ড. মোহাম্মদ আমীন
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘কোণ’ শব্দের অর্থ (১) পরস্পর মিলিত দুটি সরলরেখার মধ্যবর্তী স্থান, কোনা; (২) দুই পার্শ্বের মিলনস্থান (ঘরের কোণ), (৩) সূক্ষ্ণ প্রান্ত (আঁখিকোণ), (৪) অস্ত্রাদির অগ্রভাগ (ছুরির কোণ), (৫) খুঁট (কাপড়ের কোণ), (৬) গৃহাভ্যন্তর, অন্তঃপুর প্রভৃতি।
অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘কোনা’ শব্দের দুটি পৃথক ভুক্তি পাওয়া যায়। প্রথম ভুক্তিমতে, সংস্কৃত ‘কোণ’ থেকে উদ্ভূত ‘কোনা’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে প্রান্ত, ধার (কোনাকুনি), এবং বিশেষণে কোণযুক্ত, কোণবিশিষ্ট প্রভৃতি। দ্বিতীয় ভুক্তি অনুযায়ী ‘কোনা’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে (১) তিনশত পানপাতার গুচ্ছ, (২) ধান মাপর পাত্র, (৩) ঘরের চাল ধরে রাখার জন্য মাটিতে পোঁতা খুঁটি প্রভৃতি। তবে দ্বিতীয় ভুক্তির অর্থগুলো আলোচ্য বর্ণনায় প্রাসঙ্গিক নয়।
বর্ণিত ‘কোণ’ ও ‘কোনা’ শব্দের অভিধার্থ হতে দেখা যায়, ‘কোণ’ শব্দের একটি অর্থ কোনা। সুতরাং ‘কোণ’ ও ‘কোনা’ ক্ষেত্রবিশেষে সমার্থক। তবে ‘কোণ’ তৎসম এবং ‘কোনা’ অতৎসম শব্দ। এবার দেখা যাক, নেত্রকোণা না কি নেত্রকোনা। অভিধানে ‘কোণ’ শব্দ পাওয়া যায়, কিন্তু ‘কোণা’ শব্দ পাওয়া যায় না। কিন্তু ‘কোনা’ শব্দ পাওয়া যায়, যা ‘কোণ’ শব্দের সমার্থক।
এ আলোচনা থেকে বলা যায়, অভিধার্থ মতে ‘নেত্রকোণ’ হতে পারে, কিন্তু নেত্রকোণা হতে পারে না। কারণ, কোণা’ শব্দটির কোনো অভিধার্থ নেই। অধিকন্তু, অতৎসম শব্দের বানানে সাধারণত মূর্ধন্য-ন বসে না। অতএব, অভিধার্থ বিবেচনায় ‘নেত্রকোনা’ হওয়াই যুক্তিযুক্ত। যদিও সংস্কৃত ‘নেত্র’ শব্দের সঙ্গে অতৎসম ‘কোনা’ যুক্ত হওয়াটা কিছুট অস্বাভাবিক। কিন্তু আলোচ্য নাম বর্ণনায় নেত্রকোনা শব্দটির উৎপত্তিতে সংস্কৃত বা তৎসম-অতৎসম কোনো বিবেচনা ছিল না। কেন ছিল না তা নেত্রকোনা জেলার নামকরণ বিবেচনা করলে বোঝা যায়। এখন দেখা যাক, নামকরণ ইতিহাস বিবেচনায় জেলার নাম হিসেবে সার্বিক বিবেচনায় ‘নেত্রকোনা’ নামটি কতটুকু যৌক্তিক।
নেত্রকোনা হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের একটি জেলা। একসময় এটি থানা এবং মহকুমা ছিল। ইংরেজ আমলে ইংরেজদের কাছে এলাকাটি ‘নাটোরকোনা’ নামে পরিচিত ছিল। যার অপভ্রংশ নেত্রকোনা। এটি তৎসম নয়। নেত্রকোনা থানা সদর মগরা নদীর বাঁকে অবস্থিত। নদীর বাঁক স্থানীয় ভাষায় নদীর কোনা নামে পরিচিত। মগরা নদীর কোনায় এলাকাটি অবস্থিত ছিল। তাই স্থানীয় লোকজন এলাকাটিকে ‘নদীর কোনা’ নামে অভিহিত করে। যা আস্তে আস্তে নদীরকোনা> নতেরকোনা> নেতেরকোনা>নেতরকোনা এবং অবশেষে নেত্রকোনা নামে স্থিতি পায়। নেত্রকোনা নামকরণের আর একটি প্রবাদ নেত্র প্রবাদ নামে পরিচিত। কথিত হয় মগড়া নদীর যে বাঁকে এলাকাটি গড়ে উঠে সেটি এক সময় অনেকটা নেত্র বা চোখের কোনার মত ছিল। তাই লোকজন মজা করে এলাকাটিকে নেত্রের কোনা নামে ডাকত। যা আস্তে আস্তে ‘নেত্রকোনা’ নামে স্থিতি পেয়ে যায়। সুতরাং ব্যাকরণ, অভিধান এবং নামকরণ ইতিহাস প্রভৃতি বিবেচনায় ‘নেত্রকোনা’ নামই যৌক্তিক।