নিউটনের ছাত্রী: এক মলাটে নিউটনের ছাত্রী: সমগ্র পর্ব: কিশোর উপন্যাস

১৫

মি স্যার খেয়ে আসি?” অধ্যয়নের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার বিশ মিনিট আগে সাহেদের অনুনয়, “ভারি খিদে পেয়েছে স্যার।”
এতক্ষণ খাওনি কেন?
খেতে বসলে আপনি যদি এসে পড়েন! খেতে যাই স্যার?
যাবে, তবে বিশ মিনিট পর। আড্ডাজ্ঞান মওকুফ করে দিলাম।
আমি খুব ক্ষুধার্ত, স্যার।
ডাহা মিথ্যা কথা। যেদিন খেলতে ইচ্ছে করে সেদিন নানা অজুহাত দিয়ে আগেভাগে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। ছেলেটার ভালো আক্কেল, কিন্তু পড়ে না। ব্যবসার দিকেই ঝোঁক। বড়ো লোকের ছেলেদের এই একটা সাধারণ স্বভাব। টাকা আয়ের জন্য পড়া। পড়া ছাড়াই তাদের চারপাশে আয়ের হাজার পথ ঘুরঘুর করে। অযথা এত কষ্ট করে পড়তে যাবে কোন দুঃখে।
সাহেদ চলে গেলে সেলিমাকে একা পড়াতে ভারি অস্বস্তি লাগত। এই রুমে তাহের ছাড়া কেউ আসে না। তাও গত এক বছরে চার-পাঁচ বারের বেশি দেখিনি। তিন তলার প্রত্যেকটা রুম গেস্ট হাউজের মতো পৃথক। আমি ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া উচ্ছৃঙ্খল বয়সের একজন যুবক। যেদিকে পিঁপড়ে যায় না সেদিকে হাতি ঢুকিয়ে দেওয়া এ বয়সের কাজ। এরকম একটা নির্জন রুমে একজন কিশোরীর পাশে— মন যতই ব্রহ্মচারী থাকুক, পরিবেশটা ঝিমঝিম সংশয়ে কাতর হয়ে যেত। সেলিমা আমার আসল রূপ দেখার জন্য সাহেদকে কৌশলে বের করে দিচ্ছে না তো?
এ মেয়ের বিশ্বাস নেই। বড়ো সাংঘাতিক। সে আমার অবস্থা উপভোগ করত বেশ স্বাভাবিক থেকে রসিয়ে রসিয়ে।
স্যার, পেট জ্বলছে খিদের জ্বালায়। I’m too hungry, যাব?
একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে যেতে পারবে। আমি বুঝতে পারব তুমি আসলেই ক্ষুধার্ত কি না।
বলুন স্যার?
What is the definition of hungry?
A hungry man is always angry. সুতরাং, An angry man is always a hungry man. হয়েছে-না স্য্যার?
অসাধারণ বলেছ। তবে তুমি এ মুহূর্তে angry না। সুতরাং, তোমার সংজ্ঞার্থমতে ক্ষুধার্তও না।
সত্যি ক্ষুধার্ত। আপনার ভয়ে রাগছি না।
সকাল থেকে এ পর্যন্ত কী কী খেয়েছ?
ব্রেকফাস্টে দুটো ডিম, গোরুর মাংস, ডাল, সবজি, পরোটা, দুটো কলা, একটা আপেল আর এক গ্লাস দুধ। স্কুলে যাবার সময় খেয়েছি ভাত, মাছ, ডাল, সবজি, মুরগির মাংস। টিফিনে খেয়েছি পাউরুটি, কমলার জুস, কলা, পেয়ারা, আপেল, চকলেট আর বাদাম। সারাদিন আর কিছু খায়নি।
প্রতিদিন ১৮০০ কিলো-ক্যালরির কম খাওয়া হলে তাকে ক্ষুধার্ত বলে। তুমি এর মধ্যে ৩০০০ কিলো-ক্যালরির খেয়ে ফেলেছ। যার দাম দশ ডলারের বেশি। অথচ বিশ্বের এক বিলয়ন মানুষের মাথাপিছু দৈনিক আয় ১.২৫ ডলারের কম। তুমি ক্ষুধার্ত নও।
“স্যার”, সেলিমা বলল, পৃথিবীতে এত কম উৎপাদন হয়?
