কীভাবে হলো দেশের নাম (এশিয়া)
ড. মোহাম্মদ আমীন
নর্থ কোরিয়া (North Korea)
উত্তর কোরিয়া উত্তর-পূর্ব এশিয়ার একটি রাষ্ট্র যা কোরীয় উপদ্বীপের উত্তর অর্ধাংশ নিয়ে গঠিত। এর সরকারি নাম গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া। দেশটির উত্তরে গণচীন, উত্তর-পূর্বে রাশিয়া, পূর্বে জাপান সাগর, দক্ষিণে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরীয় বেসামরিক অঞ্চল এবং পশ্চিমে পিতসাগর অবস্থিত।
আধুনিক কোরিয়া (Korea) নামের প্রাচীন বানান ছিল (Corea)। চায়না ভাষা হতে পর্যটক মার্কোপোলের প্রতিলিপিকৃত নাম ‘কাওলি’ কোরিয়া নামের অন্যতম উৎস। চায়নিজ বর্ণের কোরিয়ান নাম হানজা। হানজা অক্ষরে আধুনিক কোরিয়াকে বলা হতো গোরিও বা কোরিও (Goryeo or Koryo)। কোরিও ছিল তৎকালীন রাজবংশ। এ রাজবংশ ৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৩৯২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কোরিয়াসহ সে অঞ্চলের অধিকাংশ উপদ্বীপ শাসন করেছে। মার্কোপোলের ভ্রমণকালীন কোরিও রাজবংশের শাসন বলবৎ ছিল। এ রাজবংশের নাম হতে কোরিয়া নামের উৎপত্তি। বর্তমানে কোরিয়া দুই অংশে বিভক্ত। একটি উত্তর কোরিয়া আর একটি দক্ষিণ কোরিয়া।
নর্থ কোরিয়ার মোট আয়তন ১,২০,৫৪০ বর্গ কিলোমিটার বা ৪৬,৫২৮ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলীয় ভাগের পরিমাণ ৪.৮৭%। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে নর্থ কোরিয়ার মোট জনসংখ্যা ২,৪৮,৯৫,০০০। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্য ১৯৮। আয়তন বিবেচনায় নর্থ কোরিয়া পৃথিবীর ৯৮-তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু মোট জনসংখ্যা বিবেচনায় ৪৮-তম। অন্যদিকে জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় পৃথিবীর ৬৩-তম জনবহুল দেশ। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের হিসাব মতে, নর্থ কোরিয়ার জিডিপি (পিপিপি) ৪০.০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ১,৮০০ ইউএস ডলার। অন্যদিকে, জিডিপি (নমিনাল) ১৫.৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ৬,২১ ইউএস ডলার। দেশটির মুদ্রার নাম নর্থ কোরিয়ান উয়ান (North Korean won )।
উত্তর কোরিয়া ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে সোভিয়েত সামরিক বাহিনী কোরীয় উপদ্বীপের উপরের অর্ধাংশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ১৯৫০-এর দশকের কোরীয় যুদ্ধের পর থেকে এটি সমাজতান্ত্রিক শাসনের অধীনে রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম শহরের নাম পিয়ংইয়ং।
অবিভক্ত কোরিয়ার উত্তরাংশ জাপানিদের দখলে ছিল। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার সময় জাপানিরা সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তার ফলে অবিভক্ত কোরিয়া ২ ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তখন উত্তর কোরিয়া ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের মতাদর্শে সমাজতান্ত্রিক ব্লকে চলে যায়। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া পুঁজিবাদি আমেরিকার মতাদর্শে পুঁজিবাদি ব্লকে যোগদান করে। তখন থেকে কোরিয়া ২টি ভিন্ন নাম যথা উত্তর ও দক্ষিণ তথা ২টি ভিন্ন আর্থনীতিক ব্যবস্থাতে চলতে শুররু করে। উত্তর কোরিয়ার সরকারি নাম রাখা হয় গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারি নাম রাখা হয় প্রজাতন্ত্রী কোরিয়া।
