দ্বেষ বনাম বিদ্বেষ

 এবি ছিদ্দিক

শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)

“বাবর আজম সেঞ্চুরি করার পর পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বিরাগী একজন সাধারণ বাঙালির অন্তরে তাঁর (আজমের) প্রতি যে ঈর্ষা জন্মে, তা দ্বেষের ফলে জন্মে, না কি বিদ্বেষের?”— দ্বেষ আর বিদ্বেষ শব্দ দুটির প্রায়োগিক পার্থক্য নিরূপণ করতে গিয়ে অনেকেই এরূপ প্রশ্ন করে থাকেন। মূলত আভিধানিক অর্থ বিবেচনা করে ‘ঈর্ষা’, ‘বৈরিতা’, ‘বিরাগ’ প্রভৃতি অর্থে ‘দ্বেষ’ আর ‘বিদ্বেষ’ শব্দ দুটি সমার্থক হওয়ায় অনেকে এই শব্দ দুটির ব্যাবহারিক প্রয়োগ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়ে এরূপ প্রশ্ন করেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, দুটি শব্দের অর্থ যতই কাছাকাছি হোক না কেন, ওই শব্দ দুটির ব্যাবহারিক প্রয়োগে একটু হলেও পার্থক্য থাকে। আর, সে পার্থক্য নিরূপণের সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে ওই শব্দ দুটির ব্যুৎপত্তিগত কিংবা গঠনগত অর্থের বিশ্লেষণ করা। তাই, আমি ‘দ্বেষ’ আর ‘বিদ্বেষ’-এর প্রায়োগিক পার্থক্য স্পষ্ট করতে ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণের পথ বেছে নিয়েছি।

সংস্কৃত ‘দ্বিষ্’ ধাতু থেকে ‘দ্বেষ’ শব্দটির উৎপত্তি। ‘দ্বিষ্’ ধাতুটি সাধারণত ‘ঈর্ষা’, ‘ক্রোধ’, ‘বিরাগ’ প্রভৃতি অর্থ ধারণ করে। এই ‘দিষ্’ ধাতুর সঙ্গে ‘উদ্ভব’ অর্থে ‘অ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘দ্বেষ’ (দ্বিষ্+অ) শব্দটি গঠন করে। অর্থাৎ, যার ফলে ‘ঈর্ষা’, ‘ক্রোধ’, ‘পরশ্রীকাতরতা’, ‘বিরাগ’ প্রভৃতি জন্ম নেয়, তাই (তা-ই) হচ্ছে দ্বেষ। এই ‘দ্বেষ’ শব্দটির আদিতে যখন ‘বিশিষ্ট’ অর্থে ‘বি’ উপসর্গ যুক্ত হয়, তখন ‘বিদ্বেষ’ শব্দটি গঠিত হয়। অর্থাৎ, বিশিষ্টরূপে যে ‘ঈর্ষা’, ‘হিংসা’, ‘ক্রোধ’, বৈরিতা’ প্রভৃতির উদ্ভব, তাই (তা-ই) হচ্ছে ‘বিদ্বেষ’। ‘ঈর্ষা’, ‘হিংসা’, ‘ক্রোধ’, ‘বিরাগ’ প্রভৃতি তখনই বিশিষ্ট হয়, যখন তা নির্দিষ্ট দুই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তি আর গোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজমান থাকে এবং কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে ওই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দুটির সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে। যেখানে উভয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে না, সেখানে ‘বিদ্বেষ’ থাকতে পারে না, কেবল ‘দ্বেষ’ থাকতে পারে। কিছু প্রায়োগিক উদাহরণ দেখালে বিষয়টি স্পষ্টতর হয়ে যাবে:

নিউজিল্যান্ডের কাছে টেস্ট সিরিজ হারার পর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের মুখে প্রতিপক্ষ দলের অধিনায়ক উইলিয়ামসনের অধিনায়কত্বের প্রশংসা শুনে ভারত ক্রিকেট দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলি ক্ষেপে গেলেন, শ্রুতিকটু শব্দ ব্যবহার করলেন। এই যে, কোহলি সাংবাদিক কর্তৃক প্রতিপক্ষ দলের অধিনায়কের প্রশংসা সহ্য করতে পারলেন না, পরশ্রীকাতরতা দেখালেন, নিজের রাগ উগরে দিলেন; এসবের সমষ্টিই হচ্ছে উইলিয়ামসনের প্রতি কোহলির বিদ্বেষ, দ্বেষ নয়। কারণ, এখানে দুজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি কোহলি আর উইলিয়ামসন অধিনায়ক হিসেবে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের লড়াইয়ে সক্রিয় ছিলেন।ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে বর্ষসেরা ফুটবলার হতে দেখলে সাধারণ মেসিভক্তদের মনে যে ঈর্ষা বা বিষণ্ণতা কিংবা বিরাগের জন্ম নেয়, ‘রোনালদো বাজে খেলোয়াড়’ বলে চিল্লায়; তা হচ্ছে রোনালদোর প্রতি তাদের দ্বেষের ফল, বিদ্বেষের নয়। কারণ, বর্ষসেরা ফুটবলার ঘোষণা করা হয় খেলার মাঠের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে এবং খেলার মাঠে রোনালদোর প্রতিপক্ষ হিসেবে মেসিভক্তদের কোনো সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে না।

