৫
মিনিট দশেক পর একটা মেয়ে রুমে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে পুরো রুম নরম একটা সুগন্ধে সচকিত । ধরে নিলাম একেই পড়াতে হবে। আমি আড়নয়নে তাকালাম।
মেয়ে না বলে বলা উচিত— রঙহীন রঙে, রঙে রঙে রঞ্জিত নিশপিশ বালিকা। দাঁত তার হাসির চেয়ে সুন্দর। আসলে সে বালিকা নয়, ষোড়শী— অনিন্দ্য সুন্দর; শ্যামল শ্যামলিমার চোখ জুড়ানো উপত্যাকা। গ্রামে এমন মেয়েদের কালো বলে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে— বালিকা। কানে কোনো অলংকার নেই। নাকেও দুল নেই কোনো, কেবল একটা নাকফুল শোভা পাচ্ছে। খুব সাদা। চকচক করছে আলো পড়ে তাতে। মাথায় কালো চুলের ঠাসাঠাসি ঝগড়া। বিস্তৃত কপালে কয়েক গন্ডা কালো চুল ইঁদুর নৃত্যে ছুটোছুটি করছে বেআক্কেল উন্মাদের মতো।
কালো চুল কালো ফুল, নেই তাতে কোনো ভুল—
দেখছে সবাই বিভোর হয়ে কৃষ্ণ তমাল চুল।
কন্যা ভেবে পিতা, বোন ভেবে ভাই আকুল
চিনতে তবু মায়ায় মায়ায়
হয় না কারো ভুল।
বেঁটে বলা যাবে না। কেউ বেঁটে বললে আমি প্রচণ্ড প্রতিবাদ করব। মেয়েরা বেশি লম্বা হলে ভালো দেখায় না। চুলের আঁধাররাশি চোখের মমতায় অমাবস্যা। ফ্যানের বাতাসে সাদা ওড়নাটি কাঁপছে। হাত মুখ আর অবয়বের সঙ্গে উচ্চতার মিশেল— একশব্দে অসাধারণ।
আমি আরো ভালোভাবে দেখার আগে মেয়েটি হাসি আর দাঁতকে আলোর মতো ছড়িয়ে দিয়ে বলল, আসসালামুআলাইকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম সালাম।
কেমন আছেন স্যার?
ভালো। তুমি কেমন আছ?
আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বলল, আমি আপনার নাম জানি।
কীভাবে?
ওমরের কাছে শুনেছি। বরাতে থাকলে আমিই আপনার ছাত্রী হব।
বরাত মানে!
ভাগ্য।
তোমার নাম?
সেলিমা আক্তার। সবাই সেলি ডাকে।
শেলি।
পার্সি বিশি শেলির শেলি নই। শেলি কখন জন্মগ্রহণ করেছেন জানেন স্যার?
সেলির প্রশ্নে আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। বেশি কথা বলার শাস্তি। জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেটি আমি খুব কম পারি।
বললাম, মনে নেই।
১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা আগস্ট সাসেক্সের হরসেমে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর বাবা ছিলেন এমপি। ইটন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। আগুন-মেধার ফাগুন লোক। ১৮১১ খ্রিষ্টাব্দে নাস্তিকতাকে সমর্থন করে একটি পুস্তিকা লিখেছিলেন। এজন্য তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। শেলি মারাত্মক বিদ্রোহী ছিলেন। আমি তাঁকে সমর্থন করি, কিন্তু অনুসরণ করতে পারি না।
কেন?
মনে মনে নীরব-নিভৃতে সমর্থন করা যায়, কিন্তু মনে মনে অনুসরণ করা যায় না। অনুসরণ করতে হলে ইচ্ছা, সাহস এবং পরিবেশ তিনটাই অনিবার্য। আমার ইচ্ছা আছে সাহসও আছে, কিন্তু পরিবেশ নেই।
বসো।
আমার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে সেলিমা মিষ্টি হাসির এক ঝলক আলো সুগন্ধের সঙ্গে মিশিয়ে সাদর শ্রদ্ধায় বলল, থ্যাংক ইউ স্যার।
ওয়েলকাম।
স্যার, আপনি কি জানেন আমি— নিউটনের ছাত্রী?
কার ছাত্রী?
নিউটন।
কী?
গনি কোম্পানি, সরি; গনি ভাইয়া বলেন— আমি নিউটনের ছাত্রী। এবার ক্লাস টেন মানে নিউটেনে উঠেছি। নিউটেন বলতে গিয়ে গনি ভাইয়া নিউটন বলে ফেলেন। এ আর কী! তার বস্তা বস্তা টাকা আছে, কিন্তু আনুষ্ঠানিক সনদ নেই। খুব মজা; না স্যার?
মজা হবে কেন?
