২৭
নন্দীর হাট এলাকার নন্দী-দিঘির দক্ষিণ পাড়ে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়ক-সংলগ্ন একটি একতলা বাড়ি আমাদের মেস। মালিক সপরিবারে থাকার জন্য বাড়িটি করেছিলেন। কিন্তু মহাসড়ক-সংলগ্ন এবং আশেপাশে কোনো ঘরবাড়ি না-থাকায় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সপরিবারে থাকার সাহস করেননি।
বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম মেসের সামনে। হঠাৎ দেখি সাহেদ। গাড়ি থেকে নেমে গেইট ঠেলে মেসে ঢুকতে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে আর ঢুকল না। দুজন পরস্পরের দিকে এগিয়ে গেলাম দ্রুত। বড়ো লোকের ছেলে। সে আগে কখনো আমার মেসে আসেনি। তাই অবাক হলাম। আমার আবেগ টলমল করছে সেলিমার ভাই সাহেদকে দেখে। সাহেদ নয়, যেন অর্ধেক সেলিমা।
গলার ওপর বসানো মুখে সেলিমার হাসি অমলিন।
কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, কেমন আছ?
ভালো।
বাড়ির সবাই?
ভালো।
সেলিমা?
আপনার কাছে এসেছি।
সেলিমা কোথায় ভর্তি হয়েছে? নিশ্চয় আমাকে তা জানানোর জন্য পাঠিয়েছে, তাই না? তার রেজাল্টটা পর্যন্ত জানতে পারলাম না।
সে নবম স্থান অধিকার করে স্ট্যান্ড করেছে।
ওয়াও! আমার সুখের নদী বাধ ভেঙেছে, সীমাহীন আজ বাও; ওয়াও। তুমি এখন কোন ক্লাসে?
আমি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছি। গাড়ির ব্যাবসা করছি। বিদেশ থেকে রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানি করি। গাড়ির পুরো পারিবারিক ব্যাবসাটা বাবা আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
সেলিমা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে? তার তো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে কখনো ছিল না। সাহেদ কেঁদে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে।
কাঁদছ কেন?
ওমরাহ হজ থেকে আসার পর আপু কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য জেদ ধরল। স্বামী কেবলা হুজুর ভর্তি হতে দেবেন না। সেলিমাও ছাড়ার পাত্র নয়। আপনি তো জানেন আপুকে। তার স্বামী প্রতিবছর অনেক মৃত বা মুমূর্ষু ধনীর বদলি হজ করতে যান। বদলি হজ থেকে প্রতিবছর প্রচুর টাকা আয় করেন। হজে গেলে সাধারণত তিন-চার মাসের আগে আসেন না। গত বার কেবলা হুজুর বদলি হজ করতে যাবার কয়েক দিন পর সেলিমা আপু নিজে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে গেলেন।
সেলিমা একটা কাজের কাজ করেছে। বীর নারী। আমি শুনেছি।
কার কাছে শুনেছেন?
খবর কি ভাই গোপন থাকে? ওসব লম্বা কথা বাদ দাও। সে কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে বলো। আমি থাকে দেখতে যাব। কতদিন দেখি না।
ছয় মাস পর দুলাভাই কেবলা হুজুর হজ থেকে ফিরলেন। জানতে পারলেন আপু তার অনুমতি ছাড়াই কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে এবং এইচএসসি পরীক্ষাও দিয়ে দিছে। তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলেন। মাকে ফোন করে বললেন, “তার অনুমতি ছাড়া কলেজে ভর্তি হয়ে সেলিমা বেশ্যা হয়ে গেছে। তাকে তওবা করতে হবে। আবার হজে গিয়ে নিষ্পাপ করে আনতে হবে।”
তারপর?