না। পৃথবীতে যত খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে তা সমানভাবে ভাগ করে দিলে প্রত্যেকে পাবে ২৭৯০ কিলো-ক্যালরি। বণ্টন-বৈষম্যের কারণে এক বিলিয়ন মানুষকে চরম ক্ষুধায় দিনতিপাত করতে হয়। অপুষ্টিতে অল্প বয়সে মারা যায়।
বাকি খাদ্য কোথায় যায়?
প্রতিবছর নষ্ট হয় এক ট্রিয়িন ডলার মূল্যের খাদ্য। তাছাড়া কুকুরকে খাওয়ায়, বিড়ালকে খাওয়ায়, বিলাস করে। সাহেদ, তুমি তো জানো তোমার খিদে লাগে, তো খেয়ে এলে-না কেন?
সেলিমা বলল, স্যার, নিউটনের মতো সেও মাঝে মাঝে খেতে ভুলে যায়।
খাওয়ার মধ্যেও নিউটন? আমি বললাম।
জি স্যার। সর্বত্রই নিউটন। তিনিই পৃথিবীর একমাত্র বিজ্ঞানী যাকে বাদ দিয়ে ক্লাস ওয়ানের বিজ্ঞান বই লেখাও সম্ভব নয়। নামটা সহজ হওয়ায় সহজে মনে রাখা যায়— নিউটন। কী সুন্দর! তাই না স্যার?
ক্ষুধার সঙ্গে নিউটনের কী সম্পর্ক?
সেলিমা বলল, একদিন সার, কী হলো বলব?
না বললে শিখব কীভাবে?
নিউটন তার এক বন্ধুকে ডিনারের দাওয়াত দিলেন। খাবার রেডি করে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এসময় জরুরি একটা কাজের কথা মনে পড়ায় ল্যাবে চলে গেলেন। রুমের দরজায় চাবি দিতেও ভুলে গেলন।
সাহেদ বলল, তালা না চাবি? কোনটা দিতে ভুলে গেলেন?
তালা দেবে কেন? জ্ঞানীরা কেবল মুখে তালা দেয়। আর সবখানে দেয় চাবি। তোমার দরজায় তুমি কি কখনো তালা দিয়েছ?
না। আমি চাবি দিয় বের হই।
নিউটনও চাবি দিয়ে বের হতেন। রবীন্দ্রনাথও চাবি দিয়ে বের হতেন: ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে- – -। তাই না স্যার?
আমি বললাম, নজরুলও চাবি লাগানোর কথা বলেছেন—
“তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু, নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!”
তারপর কী হলো জানেন স্যার? বন্ধু এসে দেখলেন, খাবার রেডি।নিউটনের দেরি হচ্ছে দেখে খেয়েদেয়ে প্লেটগুলো আগের মতো সাজিয়ে নিউটনের বেড রুমে এসে বসলেন। কিছুক্ষণ পর নিউটন এলেন। ক্ষুধায় পেট তাঁর চো চো করছিল। প্লেট উল্টিয়ে দেখলেন— খালি। কিন্তু কেন খালি তা কোনোভাবে বুঝতে পারছিলেন না। শেষে সিদ্ধান্ত নিলেন, খাবারগুলো তিনি খেয়ে ফেলেছেন। এজন্য খালি। এবার ঘুমাতে যাবার পালা। বেড রুমে এসে বন্ধুকে দেখে নিউটনের সব কথা মনে পড়ে গেল, তুমি দোস্ত আমার অনেক বড়ো একটা সমস্যার সমাধান করে দিয়েছ। বিশাল আবিষ্কার। থ্যাংক ইউ।
কী? বন্ধু সবিস্ময়ে জানতে চাইলেন।
তুমি না এলে আমি কখনো জানতেই পারতাম না যে, খাবারগুলো আমি খাইনি।
কিন্তু আমি না-এলে তোমার যে এ সমস্যায় পড়তে হতো না— এটা চিন্তা করেছ?
