ড. মোহাম্মদ আমীন
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত কতগুলো বিদেশি শব্দের সরাসরি কোনো প্রতিশব্দ না থাকায় ওই শব্দগুলোকে প্রকাশের জন্য যেসব বাংলা শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেগুলোকে পারিভাষিক শব্দ বলে। ‘পরিভাষা’ শব্দটি ইংরেজি ‘Terminology’ শব্দের প্রতিশব্দ। তবে পরিভাষা শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো ‘বিশেষ ভাষা’। বাংলা ভাষায় প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দকে পারিভাষিক শব্দ বলা হয়। অর্থাৎ, কোনো ভাষায় বিশেষ অর্থে ব্যবহারযোগ্য শব্দই পারিভাষিক শব্দ।মূল শব্দের মৌলিক অর্থ ও ভাবের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে এক ভাষার শব্দকে অন্য ভাষায় রূপান্তরিত করে যে অবয়ব প্রদান করা হয় তাকে পরিভাষা বলে এবং শব্দটিকে বলা হয় পারিভাষিক শব্দ। যেমন: ইংরেজি ‘Linguistics’ শব্দের বাংলা ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দ— ‘ভাষাবিজ্ঞান’, Cabinet শব্দের বাংলা পরিভাষা মন্ত্রিপরিষদ।
রাজশেখর বসু চলন্তিকা অভিধানে বলেছেন, “যে শব্দের দ্বারা সংক্ষেপে কোনও বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করা যায় তা পরিভাষা—- সাধারণত ‘পরিভাষা’ বললে এমন শব্দ বা শব্দাবলি বোঝায় যার অর্থ পণ্ডিতগণের সম্মতিতে স্থিরীকৃত হয়েছে এবং যা দর্শন বিজ্ঞানাদির আলোচনায় প্রয়োগ করলে অর্থবোধে সংশয় ঘটে না।”
বিশ্বের প্রায় সকল ভাষা কোনো-না-কোনোভাবে অন্য ভাষা থেকে ভাষিক উপাদান সংগ্রহ করে। সংগৃহীত উপাদানগুলোর মধ্যে পরিভাষা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। সাধারণত বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, ধর্মতত্ত্ব, ভাষাবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতি শাস্ত্রীয় বিষয়ের শব্দের প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট ভাষায় পরিভাষা তৈরি করা হয়ে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন নতুন ধারণা, বস্তুসামগ্রী, ঘটনা ইত্যাদির সংযোজন হচ্ছে। ফলে পরিভাষা তৈরিরও দরকার হচ্ছে। বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী প্রত্যেক ব্যক্তি দৈনন্দিন জীবনে অনেক পরিভাষিক শব্দ ব্যবহার করে থাকে। যেমন:Nurse – সেবিকা, Map – মানচিত্র, Notice – বিজ্ঞপ্তি, File – নথি, Pension – অবসরকালীন ভাতা, Volcano – আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি।
পরিভাষা বনাম শব্দ
পরিভাষা ও শব্দের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন: পরিভাষা দ্বারা বিশেষায়িত ক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক ধারণার নাম বুঝায়, পক্ষান্তরে শব্দ দ্বারা ভাষার ব্যবহৃত যে-কোনো অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে বুঝায়। মূলত পারিভাষিক শব্দগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাই সব পারিভাষিক শব্দই সাধারণ শব্দ, কিন্তু সব শব্দই পারিভাষিক শব্দ নয়।
পারিভাষিক শব্দের বৈশিষ্ট্য
১. পারিভাষিক শব্দ বিদেশি ভাষার শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দ।
২. পারিভাষিক শব্দ নির্দিষ্ট বিষয়ে স্থির, বিমূর্ত ও সাধারণ ধারণা প্রকাশ করে।
৩. পারিভাষিক শব্দের অর্থ ও প্রয়োগ সাধারণ শব্দের মতো নয়।
৪. পারিভার্ষিক শব্দ ভাষায় অন্যান্য শব্দের মতোই ভাষিক শব্দ তবে এর প্রয়োগ বিষয়ভিত্তিক।
৫. পারিভাষিক শব্দসমূহ সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানের প্রণালি বা পদ্ধতি আবিষ্কারের সঙ্গে সম্পর্কিত।
৬. ভাষায় ব্যবহৃত কতগুলো বিদেশি শব্দের সরাসরি কোনো প্রতিশব্দ না থাকায় ওই শব্দগুলোকে বোঝানোর জন্য যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেগুলোকে পারিভাষিক শব্দ।
পারিভাষিক শব্দের গুরুত্ব:
১. বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন বিদেশি শব্দের সরাসরি কোনো প্রতিশব্দ না থাকায় ওই শব্দগুলোকে প্রকাশের জন্য পারিভাষিক শব্দের আবশ্যকতা অনিবার্য।

২. জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক শব্দকেই বিশিষ্ট অর্থে বা পারিভাষিক শব্দরূপে গ্রহণ করা আবশ্যক।
৩. বাংলা ভাষার মধ্যে অনেক বিদেশি শব্দের সংমিশ্রণ ঘটেছে। এর মধ্য থেকে বাংলা শব্দভান্ডারে কিছু শব্দ গৃহীত হয়েছে আবার কিছু বর্জিত হয়েছে।
৪. পারিভাষিক শব্দ বাংলা ভাষার বিকল্প এবং সহজবোধ্যতার জন্য ব্যবহৃত হয়।
পারিভাষিক শব্দ বনাম বিদেশি শব্দ
পারিভাষিক শব্দ হলো বিশেষ জ্ঞানবিষয়ক মূল শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দ, যার দ্বারা বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আর বিদেশি শব্দ হলো কোনো ভাষার মূল শব্দ, যেটি অপরিবর্তিত অবস্থায় অন্য ভাষাতে পাওয়া যায়। যেমন: আনারস, আল্লাহ্, চা, চিনি এগুলো আমাদের ভাষায় অপরিবর্তিতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার ‘botany’, ‘cartoon’, ‘capital’ এসব শব্দের বাংলা করা হয়েছে উদ্ভিদবিদ্যা, ব্যঙ্গচিত্র, মূলধন বা রাজধানী। এগুলো হলো পরিভাষিক শব্দ।