কেবলা হুজুর আপুকে বললেন, “তুমি আমার অনুমতি ছাড়া কলেজে ভর্তি হয়ে ইসলামি ফরজের বরখেলাপ করেছ। নবিজির নির্দেশ অমান্য করেছ। হাজার হাজার পরপুরুষ তোমাকে দেখেছে। তোমাকে হজ করিয়ে আমি নিষ্পাপ করে এনেছিলাম, কিন্তু আবার পাপিষ্ঠা হয়ে গেলে।” আপু বলেছিল, “আমি ফরজের খেলাপ করিনি, বরং কায়েম করছি। বোরকা পরে গিয়েছে। পর্দাবিষয়ক ইসলামের নির্দেশনা শতভাগ মেনে চলছি। কোনো পরপুরুষ আমাকে দেখতে পায়নি। প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য জ্ঞান অর্জন ফরজ। ”
“এটি ইসলামি জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। বেশ্যা মাগি, তুই হাদিসের কী বুঝবি?” বলে হিতাহিত বোধহারা অমানুষ কেবলা হুজুর, সেলিমা আপুর বুকে প্রচণ্ড জোরে লাথি দিলেন। প্র্যাগন্যান্ট ছিল আপু। ঢলে পড়ল মাটিতে।
তারপর!
ডাক্তারের কাছে নিতে হলো না। কয়েক মিনিটের মধ্যে সব শেষ।
শেষ মানে?
আপু মারা গেল। মারা যাবার চার দিন পর এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিল। আপু নবম স্থান অধিকার করে পাশ করল।
বুক আমার উলট-পালট। মনে হচ্ছে, ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র তাদের পাথুরে ওজন-সহ আমার ওপর ভেঙে পড়ল। আমি কষ্ট পাচ্ছি, কিন্তু মরছি না। আমি নড়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু অসহ্য ব্যথার জন্য নড়তে পারছি না। আমার প্রচণ্ড খিদে, কিন্তু খেতে পারছি না। আমাকে আমি ভুলে গেলাম পুরোটাই, “তোমরা কী করলে?” চিৎকার দিলাম কেবলা হুজুরের মতো হিতাহিত বোধ হারিয়ে। ভয় পেয়ে গেল সাহেদ।
কাঁপুনি গলায় বলল, আমাদের খবর দেওয়া হলো। আমরা গেলাম। শ্বশুর বাড়ির সবাই জানাল— হার্টফেল করে মারা গেছে। অনেক ভালো মেয়ে ছিল, এমন বউ হয় না, কী ভালো রেজাল্ট করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই বিশ্বাস করল তাদের কথা। সবার সামনে সেলিমা আপুকে মহা শোকের আবেগে মায়াকান্না কেঁদে কেঁদে কবরে নিয়ে যাওয়া হলো।
সেলিমা তার হাসব্যান্ডের আঘাতে মারা গেছে—একথা কীভাবে জানলে?
সেলিমা আপুর স্বামীর বড়ো ভাইয়ের বউ ফাতিমা আপা আমাদের গ্রামের মেয়ে। পরশু তিনি বাড়ি এসে এসব কথা জানিয়েছেন। ঘটনার দিনই জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে আমাদের সামনে আসতে দেওয়া হয়নি। একটা ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। সেলিমার সঙ্গে কেবলা হুজুরের ঝগড়াকালে ফাতিমা আপু ওই রুমে ছিলেন।
এখন কী করবে?
আমি কী করব? অনেকে বললেন, মামলা করে দিতে। বাবা-মা রাজি না। অভিযোগ করলে কবর থেকে লাশ তোলা হবে। এটি হবে চূড়ান্ত অপমান। বাবার কথা— হায়াত মউত রিজিক দওলত আল্লাহর হাতে। আল্লাহর হুকুম হয়েছে— সেলিমা মারা গেছে। আমাদের আর কিছু করার নেই।
একজন খুনি পার পেয়ে যাবে?
এটাও আল্লাহর হুকুম। তার হুকুম ছাড়া ধুলোবলিও নড়ে না। আল্লাহ যদি তাকে পার পাইয়ে দেন তো আমরা কী করব?
এসব তুমি বিশ্বাস কর?
আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু যায় আসে না। বাবা জীবিত। তিনিও মামলা করবেন না। তাহের ভাইয়াও সবার অমতে গিয়ে কিছু করতে চাইছে না। করতে চাইলেও পারবে না। মাও বাবার দলে। তাহের ভাইয়া একজন অ্যাডভোকেটের সঙ্গে আলাপ করেছে। তিনি বলেছেন, অভিযোগ করলেও অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। সাক্ষি পাওয়া যাবে না। আলামতও দুর্বল হয়ে গেছে। মার্ডার কেসের প্রমাণের জন্য এ দুটি খুব স্ট্রং হতে হয়। চার মাস হয়ে গেছে ঘটনা। কবর থেকে লাশ তুললে আঘাতের চিহ্ন নাও পাওয়া যেতে পারে।
আবার চিৎকার দিলাম, তুমি এই খবর দিতে এসেছ?
