিদ্বেষ (বি+√দ্বিষ্+অ)’ শব্দের
অর্খ— ঈর্ষা, বৈরীতা ও শত্রুতা। অর্থ পর্যালোচনায় দেখা যায়— উভয় শব্দ সমার্থক। তবে, শব্দদুটো সর্বক্ষেত্রে সমভাবে কিংবা নির্বিচারে অভিন্নার্থ পাওয়ার জন্য প্রয়োগ করা যায় না।
অভিধার্থ বিবেচনায় ‘বিদ্বেষ’ শব্দের চেয়ে ‘দ্বেষ’ শব্দের ব্যবহার-পরিধি বিস্তৃত ও ব্যাপক হওয়ার কথা, কিন্তু সাধারণভাবে ‘দ্বেষ’ শব্দের চেয়ে ‘বিদ্বেষ’ শব্দের অধিক ব্যবহার ও প্রচলন লক্ষণীয়। এর অন্যতম একটি কারণ— ‘দ্বেষ’ শব্দের উচ্চারণ ‘দেশ’ শব্দের মতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘দ্বেষ’ ও ‘বিদ্বেষ’ উভয় শব্দকে অভিন্ন শব্দের মতো ব্যবহার করা যায়, কিন্তু শ্রুতিমাধুর্য বিবেচনায় সবক্ষেত্রে তা সমভাবে প্রয়োগ করা যায় না। যেমন: “তাদের মধ্যে দ্বেষ রয়েছে” কথাটির চেয়ে “তাদের মধ্যে বিদ্বেষ রয়েছে” কথাটি অধিক কার্যকর, শ্রুতিমধুর ও জোরালো মনে হয়। ‘দ্বেষ’ শব্দের চেয়ে ‘বিদ্বেষ’ শব্দটি অধিক বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করে। ‘দ্বেষ’ শব্দটি যত সাধারণ হিংসা বা ঈর্ষা প্রকাশে ব্যবহৃত হয়, ‘বিদ্বেষ’ তার চেয়ে অধিক হিংসা বা ঈর্ষা প্রকাশ করে।
আবার কবিতায় ছন্দ মেলানোর ক্ষেত্রে ‘দ্বেষ’ শব্দটির অধিক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ‘বিদ্বেষভাবাপন্ন’ কথাটি ‘দ্বেষভাবাপন্ন’ কথার চেয়ে শ্রুতিমধুর এবং সহজ বোধগম্যতায় প্রকাশ করা যায়। উচ্চারণে অভিন্ন হওয়ায় ‘দ্বেষভাবাপন্ন’ আর ‘দেশভাবাপন্ন’ নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হতে পারে। আবার দ্বিত্ব শব্দ হিসেবে দ্বেষ-বিদ্বেষ এবং হিংসা-বিদ্বেষ কথগুলোর প্রচুর ব্যবহার দেখা যায়। অতএব, ‘দ্বেষ’ ও ‘বিদ্বেষ’ সমার্থক হলেও বাক্যে এদের অর্থ, শ্রুতিমাধুর্য এবং উদ্দেশ্য বিবেচনায় প্রয়োগ করা সমীচীন।
দয়া ও করুণা
বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘করুণা (√কৃ+উন্+আ)’ শব্দের অর্থ— কৃপা, দয়া। অনুকম্পা, অনুগ্রহ ইত্যাদি। অন্যদিকে বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘দয়া (√দয়্+অ+আ)’ শব্দের অর্থ— কৃপা, অনুগ্রহ। পরদুঃখমোচনের প্রবৃত্তি। দানশীলতা ইত্যাদি। দয়ার মধ্যে স্নেহ-মমতা আর ভালোবাসার পরিমাণ বেশি, কিন্তু করুণার মধ্যে কিছুটা বিরক্তি থাকতে পারে। মানুষ অসহায় ভিক্ষুক বা অপরিচিত সাহায্যপ্রার্থীকে যত না দয়া করে তার চেয়ে বেশি করে করুণা, বিরক্তিকর এ দয়াকে করুণা বলা যায়। ধর্মীয় নির্দেশনা অনুযায়ী যে দান তা যত না দয়াজাত, তার চেয়ে বেশি করুণজাত। আত্মীয় যত ঘনিষ্ট হয়, দয়া তত নিবিড় হয়; কিন্তু আত্মীয় যত দূরত্বের হয় সেক্ষেত্রে দয়া ক্রমশ করুণার দিকে অগ্রসর হয়। দয়ায় ব্যক্তিগত ত্যাগের ইচ্ছা ও পরিমাণ করুণার চেয়ে কম। করুণায় আন্তরিকতা থাকলেও স্বার্থিক ত্যাগ ততটা প্রবল নয়। দয়া ও করুণ উভয় ক্ষেত্রে প্রশংসা বা সুনাম এবং পুণ্য অর্জনের একটি প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা থাকে। তবে দয়ার ক্ষেত্রে প্রশংসার ঝোঁকটা বেশি।
করুণার চেয়ে দয়া শব্দটি অধিক গ্রহণযোগ্য। তাই দয়া প্রার্থনায় কেউ যত সাবলীল, করুণা প্রার্থনায় তত সাবলীল নয়। একজন ভিক্ষুক বলেন না, করুণা করুন, বলেন- দয়া করুন। করুণা যার-তার ওপর বর্ষিত করা যায়, কারণ এতে আর্থিক ত্যাগ তেমন প্রকট নয়, অন্যদিকে দয়ার প্রয়োগ সীমিত। যদিও মানুষ কাউকে সাহায্য সহযোগিতা করার সময় করুণা শব্দটির পরিবর্তে দয়া শব্দটি অধিক ব্যবহার করে। অতি অসহায়দের প্রতি করুণা শব্দটি সমধিক ব্যবহৃত হয়। তবে ঈশ্বরের কাছে মানুষের প্রার্থনায় দয়া ও করুণা দুটোই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