সনদের সঙ্গে টাকা পয়সার সম্পর্কটা সাধারণত ভাইস-ভার্সা হয়। আমাদের বাংলাদেশে আল্লাহ যাকে টাকা দেন তাকে নাকি সনদ দেন না। সনদধারীদের টাকা হলে তারা জানোয়ার হয়ে যায়। এজন্য বৈচারিক ক্ষমতা আর পেঠানোর ক্ষমতা এক হাতে রাখা হয় না। তাই গনি ভাইয়ার নিউটেন এ-কারহীন হয়ে গেছে। কিন্তু তার ‘টাকা’ বানানের ক-য়ে আ-কার ঠিকই রেখে দেয়। যদিও ইদানীং তার মাথা পুরোটাই আ-কারহীন টাকা।
এরকম হতে পারে। এটাকে বলে বর্ণ বিপর্যয়।
আমার বাবার নাম কী জানেন?
জানি না।
গণি কোম্পানি।
তোমার বড়ো ভাইয়ের নামও তো গনি কোম্পানি।
এখানেই তো মজা স্যার। আমার বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন— ছেলের নাম গনি রাখলে ধনী হতে পারবেন। ঠিকই স্যার, গনি ভাই এর নাম গনি রাখার পর বাবার ধন দৌলত বাড়তে বাড়তে বেড়ার বাড়িটা প্রসাদ হয়ে গেল। তিন কাঠার ভিটা হয়ে গেল ত্রিশ কাঠা। গাড়ি হলো গন্ডা গন্ডা। ট্রাক হলো ডজন ডজন। পা হয়ে গেল পাজেরো জিপ।
দুজনের নামের বানান একই— সমস্যা হয় না?
একই না তো স্যার। বড়ো ভাইয়ার গনি বানানে দন্ত্য-ন এবং বাবার নামের গণি বানানে মূর্ধন্য-ণ। তবে সমস্যা একটা আছে।
কী?
বাঙালিরা মূর্ধন্য-ণ উচ্চারণ করতে পারে না। তাদের কাছে উচ্চারণগতভাবে দন্ত্য-ন এবং মূর্ধন্য-ণ অভিন্ন। আইজাক নিউটনের বাবার নামও ছিলেন আইজাক নিউটন। বানানও একই। তবে ওই কারণ আর আমাদের এই কারণ এক নয়।
আইজাক নিউটনের কী কারণ?
তাও জানেন না স্যার?
জানি না। তোমার মতো এত বই সংগ্রহের সামর্থ্য আমার নেই।
নিউটন জন্মগ্রহণ করার তিন মাস ছয় দিন আগে তাঁর বাবা আইজাক নিউটন মারা গেলেন। নিউটনের বিধবা মা হান্না অ্যাসকো স্বামী আইজাক নিউটনের স্মৃতিকে জীবিত রাখার জন্য সদ্যপ্রসূত শিশুর নাম রাখলেন আইজ্যাক নিউটন। হান্নার ইচ্ছা সফল হয়েছিল। নিউটন তাঁর বাবার স্মৃতি জীবিত রাখার কাজটি এত ভালোভাবে করেছেন যে, পৃথিবীর খুব কম লোকের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছিল। তারপর আর একটা বিয়ে করেন আইজাক নিউটনের মা।
এ বয়সে তুমি অনেক কিছু জান।
আপনি কী স্যার জানেন, আমার সৎ মা আছে?
জানি না।
তাকে আমরা বড়ো মা ডাকি। বাবার প্রথম বউ।
“আমার এসব জানার প্রয়োজন নেই।”, আকস্মিক বলে দিলাম। বলে দিয়ে বুঝলাম একদম উচিত হয়নি। জিহ্বা ফালতুর মতো খুব হালকা এবং তাই অযথা নড়াচড়া করে। এটিই সব সমস্যার উৎস।
“সবকিছুতে প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করা ঠিক নয় স্যার”, সেলিমা বলল, “যারা জানাকে অপ্রয়োজন মনে করেন তারা আজীবন মূর্খ থেকে যান। আমি কিন্তু আপনাকে মূর্খ বলছি না। আমাকে ভালোভাবে না-জানলে ভালোভাবে পড়াবেন কীভাবে? জমির প্রকৃতি না জেনে ফসল ফলানোর চেষ্টা স্রেফ বোকামি। আমি কি স্যার ভুল বলেছি?”
ভীষণ লজ্জা পেলাম সেলিমার কথায়। জিহ্বাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। জিহ্বা তো আমারই। সেলিমার প্রতিটি কথা ঠিক। এত ঠিক যে, লজ্জা পাওয়া যায়, কিন্তু প্রতিবাদ করা যায় না। একদম উচিত সাজা হয়েছে আমার।
স্যার, লজ্জা পেয়েছেন?
মিনমিনে গলায় বললাম, এমন অবস্থায় পড়লে তুমিও লজ্জা পেতে।
সরি, সরি স্যার।
ইটস ওকে।
স্যার, ওকে শব্দটি কীভাবে এল?
এটি ইংরেজি অল কারেক্ট শব্দের বিকৃত রূপ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসনের নির্বচন প্রচারের প্রেসনোটে তাড়াহুড়োর মধ্যে ভুলে All Correct কথাটি Oll Korrect হয়ে যায়।