ড. মোহাম্মদ আমীন
‘নদ’ কি পুরুষ? ‘নদী’ কি নারী? নদীর শাখা আছে, নদের কি শাখা নেই? ‘নদ’ যদি পুরুষ হয় তো কীভাবে, আর যদি ‘নদী’ নারী হয় তাও কীভাবে? যুক্তি যা পাওয়া যায় তার কোনোটাই গ্রহণযোগ্য মনে হয় না, বরং হাস্যকর প্রতিভাত হয়। দেখা যাক, নদ-নদী নিয়ে কী বলা হয়, না-হয়; বিবেচনা করা যাক— পক্ষ-বিপক্ষ তথ্য-তত্ত্ব-যুক্তি।
বলা হয়— সাধারণত কোনো জলপ্রবাহের নাম যদি স্ত্রীবাচক হয় তাহলে ‘নদী’ এবং পুরুষবাচক হলে ‘নদ’। উদাহরণ: যমুনা মহিলাবাচক নাম, তাই নদী। ‘কপোতাক্ষ’ পুরুষবাচক নাম, তাই নদ; কিন্তু লিঙ্গ নির্ধারণ হলো কীভাবে? এবং কাজটা করল? নদী জন্ম দিতে পারে, তো জন্মকৌশলটা কী? অনেকে বলেন, যে জলস্রোতের নামের শেষে ‘আ-কার’ বা ‘ই-কার’ থাকে তাকে ‘নদী’ বলে। আর যে জলস্রোতের নামের শেষে ‘আ-কার’ কিংবা ‘ই-কার/ঈ-কার’ থাকে না তাদের ‘নদ’ বলে।এই আ বা ই/ঈ কে যুক্ত করল জলপ্রবাহের নামের সঙ্গে? যেমন-তুরাগ, কপোতাক্ষ, ব্রহ্মপুত্র, নীল প্রভৃতি ‘অকারন্ত’, তােই ‘নদ’। শুবাচি জসিম উদ্দিন শুবাচে প্রকাশিত তাঁর একটি যযাতিতে এই অভিমত সমর্থন করে লিখেছেন, “– – — যে সকল ‘নদীর’ নাম পুরুষবাচক অর্থাৎ অ ও উ -কারান্ত তারা ‘নদ’ আর যে সকল ‘নদীর’ নাম নারীবাচক অর্থাৎ আ-কারান্ত বা ঈ , ই-কারান্ত তারা নদী। যেমন: কপোতাক্ষ, ব্রহ্মপুত্র, নীল, দামোদর, শংখ, আমাজন, সবই নদের নাম, যমুনা,পদ্মা, মেঘনা, ভলগা, আত্রাই, ইছামতি, মধুমতি, ভাগিরথী সবই নদীর নাম । এই কারণে ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী থাকলেও এটি নদ। একই কারণে নীল ‘নদী’ নয় ‘নদ’। অনেকে আমাজন নদী বললেও উপরে উল্লিখিত কারণে তা হবে নদ । তাই এখন থেকে যে নদীর নাম অ ও উ -কারান্ত দেখবেন , নিশ্চিন্তে তাকে ‘নদ’ বলুন , আর আ,ই ও ঈ-কারান্ত দেখবেন নিশ্চিন্তে ‘নদী’ বলুন ।” এ বিষয়ে আমিও একসময় একই ধারণা পোষণ করতাম। যা আমি ‘বাংলা ভাষার মজা’ গ্রন্থে লিখেছি।
শুবাচি জসিম উদ্দিনের যযাতির বক্তব্যকে অধিকাংশ শুবাচি গ্রহণ করতে পারেননি। অনেকে তাঁর বক্তব্যকে অযৌক্তিক, হাস্যকর ও ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁরা, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে জসিম সাহেবের বক্তব্যের বিপরীত বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রথমে এসেছে ‘তিতাস’ নদীর নাম। তাঁদের প্রশ্ন— তিতাস ‘আ-কারান্ত’ বা ‘ই-কারান্ত’ না হয়েও নদী হলো কীভাবে? দেখা যাক, এ প্রসঙ্গে শুবাচিবৃন্দের অভিমত:
শুবাচি Kamalesh Mistry শুবাচের মন্তব্য জানালায় লিখেছেন, “‘অ-কারান্ত’ ও ‘ই-কারান্ত’ তত্ত্ব হাস্যকর। তুরাগ নদী হলো কোন ‘কারান্ত’ হয়ে? “তিতাস একটা নদীর নাম” উপন্যাসের কথা কে না জানে!” শুবাচি Kamalesh Mistry শুবাচি জসিম উদ্দিনকে উদ্দেশ করে আরও লিখেছেন, “বাংলাদেশের সকল বই, সরকারি নথিতে মনু, ধনু, সাঙ্গু ও বালু নদীকে নদী হিসাবেই লেখা আছে। আপনার তত্ত্বকে বিশ্বাসযোগ্য করতে এসব নদীকে নদ বলতে হবে? তিতাস, কুমার, নাফ, লাইন, বতৈর, ঘাঘর, পশুর, পাণ্ডব, বড়াল, রাবনাবাদ, রায়মঙ্গল, হরিহর, ডাহুক, কুলিক, ঘাঘট, নারদ নদীর কথা নাই-বা বললাম।”