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলেও দেশটি কার্যত একটি একদলীয় শাসনব্যবস্থাতে পরিচালিত নৃশংস দেশ। কিম জং ইলের নেতৃত্বে কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টিই হলো দেশটির একমাত্র শাসক রাজনীতিক দল। সংবিধানে গণতান্ত্রিক সরকারের কথা বলা হলেও কিম জং ইল ও মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতা দেশটি পরিচালনা করেন। পশ্চিমা বিশ্বে দেশটি একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসাবে গণ্য হলেও মার্ক্সবাদ বা লেনিনবাদ নয়, বরং চুছে (Juche) তথা ‘স্বনির্ভরতা’ হলো দেশটির বর্তমান সরকারের রাজনীতিক দর্শন।
উত্তর কোরিয়ার আদর্শ কোরীয় ভাষার নাম মুনহোয়াও, যার অর্থ পরিশীলিত ভাষা। এটি দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যবহৃত আদর্শ কোরীয় ভাষার চেয়ে আলাদা। উত্তর কোরিয়াতে ছয়টি আঞ্চলিক উপভাষা রয়েছে, তবে চেজু দ্বীপের উপভাষা ছাড়া সবগুলো পরস্পর বোধগম্য। উত্তর কোরিয়াতে ব্যবহৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি ভাষা ইংরেজি। এর পর চীনা ভাষার অবস্থান। এখানে সাক্ষরতার হার প্রায় ৯৩%। তবে অনেকে মনে করেন, এটি অতিরঞ্জিত। প্রকৃত শিক্ষার হার অনেক কম। ১৯৪৯ খ্র্স্টিাব্দে উত্তর কোরিয়াতে আইন করে গণমাধ্যমে চীনা অক্ষরের মাধ্যমে কোরীয় ভাষা লেখা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তবে একই সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার স্কুলগুলোতে চীনা ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার ভাষাতে ইংরেজি ও জাপানি শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যা উত্তর কোরিয়াতে সমালোচিত।
নর্থ কোরিয়ার একচ্ছত্র নেতা প্রেসিডেন্ট কিম ইল সুঙ। তিনি ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। নর্থ কোরিয়ায় কিম ইল সুঙ এর জন্মদিনকে সূচনাবর্ষ গণ্য করে একটি পঞ্জিকা প্রস্তুত করে। বছর গণনায় ওটিই ব্যবহার করা হয়। কিম ইল সুঙকে নর্থ কোরিয়া চিরন্তন নেতা বলা হয়। এমনকি তার মৃত্যুর পর তার কোনো উত্তরাধিকারী ক্ষমতায় এলেও কিম ইল সুঙই চিরন্তন নেতা হিসাবে অধিষ্ঠিত থাকবে।
নর্থ কোরিয়ায় পৃথিবীর বৃহত্তম স্টেডিয়াম অবস্থিত। রুঙনাডো (Rungnado) নামের এ স্টেডিয়ামে একসঙ্গে ১,৫০,০০০ এর অধিক দর্শক বসতে পারে। এছাড়াও রয়েছে অনেকগুলো কক্ষ। নর্থ কোরিয়ায় সেনাবাহিনী পৃথিবীর বৃহত্তম বাহিনীর একটি। তাদের সক্রিয় সেনা সংখ্যা ১.২ মিলিয়ন। ১৭-৫৪ বছর বয়সি প্রতি ৫ জন মানুষের মধ্যে একজন সেনাবাহিনির সদস্য। অথচ দক্ষিণ কোরিয়ায় সেনা সংখ্যা ৬,৮০,০০০।
