ড. মোহাম্মদ আমীন
গীতি ও সংগীত : নজরুলগীতি ও রবীন্দ্রসংগীতের পার্থক্য
সংযোগ: https://draminbd.com/নজরুল-গীতি-কিন্তু-রবীন্দ/
গীত থেকে গীতি। গীতি মানে গান বা সংগীত। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘গীত’ শব্দের দুটি পৃথক ভুক্তি রয়েছে। প্রথম ভুক্তিতে বলা হয়েছে: বাক্যে বিশেষ্য রূপে ব্যবহৃত এবং ‘গিত্’ হিসেবে উচ্চারিত সংস্কৃত ‘গীত (√গৈ+ত)’ শব্দের অর্থ— গান, সংগীত প্রভৃতি। দ্বিতীয় ভুক্তি অনুযায়ী: বাক্যে বিশেষণ রূপে ব্যবহৃত ও ‘গিতো’ হিসেবে উচ্চারিত সংস্কৃত ‘গীত (√গৈ+ত)’ শব্দের অর্থ — (১) গাওয়া হয়েছে এমন, (২) বর্ণিত, কীর্তিত, (৩) উক্ত, কথিত প্রভৃতি। আমাদের আলোচনা প্রথম ভুক্তিতে বর্ণিত ‘গীত’(গিত্) নিয়ে, যার অর্থ— গান ও সংগীত। এবার দেখে নেওয়া যাক গান ও সংগীতের আভিধানিক পরিচয়।
বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘গান(√গৈ+অন)’ শব্দের অর্থ— (১) নির্দিষ্ট সুর তাল ও লয়ে উচ্চারিত ছন্দবদ্ধ রচনা, সংগীত; (২) গীতকবিতা; (৩) সুমধুর ধ্বনি বা রব; (৪) কীর্তন বা বর্ণন প্রভৃতি। অন্যদিকে বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘সংগীত(সম্+√গৈ+ত)’ শব্দের অর্থ— (১) গান, (২) গীত ও বাদ্য, (৩) সুর ছন্দ ও লয়ের সমন্বয়ে উচ্চারিত বাক্য, গীত ও বাদ্য।
ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়: গীতি= গীত= গান= সংগীত। অর্থাৎ গীতি ও সংগীত সমার্থক। তবে সমার্থক হলেও এরা অভিন্ন নয় এবং বাক্যে প্রয়োগের সময় উদ্দেশ্যভেদে কখনো কখনো সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ ধারণ করে। এজন্য নজরুলগীতি ও
রবীন্দ্রসংগীত সাধারণ অর্থে গান প্রকাশ করলেও উভয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ করা যায়। অভিন্ন শব্দ নয় বলে সংগতকারণে গীতি এবং সংগীতের পার্থক্য রয়েছে। গীতিকাব্য অথবা গীতি কবিতার সঙ্গে সুরের মিলন ঘটিয়ে গীতি সৃষ্টি করা হয়। সুর না দিলে কোনো গীতিকবিতা গীতি হয় না। এবার দেখা যাক পার্থক্যটা কী।
সংগীত রত্নাকরগ্রন্থে সংগীতের সংজ্ঞার্থ দেওয়া হয়েছে এভাবে— “গীতং বাদ্যং নৃত্যং ত্রয় সঙ্গীত মুচ্যতে”। অর্থাৎ গীত (গান), বাদ্য ও নৃত্য— এই তিনের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় সংগীত। সংগীত শব্দের ব্যুৎপত্তিতেও (সম্+গীত) এমন দেখা যায়। তবে গান ও গীত/গীতি শব্দদ্বয় সংগীতের সমার্থক হলেও তাদের সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য — এ ত্রয়ী (গীত বাদ্য নৃত্য) সম্মিলন অনাবশ্যক। এবার দেখা যাক—রবীন্দ্রনাথের গানকে কেন সংগীত এবং নজরুলের গানকে কেন গীতি বলা হয়?