মরহুম শব্দের মূল অর্থ ও বিবর্তন
মরহুম শব্দের প্রচলিত ও আভিধানিক অর্থ— প্রয়াত, মৃত, স্বর্গীয়, লোকান্তরিত প্রভৃতি। ‘মরহুম’ আরবি শব্দ। আরবিতে এর অর্থ— আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত, করুণাপ্রাপ্ত, দয়াপ্রাপ্ত প্রভৃতি। বাংলাদেশের অনেক মুসলিম মৃত প্রকাশে তাদের মৃত আত্মীয়স্বজনের নামের আগে ‘মরহুম’ লিখে থাকেন। যদিও শব্দটির অর্থ মৃত নয়। তবু অনেকে মনে করেন ‘মরহুম’ শব্দের অর্থ: মৃত।
মরহুম শব্দের অর্থ ‘মৃত’ হিসেবে আমাদের অস্তিত্বে এমনভাবে গেঁথে আছে যে, মরহুম বলতে মৃত শব্দটাই কেবল ভেসে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে যিনি আল্লাহর মেহেরবানি বা দয়া বা করুণা লাভে সমর্থ হয়েছেন তিনিই ‘মরহুম’। জীবিত ব্যক্তিও আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত হতে পারেন। সে হিসেবে মূল আরবি অর্থ বিবেচনায় জীবিত ব্যক্তির নামের আগেও মরহুম লেখা যায়। যদিও শাব্দিক ও প্রায়োগিক অর্থ সর্বদা সমান হয় না; বিপরীতও হতে পারে। যেমন: অপরূপ শব্দের আক্ষরিক অর্থ খারাপ রূপ, কিন্তু এটি সুন্দর অর্থে অধিক প্রয়োগ হয়।
আল্লাহর রহমত বা করুণাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বেহেশতে স্থান পান। মুসলমানদের বিশ্বাস— মৃত্যুর পর আল্লাহর করুণাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বেহেশতে যাবেন। অন্যদিকে, যাঁরা তাঁর করুণাপ্রাপ্ত নন, তাঁরা যাবেন জাহান্নমে। এজন্য মৃত ব্যক্তির নামের আগে ‘মরহুম’ শব্দ লিখে এ প্রত্যাশা করা হয় যে, মৃত ব্যক্তি আল্লাহর করুণা পেয়ে স্বর্গে গমন করেছেন। প্রথমদিকে মৃত ব্যক্তি আল্লাহর করুণাপ্রাপ্ত বোঝাতে ‘মরহুম’ লেখা হতো। এখান লেখা হয় কেবল মৃত প্রকাশে। হিন্দুরা মরহুম লেখেন না, তৎপরিবর্তে লেখেন ‘স্বর্গীয়’। এর অর্থ: মৃত ব্যক্তির আত্মা স্বর্গে আছেন।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, আরবি মরহুম অর্থ (বিশেষণে) পরলোকগত, প্রয়াত। অর্থাৎ.আরবি ‘মরহুম’ শব্দটি বাংলায় তার মূল অর্থে ব্যবহৃত হয় না। সে মূল অর্থ হারিয়ে নতুন অর্থ মৃত, প্রয়াত প্রভৃতি প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। তবে কেবল মৃত অর্থে কারো নামের আগে মরহুম লেখা সমীচীন নয়। কিন্তু রহমতপ্রাপ্ত অর্থে মরহুম লেখা সম্মানজনক। বাংলায় কিন্তু মৃত অর্থে মরহুম লেখা হয়।
বিসিএস প্রিলি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল
ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা বইয়ের তালিকা
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১
কি না বনাম কিনা এবং না কি বনাম নাকি
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন
ভূ ভূমি ভূগোল ভূতল ভূলোক কিন্তু ত্রিভুবন : ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন
প্রশাসনিক প্রাশাসনিক ও সমসাময়িক ও সামসময়িক
লক্ষ বনাম লক্ষ্য : বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন
ব্যাঘ্র শব্দের অর্থ এবং পাণিনির মৃত্যু
যুক্তবর্ণ সরলীকরণ আন্দোলন : হাস্যকর অবতারণা