না।
মজা করতে এসেছ?
সেলিমা আপু একটা চিঠি দিয়েছে। তা দিতে এসেছি।
কখন দিয়েছে? কবর থেকে?
বিয়ের আগে।
এতদিন দিলে না যে?
মা নিষেধ করেছিল দিতে। তাই দেইনি। কিন্তু আপু জানে আপনি চিঠিটা পেয়েছেন।
সেলিমা লিখেছে অনেক বড়ো চিঠি। বরাবর ছয় পৃষ্ঠা, মানে তিন পাতা। আমার সেলিমার এত বড়ো চিঠি শোনার ধৈর্য আমার আছে। আপনাদের থাকার কথা নয়। তাই শুধু কিয়দংশ বলছি—
“স্যার, আমি বিয়ে করতে চাই না। সাহেদকে বলুন, আমি কোথায় আসব। আপনি যেখানে বলবেন, সেখানে চলে আসব। আমি পড়তে চাই। আমি বাঁচতে চাই। প্রতিটি দিন নতুন কিছু শেখার জন্য। আগামীকাল যদি বলতে না-পারি গতকাল নতুন কিছু শিখেছি। সে জীবন রেখে লাভ কী? না-পড়ে থাকা জীবনের চেয়ে মরে যাওয়া বেহতর। আপনি যদি না আসেন আমি পড়তে পারব না। পড়তে না পারলে বাঁচতেও পারব না। খুব তাড়াতাড়ি মরে যেতে হবে। স্যার, আমাকে বাঁচতে দেবেন না? আপনি ছাড়া আমি কাউকে দেখেতে পাচ্ছি না।- – – ”
পাথর হয়ে গেলাম। কান্না, শোক, কষ্ট কিছুই অনুভূত হচ্ছে না। পাথরের এসব নেই। চিঠি পড়ে নিজেকে প্রশ্ন করলাম—
চিঠিখানা যথাসময়ে পেলে আমি কী করতাম? সত্যি কি সাড়া দিতাম?আমি কি সেলিমাকে রক্ষা করতে পারতাম?
পারতাম কি না সেটি অন্য কথা। তবে সেলিমা জীবদ্দশায় জেনে গেছে আমি তার চিঠি পেয়েও সাড়া দেইনি। এটাই আমার সবচেয়ে বড়ো কষ্ট। কী ভেবেছে সে আমাকে নিয়ে! কী অতৃপ্তি নিয়ে তাকে মরে যেতে হলো! এটাই আমাকে প্রমিথিউসের ইগলের মতো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে। কিন্তু আমি মরছি না, শুধু কষ্ট পাচ্ছি। সেলিমার চিঠি আমার কাছে প্রমিথিউসের ইগল হয়ে আছে এখনো। মনে পড়ে ঘুমে, মনে পড়ে জাগড়নে। মনে পড়ে কোলাহলে, মনে পরে নির্জনে। মনে পড়ে সর্বদা—
আমি একটা অথর্ব, দুঃসহ
কী কষ্ট-করুণ,
উহ!
-সমাপ্ত-
https://draminbd.com/নিউটনের-ছাত্রী-এক-মলাটে-ন/
All Link : শুবাচে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ লেখা
All Links/2 শুবাচির প্রশ্ন থেকে উত্তর
১. স্যমন্তক: এক মলাটে স্যমন্তক সম্পূর্ণ উপন্যাস একসঙ্গে।
২. অর্হণা: অর্হণা : এক মলাটে সম্পূর্ণ উপন্যাস অর্হণা।
৩. সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব।
৪. তিনে দুয়ে দশ: তিনে দুয়ে দশ সম্পূর্ণ উপন্যাস একসঙ্গে।
৫. তিনে দুয়ে দশ: এক মলাটে নিউটনের ছাত্রী সমগ্র পর্ব
ত্রয়ী কিশোর উপন্যাস
২. নিউটনের ছাত্রী, প্রকাশক: পুথিনিলয়।ত্রয়ী কিশোর উপন্যাস
১. তিনে দুয়ে দশ, প্রকাশক: পুথিনিলয়।ত্রয়ী কিশোর উপন্যাস
৩. অলৌকিক শিশু, প্রকাশক: পুথিনিলয়।