শুবাচি সবুজ কুণ্ডুর মতে, রবীন্দ্রনাথের গানের সুর, শুরু থেকেই নির্দিষ্ট ছিল। কিছু রবীন্দ্রনাথ নিজে আর কিছু সম্ভবত তাঁর নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতন নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। নজরুলের গান এমন ছিল না। তাই শুরুতে নজরুলের গানকে গীতি বলা হতো। এখন নজরুলের বেশির ভাগ গানের নির্দিষ্ট সুর করা হয়েছে বা চলছে তাই এখন গীতি না বলে সংগীত বলা হয়। শুবাচি জনাব রমেশ সাহানীর শুবাচ-উদ্ধৃতি থেকে বলা যায়— কথায় সুর দিলে তা হয়ে যায় সংগীত। রবি ঠাকুরের যেসব কথায় অন্যের সুর ছিল— তা রবীন্দ্রগীতি; উনি জীবদ্দশায় সে গানগুলোয় সুর করে গেছেন ফলে রবিগীতি নেই। অন্যদিকে নজরুল, অনেক গানের কথার সুর নিজেই করেছেন যা নজরুলসংগীত। তাঁর লেখা কিছু গান কমল দাশগুপ্ত বা অন্যরা করেছেন— সেগুলো নজরুলগীতি।
এ প্রসঙ্গে শুবাচি জনাব মৃণাল কান্তি সাহার তথ্য ও মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি শুবাচের মন্তব্য সারিতে লিখেছেন: দেবব্রত বিশ্বাস তাঁর ‘ব্রাত্য জনের রুদ্ধ সঙ্গীত’ গ্রন্থে জানিয়েছেন— এক সময় রবীন্দ্রসংগীতকে বলা হতো রবি বাবুর
গান, কখনও রবি ঠাকুরের গান, আবার গ্রামোফোন রেকর্ডে কখনো লেখা থাকত কথা ও সুর— রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু ওই গ্রামোফোন রেকর্ডেই একবার লেখা হলো—রবীন্দ্রসংগীত। মূলত তখন থেকে জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় ‘রবীন্দ্রসংগীত’ শব্দটি। নজরুল ইসলামের গানকে পঞ্চাশের দশকে
আকাশবাণী থেকে বলা হতো —আধুনিক গান, ঢাকা বেতারে বলা হতো— নজরুল ইসলামের গান। সত্তরের দশকে বাংলাদেশের নজরুল বিশেষজ্ঞ দল মিলে নাম ঠিক করলেন নজরুলগীতি। তবে এখন নজরুলগীতি বলা হয় না— বলা হয় নজরুল সংগীত। প্রসঙ্গত পঞ্চ কবিদের গানও এভাবে দ্বিজেন্দ্রগীতি বা

দ্বিজেন্দ্রলালের গান, রজনীকান্তের গান বা কান্তগীতি, আবার অতুল প্রসাদ সেনের গান কখনো অতুলপ্রসাদী কখনো শুধু প্রসাদীগান বলা হয়। পশ্চিম বঙ্গের বিশিষ্ট নজরুল গবেষক শ্রী ব্রহ্মমোহন ঠাকুর তাঁর একটি লেখায় জানিয়েছেন— যেসব গান কাজী নজরুল ইসলাম নিজে সুর দিয়েছেন সেগুলো নজরুল সংগীত আর যেসব গান অন্যদের সুরারোপ করা সেগুলো নজরুলগীতি।
শুবাচের গবেষণায় লব্ধ আমার ধারণার সঙ্গে শুবাচি জনাব মৃণাল কান্তি সাহার বর্ণনা প্রায় অভিন্ন তাঁর সঙ্গে আরও কিছু ধারণা যুক্ত করা যায়। রবীন্দ্রনাথ সাধারণত কোনো গীতিকবিতা, গান বা গীত লিখে তা নিজে কিংবা তাঁর উপস্থিতি আরও কয়েক জনের সঙ্গে আলোচনাক্রমে বাদ্য ও নৃত্য সহকারে সুর নির্দিষ্ট করে দিতেন। সবগুলো না-হলেও বলা যায়— রবীন্দ্রনাথের অনেক গীতিকবিতা এভাবে গান থেকে সংগীতে পরিণত হয়েছে। তবে সবকটি গানে রবীন্দ্রনাথ নিজেই সুরারোপ করেছেন। তাই অধিকাংশের অভিমত— এজন্য রবীন্দ্রনাথের গানকে সংগীত বলা হয়। অন্যদিকে চারিত্রিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য, দীর্ঘকালীন অসুস্থতা প্রভৃতি কারণে নজরুলের লেখা গীতিকবিতার ক্ষেত্রে এমনটি সবসময় ঘটেনি। তিনি অনেক সময় অনেকের অনুরোধে মুহূর্তের মধ্যে গান লিখে অনুরোধকারীর হাতে দিয়ে দিতেন। সে গানে নানা জন নানাভাবে সুর করতেন। যা পরবর্তীকালে ‘নজরুলগীতি’ নামে পরিচিতি পায়। নজরুল অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের মতে, “কাজী নজরুল ইসলামের চৈতন্য লোপ পাওয়ার পরে রেকর্ড করা গানগুলো নজরুলগীতি।”
তবে আমি মনে করি, ‘রবীন্দ্রসংগীত’ ও ‘নজরুলগীতি’ শব্দ-দুটোর পরিচিতি যতটা না উৎপত্তিগত, তার চেয়ে বেশি হলো— আকাশবাণী ও গ্রামোফোন কোম্পানির প্রচারগত। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গানের প্রচারে আকাশবাণী ও গ্রামোফোন কোম্পানি যথাক্রমে সংগীত ও গীতি শব্দের ব্যবহার শুরু করার পরই রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলগীতির উৎপত্তি, বিকাশ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সৃষ্টির মূল কারণ ঘটে।
শুবাচি জনাব মৃণাল কান্তি সাহার ভাষায় বলা যায়— আসলে নামে খুব একটা কিছু এসে যায় কি? ফুলের রঙ তো বদলায় না। মিছেমিছি নামের ইট-পাটকেল ছুঁড়ে নিজেদের ক্ষত-বিক্ষত করি কেন। যাদের ভালো লাগে তাঁরা করুন। আসুন আমরা গীতিকবিদের গানেই থাকি।
বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.