শুবাচি Tazrian Alam Ayaz জসিম উদ্দিন সাহেবের যযাতির বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করে লিখেছেন, “কংশ, তিতাস, তুরাগ এগুলো নদীর নাম। আবার সিন্ধু নদের নাম। আপনার ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।ব্যাপারটা খুব সহজ। নদ এবং নদীর মধ্যে কোনো পার্থক্যই নেই। খুব সম্ভবত কবি-সাহিত্যিকদের কেউ অনুপ্রাসের স্বার্থে নদীকে ‘নদ’ লিখেছিলেন; সেখান থেকেই নদ শব্দের প্রচলন। আখতারুজ্জামান আজাদের এই ব্যাখ্যাই ভালো লেগেছে আমার কাছে।”
শুবাচি Shah Kamal- এর মন্তব্য ভিন্ন রকম, “নদের কিনারে যারা বাস করেন তাদের মুখে নদ শুনবেন না, নদীই বলেন তারা। সমস্যা পণ্ডিতদের মধ্যে।” Md Ashikuzzaman বলেছেন, “আমি যতটুকু শুনছিলাম শব্দের শেষে অ বা শূন্য বিভক্তি হলে সেগুলোকে নদ বলা হয়; “কিন্তু কংশ তো নদী”, তারেক আজিজ জানতে চান, “প্রকৃত অর্থে, কিন্তু কেউ কাউকে আদর করে কিছু ডাকলে করার কী থাকে? যত ঝামেলা বাংলায় কিন্তু ইংরেজিতে river বললেই শেষ।”
আবার অনেকে বলেছেন, সাধারণত নদের কোনো শাখা নদ কিংবা উপ-নদ নেই। নদীর থাকতে পারে। নদীর প্রকারভেদ আছে— প্রধান নদী, শাখা নদী উপ-নদী ইত্যাদি। প্রধান নদীও অন্য নদীর উপ-নদী হতে পারে।অনেক শুবাচি এ প্রসঙ্গে বলেন, এটাও ঠিক নয় এবং অনেকের মতে হাস্যকর।তাঁরা উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, নদীর মতো নদেরও শাখা-উপশাখা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে M S Imtiaj Himu লিখেছেন, “কয়েকটা ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু কোনটাই ১০০ ভাগ খাটে না, যেমন ব্যাকরণগত যে ব্যাখ্যা তা কিন্তু তিতাস, তুরাগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে মিলছে না। আমার মনে হয় নদ আর নদীর ক্ষেত্রে তাদের ভূতাত্ত্বিক বা গঠনগত বৈশিষ্ট্য কখনোই তেমন প্রাধান্য পায় না। নামগুলো যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। তাই কেউ নদ-নদীর ম্যাপ দেখে বা বৈশিষ্ট্য বাছবিচার করে তাদের লিঙ্গ ঠিক করে দিয়েছে বা প্রচলন করেছে তা শুনতেই বেখাপ্পা লাগছে। এক্ষেত্রে সম্ভবত নদ-নদী নিয়ে মানুষের মাঝে প্রচলিত লোককথা, কাহিনী এসবই সবচেয়ে মুখ্য। কেননা, মানুষ সবসময় নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে মেনে এসেছে। অনেকটা দেও দেবতার মতো। নদীপারের মানুষের মধ্যেই অনেক গল্প প্রচলিত আছে এসব নিয়ে।”
শুবাচি Tauhid Ahmed মন্তব্য করেছেন, “আচ্ছা মানছি ‘যে নদীর শাখা আছে তা নদী, আর যে নদীর শাখা নাই তা নদ’ এই ব্যাখ্যাটা ভুল। পরে যে যুক্তি দেখানো হয়েছে অ-কারান্ত, আ-কারান্ত, ই-কারান্ত বা ঈ-কারান্ত দিয়ে, ঘুরে ফিরে সেই একই ‘শাখা এবং শাখাবিহীন’ আবর্তেই এসে পড়ছি আমরা। যেগুলোকে আমরা নদী বলে জেনে বড়ো হয়েছি অর্থাৎ যেগুলোর নাম নারীবাচক অর্থাৎ আ/ই/ঈ-কারান্ত, তাদের শাখা আছে বা আরও ভেঙে বলতে গেলে তারা সন্তান দিয়েছে। ‘মাতৃত্ব’ শুধুমাত্র একজন নারীর’ই মৌলিক ক্ষমতা, যা পুরুষের নাই, অর্থাৎ নদের কোনো শাখা-প্রশাখা নাই। শাখা-প্রশাখা, মাতৃত্ব -এগুলো বাদ দিলাম। কমেন্টস-এ দেখলাম অনেকে অনেক নদীর নাম উল্লেখ করেছেন যা আ/ই/ঈ-কারান্ত ছাড়া, যেগুলোকে আবার নদী বলেই সম্বোধন করা হচ্ছে, এর ব্যাখ্যা কী হবে বলে আপনার মনে হয়। আপনি একজনের মন্তব্যের পাল্টা মন্তব্য করেছেন, এগুলো সব পণ্ডিত ব্যক্তিদের ব্যাখ্যা। সেগুলো ব্যতিরেকে শুধু আপনার মন্তব্য জানতে চাই। আরেকটা প্রশ্ন উঁকি মারছে আমার মনে। কোনো বাবা-মা শখ করে তাদের মেয়ের নাম ‘নদী’ রাখতে পারেন, কিন্তু কোনো বাবা-মা কি তাদের ছেলের নাম ‘নদ’ রাখতে পারবেন? কী মনে হয় সবার ?”