প্রাধান্য বিস্তার নিয়ে বড়ো দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। সময়ে সময়ে যে-কোনো একটি দল এগিয়ে গেলে অন্য দলটি সইতে পারে না, বিপক্ষ দলের নামে কুৎসা রটায়; যা বিদ্বেষের প্রকাশমাত্র। কেননা, প্রাধান্য বিস্তারের বিষয়কে কেন্দ্র করে উভয় দলই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে, তাই ওই দল দুটির মধ্যে বিদ্বেষ থাকাটাই সংগত, দ্বেষ থাকাটা নয়। বইয়ের দোকানে কাশেম বিন আবুবাকারের বইয়ের কাটতি দেখে রবীন্দ্রপাঠকের মুখ দিয়ে যে ‘ছিহ্! কা. বি. আবুবাকারের লেখা চটিতুল্য বইও মানুষ কেনে’ বলে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়, তা হচ্ছে আবুবাকারের প্রতি রবীন্দ্রপাঠকের দ্বেষ, বিদ্বেষ নয়। পাশাপাশি দুজন মুচি কাজ করলে এক মুচির প্রতি অন্য মুচির অন্তরে বিদ্বেষ কাজ করে দ্বেষ নয়। কারণ, জুতো সেলাইয়ের মাধ্যমে বেশি টাকা আয় করবার জন্যে এতে উভয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে।

রোহিঙ্গাদের প্রতি অত্যাচার দেখে একজন সাধারণ বাঙালির মনে মায়ানমারীয় রাখাইনদের প্রতি যে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়, তা হচ্ছে দ্বেষ। কেননা, রাখাইন সেনা কর্তৃক রোহিঙ্গাদের নিপীড়নে বাঙালিদের কোনো সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। কিন্তু রোহিঙ্গা নিপীড়নের ফলে জাতি হিসেবে সাধারণ মুসলমানের মনে যে ক্রোধ জন্ম নেয়, তা হচ্ছে রাখাইন (বৌদ্ধ) জাতির প্রতি মুসলিম জাতির বিদ্বেষ। কারণ, তখন দুটি গোষ্ঠী(জাতি: মুসলিম আর রাখাইন)-র কিছু সদস্য নিজেদের প্রাপ্য অধিকারকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়।

সহকর্মীকে আপনার (নিজের) আগে পদোন্নতি পেতে দেখলে ব্যক্তির অনুভূতিতে যে কাতরতা কাজ করে, তা হচ্ছে বিদ্বেষের ফল, দ্বেষের নয়। কারণ, উভয়েই পদোন্নতির জন্যে নিজেদের কাজে সক্রিয় থাকে। নির্দিষ্ট একটি দল মালালাকে বেপর্দা-বেইজ্জত মেয়ে হিসেবে গণ্য করে। মালালার নোবেল বিজয়ে তারা খুশি হতে পারেনি। মালালার নোবল প্রাপ্তিতে খুশি হতে না-পারাটাই হচ্ছে মালালার প্রতি তাদের মনে বাসা বাঁধা দ্বেষের ফল।ডাক্তারদের তুলনায় ফুটবল খেলোয়াড়দের অনেক বেশি বেতন দেওয়া হয়। তাই, সম্প্রতি স্পেনের ডাক্তারেরা ফুটবলারদের প্রতি অনুযোগ ব্যক্ত করেছেন। এটি হচ্ছে ফুটবলারদের প্রতি ডাক্তারদের জমে থাকা বিদ্বেষের প্রকাশ, দ্বেষের নয়। কারণ, এখানে দুটি গোষ্ঠী (ডাক্তার আর ফুটবলার) টাকা আয় করাকে কেন্দ্রকে সক্রিয় ছিল (আছে)।

প্রথম বর্ষ শেষে অ্যাকাউন্টিঙের ছাত্র এবিসিকে ৪.০০ সিজিপিএ অর্জন করতে দেখে ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্র সাইফুলের যে নেতিবাচক আচরণ প্রকাশ পায়, যে বিষণ্ণতা পরিলক্ষিত হয়, তা হচ্ছে দ্বেষের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সহপাঠিনী লিজুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে দেখে তার (লিজুর) সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে ঢাবিতে ভর্তি হতে না-পারা বন্ধুর বিদ্বেষের প্রকাশ।

দ্বেষ মানুষকে সাময়িকভাবে বিষণ্ণ করে, কিন্তু অতিরিক্ত বিদ্বেষ মানুষকে হিংস্রতার পথে নিয়ে যায়, অন্যের অনিষ্ট করতে উদ্দীপিত করে। বাড়িতে বড়ো বউ সবকিছুতে প্রাধান্য পেলে ছোটো বউয়ের অন্তরে বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। ফলে পরিবারের মধ্যে অশান্তি জন্ম নেয়, ভাঙনের সৃষ্টি হয়। পারিবারিক কলহ থাকায় নির্দিষ্ট দুটি পরিবারের একপক্ষ অন্যপক্ষের উন্নতি সইতে পারে না, অন্যপক্ষের অনিষ্ট করতে দুবার ভাবে না। এসবের কারণও ওই বিদ্বেষ। বিদ্বেষ মাত্রা ছাড়িয়ে যায় বলেই ভাই, ভাইকে খুন করে; বন্ধু বন্ধুকে ছেড়ে যায়; দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধে; জাতির মধ্যে বিরাজমান সম্প্রীতির ইতি ঘটে। তাই, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী হিসেবে আমাদের মধ্যে বিদ্বেষ না-থাকাটাই কাম্য। এতে সকলের মধ্যে সম্প্রীতি যেমন বজায় থাকবে, তেমনি ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে ‘দ্বেষ’ আর ‘বিদ্বেষ’-এর যথাযথ প্রয়োগের ঝামেলারও ইতি ঘটবে।

সূত্র:  দ্বেষ বনাম বিদ্বেষ, এবি ছিদ্দিক, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)


Language
error: Content is protected !!