নর্থ কোরিয়ানবাসী তাদের নিজস্ব টিভি চ্যানেল ছাড়া আর কোনো টিভি চ্যানেল দেখতে পায় না। কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসাবে দাবি করা হলেও নর্থ কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র নয়। নর্থ কোরিয়ার শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের জন্য কেবল শিক্ষক ছাড়া চেয়ার, টেবিল, ডেস্ক ও হিটারের জ্বালানি প্রত্যেক কিছুর জন্য অর্থ দিতে হয়। এজন্য অনেক পিতামাতা গোপনে তাদের ছেলেকে স্কুল হতে নিয়ে আসেন। বাসায় শিক্ষক দিয়ে পড়ান। ৩০ লক্ষ অধিবাসী অধ্যুষিত পিয়ঙইয়ঙ নর্থ কোরিয়ার একমাত্র শহর, যেখানে কেবল অভিজাতরা বসবাস করে। সরকারের বিশ্বস্ত, স্বাস্থ্যবান ও অনুগত নাগরিকেরাই কেবল এ শহরের বাসিন্দা। সাধারণ যারা থাকেন, তারা অভিজাতদের চাকর-বাকর।
নর্থ কোরিয়ার জনগণের ৬০% চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। সম্পদের প্রচণ্ড সীমাবদ্ধতার জন্য নর্থ কোরিয়ান সরকার সার হিসাবে মানুষের মল ব্যবহার করতে বাধ্য করে এবং এ মলের জন্য তাদেরকে মূল্য দিতে হয়।
কিম জঙ ইল এর ৫ সন্তান। তন্মধ্যে কনিষ্ঠ কিম জঙ উন (Kim Jong-un) দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট। অবশ্য প্রথমে জ্যেষ্ঠ সন্তান কিম জঙ-নামকে (Kim Jong-nam) পিতা কিম জঙ ইলকে (Kim Jong-il) উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করেছিলেন। জঙ টোকিওতে ভুয়া পাসপোর্টে জাপান ভ্রমণের সময় ধরা পড়লে তার বদলে কনিষ্ঠজনকে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করা হয়। কিম জঙ ইল কমপক্ষে ৫০টি নামে অভিহিত ছিলেন। তন্মধ্যে ডিয়ার লিডার, সুপ্রিম লিডার, আওয়ার ফাদার, দ্যা জেনারেল, জেনার্যালিসিমো প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তিনি কখনও বিমানে চড়েননি। কিম ইল সুঙ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যয়ন করেছেন। ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নকালীন কিম জঙ ইল (Kim Jong Il ) ৩ বছরে ১,৫০০ পুস্তক লিখেছেন মর্মে দাবি করা হয়। অভিযোগ রয়েছে কিম জং ইল তার ৫ বছর বয়স্ক ছোট ভাইকে পিয়াংইয়াঙে তাদের পারিবারিক সুইমিং পুলে ডুবিয়ে হত্যা করেছে। তবে এ অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। কিম জঙ ইল একবছরে ৭,৬৩,০০০ ডলার মূল্যের কনিয়াক (Cognak) নামের ব্রান্ডি আমাদানি করেছেন। তিনি এ ব্রান্ডির অনুরক্ত ছিলেন।
কিম জঙ ইল এর মরদেহ একটি কাঁচের সমাধিতে সংরক্ষিত আছে। দেশি-বিদেশি যে কেউ তার মরদেহ দেখতে পারেন। এটি দর্শন সে দেশের মানুষের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিনোদন এবং অনেকের কাছে প্রার্থনা।
নর্থ কোরিয়া ভোট দেওয়ার ব্যাপারে শুধু একটিমাত্র অপশন থাকে। যারা ভোট দিতে যান, কেবল তাদেরকে ভোটার হিসাবে গণ্য করে ভোটের হিসাব করা হয়। তাই যিনি নির্বাচনে দাঁড়ান তিনি ১০০% ভোটই পান। এখানে কোনো আইন প্রকৃতপক্ষে নেই। লিডার যা বলেন, যা করেন তা-ই আইন।
কানো ব্যক্তি আইন ভঙ্গ করলে বা তাকে কারাগারে পাঠানো হলে ওই ব্যক্তির পুরো পরিবারের সদস্যকে শাস্তি পেতে হয়। অপরাধীর সঙ্গে অপরাধীর পিতামহ-পিতামহী, মাতা-পিতা এবং শিশুদেরকেও হাজতবাস করতে হয়। বর্তমানের নর্থ কোরিয়ার বন্দিশালার কর্মশিবিরে ২,৫০,০০০এর অধিক বন্দি কাজ করছে। তাদের চরমভাবে নির্যাতন করা হয়।
লেবানন (Lebanon) : ইতিহাস ও নামকরণ
নেপাল (Nepal) : ইতিহাস ও নামকরণ
সূত্র: কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।