একজন লিখেছেন, “নামগুলো বহু প্রাচীন, সংস্কৃত থেকে এসেছে অধিকাংশ নামই। তার মানে হচ্ছে প্রাচীনকালে যখন নদী বা নদ বিবেচনা করে নাম রাখা হয়েছিল, তখন যে নদীর শাখা ছিল না তাদের নদ হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছিল।” আমিও এ অভিমতের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করি। এ বিষয়ে শুবাচি MK Sonali লিখেছেন, “নদ বা নদীতে পুরুষ নারী নেই। এটা বাচনিক ভঙ্গি। পুরুষবাচক নামের কারণে কেউ হয়তো নদ বলেছে, সেই ধারাই রয়ে গেছে। আসলে নদ -নদীতে কোনো পার্থক্য নেই, সবগুলো নদী, এখানে লিঙ্গ বৈষম্যের কোনো অবকাশই নেই। নদী ইজ নদী, এটাই শেষ কথা।” বেশ সাহসী এবং দৃঢ় বক্তব্য তাঁর।
উপরের আলোচনা ও পর্যালোচনা এবং আমার ব্যক্তিগত ধারণা থেকে বলতে পারি— আসলে ‘নদী’ কোনো নারী এবং ‘নদ’ কোনো পুরুষ নয়। এর সঙ্গে নদ-নদীর স্বরূপ, প্রকৃতি, উৎপত্তি বা ভৌগোলিক বিভাজন, গাঠনিক ধারা কোনো বিষয় জড়িত নয়। এম এস ইমতিয়াজ হিমুর মন্তব্যের সূত্র ধরে বলতে পারি, নদ-নদী নিয়ে মানুষের মাঝে প্রচলিত লোককথা, কাহিনী এসবই নদী বা নদী নামায়নে সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। কেননা, মানুষ সবসময় নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে মেনে এসেছে। অনেকটা দেও দেবতার মতো। নদী-পারের মানুষের মধ্যেই অনেক গল্প প্রচলিত আছে এসব নিয়ে। এ প্রসঙ্গ শুবাচি আখতারুজ্জামান আজাদের মন্তব্যটিও যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য, খুব সম্ভবত কবি-সাহিত্যিকদের কেউ অনুপ্রাসের স্বার্থে নদীকে ‘নদ’ লিখেছিলেন; সেখান থেকেই ‘নদ’ শব্দের প্রচলন।”
অতএব, নদ ও নদীর নামকরণ জলপ্রবাহের কোনো লিঙ্গত্ব বা প্রকৃতি নির্দেশ করে না; এই নামকরণ মূলত ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। তাই বাংলা বা সংস্কৃত কিংবা তা থেকে উদ্ভূত ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষায় মহিলা স্রোতস্বিনী নেই। স্রোতস্বিনীকে মনে করা হতো জীবন্ত সত্তা কিংবা দেবতা বা দেবির প্রতিভূ। তাই নামকরণের সময় প্রচলিত লোকগাথা, বিশেষ করে ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনির উপর ভিত্তি করে জলপ্রবাহের নাম নদ বা নদী রাখা হয়েছিল। এখানে ‘নদী’ কোনো নারী বা ‘নদ’ কোনো পুরুষ নয়।এর সঙ্গে নদী বা নদীর প্রকৃতি, ভৌগোলিক বিভাজন, উৎপত্তি কিংবা আচরণ বা গাঠনিক বৈশিষ্ট্য— কোনোটা জড়িত নয়। প্রাচীন আমলে প্রচলিত লোককাহিনি বা পৌরাণিক কাহিনির ভিত্তিতে যেভাবে নাম রাখা হয়েছে ঠিক সেভাবে আমরা জেনে আসছি এবং বলে যাচ্ছি।
তাহলে নদ-নদী কীভাবে চিনব? নাম দিয়ে। কানা ছেলের নাম ‘পদ্মলোচন’ রাখলে সেও পদ্মলোচন; ওই নামেই সে পরিচিত, তার চোখ থাক বা না-থাক; তাতে আপনার-আমার কী?