আমি তোমার মতো বোকা না কি যে, বাজে ভাবনায় সময় নষ্ট করব?
সাহেদ বলল, নিউটন কি অবিবাহিত ছিলেন?
স্টোরি নামের এক মহিলার সঙ্গে বাগ্‌দান হয়েছিল। কিন্তু বিয়ে হয়নি।
আমি সেলিমাকে বললাম, নিউটন কেন বিয়ে করেননি তা কি তুমি জান?
বলুন।
অনেকে বলেন, তিনি নপুংসক ছিলন। তা ঠিক নয়। আসলে, নিউটন ছিলেন সাংঘাতিক রগচটা এবং অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কেউ সামন্য সমালোচনা করলেই তাকে শত্রু ঘোষণ করতেন। তাই তার বন্ধুর সংখ্যা ছিল খুবই কম। একদিন স্টোরি নিউটনকে বললেন, “তুমি সোনা খুব রগচটা।” নিউটন একথা শোনামাত্র স্টোরিকে শত্রু ঘোষণা করে রুম থেকে বের করে দিলেন। তাদের আর দেখা হয়নি।
স্যার, আমি রগচটা নই, সেলিমা বলল।
সাহেদ, তুমি খেয়ে আস।
যাব না। আমি তো স্যার ক্ষুধার্ত নই। পড়া ফাঁকি দেওয়ার জন্য খাইনি। এখন মনে হচ্ছে, এটা উচিত নয়। আপনি চলে যাবার পর খাব। এখন গেলে অনেক কিছু শিখতে পারব না।
সেলিমা বলল, পড়াতে জানলে পড়ার চেয়ে আনন্দের আর কিছু হয় না। পড়া স্যার শুধু মনকে বড়ো করে না, গভীরতাও দেয়। সাহেদের মতো ছেলেও এখন পড়ার জন্য খেলা ছাড়তে প্রস্তুত। থ্যাংক ইউ স্যার।
আমি অবাক হয়ে সেলিমাকে শুনছি আর ভাবছি আনমনে।
কী ভাবছেন?
কিছু না।
জানি, আপনি কী ভাবছেন। আপনি স্যার অল্পদিনের মধ্যে আমাদের অনেক আপন হয়ে গেছেন। আমি আপনাকে লাইন বাই লাইন পড়তে পারি। আচ্ছা স্যার, আমি সুখী হতে না পারলে কার কী হবে?
নিউটন না জন্মালে কী হতো?
আপনি স্যার আমাকে উপহাস করছেন।
না। সুখী হতে না পারা মানে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে না-পারা। এমন হলে তুমি শেষ হয়ে যাবে কিংবা কেউ তোমাকে শেষ করে দেবে। তখন পৃথিবী তোমার মতো অতুলনীয় মেধাবীর অবদান থেকে বঞ্চিত হবে।
সেলিমা বলল, নিউটন মারা যাবার প্রায় একশ বছর পর ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর একটা দাঁত তিন হাজার ছয়শ ডলারে বিক্রি হয়েছিল। বর্তমান বাজারমূল্যে যা চল্লিশ হাজার ডলার। মানে বত্রিশ লাখ টাকা। অবাক না স্যার?
সাহেদ বলল, যার মগজের দাম বেশি তার নখের দামও বেড়ে যায়।
নিউটনের বিরুদ্ধে কুম্ভিলকবৃত্তির অভিযোগ আছে। জানো?
জি, স্যার। নিউটনের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানী গটফ্রিড লাইবনিৎস এবং ফ্লামস্টিডের গবেষণা বিষয়ে কিছু মূল্যবান তত্ত্ব গোপন করার অভিযোগ উঠেছিল। নিউটন তাদের বঞ্চিত করেছিলেন।
এ তথ্য কোত্থেকে জানলে?
স্টিভেন হকিং লিখেছেন— অ্যা ব্রিফ হিস্টোরি অব টাইম গ্রন্থে। বইটি স্যার আপনি পড়েছেন?
না।
আপনাকে দেব। লন্ডন থেকে আনিয়েছি।
থ্যাংক ইউ।
এখন নিয়ে আসি?
মোর অ্যান্ড মোর থ্যাংক ইউ।

Language
error: Content is protected !!