ইউসুফ খান
পিলসুজ মানে ল্যাম্পস্ট্যান্ড নয়
পারসি-ফারসি, পলতে সলতে, পিলসুজ, ভেঁড়কো পিলসুজ মানে ল্যাম্পস্ট্যান্ড নয়
পারসি-ফারসি
পারসি ভাষা যেদিন থেকে আরবি লিপি নিল, সেদিন থেকে বেচারাদের প ফ এক হয়ে গেল। কারণ আরবিতে প নেই, শুধু ফ ف আছে। তাই আরবি সূত্রে খোদ পারসি ভাষাটাই কারো কারো কাছে পরিচিত হয়ে গেল ফারসি নামে। খাঁটি নোয়াখাইল্যারা প ফ দুটো আলাদা বর্ণ চোখে দ্যাখে কিন্তু দুটোকেই ফ উচ্চারণ করে, উল্টোদিকে খাঁটি পার্সিয়ানরা প ফ দুটোতেই ফ লেখা দেখে কিন্তু ঠিকমতো জায়গা বুঝে বুঝে প ফ ঠিকঠাক উচ্চারণ করে। এটা ওদের কয়েক শতাব্দীর কষ্ট ছিল। এখন এই ইউনিকোডের যুগে পারসিয়ানরা আরবি কোড টেবিলে প پ আলাদা কোড পয়েন্টে ঢুকিয়ে নিয়েছে। এখন ওরা এবং উর্দুওয়ালারা প ফ আলাদা লেখে।
সেমেটিক আরবিতে ও উ ৱ বোঝানোর জন্যও একটাই বর্ণ و । সেটাও আর্যভাষা পারসির পক্ষে খুবই বিড়ম্বনার। পারসিরা সেটাকেও ঠিক জায়গা বুঝে ও-উ-ৱ উচ্চারণ করে।
সুলতানি-বাদশাহি আমলে বাংলার লোকজন মূলত পারসি শিখতো, আরবি না। ব্রতকথায় ছড়া আছে ‘আরশি আরশি আরশি / আমার স্বামী যেন পড়ে ফারসি’। তাই চোখে আরবি অক্ষর দেখলেও জিভে পারসি উচ্চারণ ফারসি পড়া বাঙালি স্বামীরাও ঠিকঠাক পারত।
পলতে সলতে
পারসি পতিলা মানে পাকানো পেঁচানো টুইস্ট-করা। আরবিতে লেখা হতো فتیله ফ়তিলা, কিন্তু লোকজন ঠিক পারসি উচ্চারণ পতিলা করে নিত। যেহেতু প্রদীপের wick বানানো হতো তুলো বা পাতলা ন্যাকড়ার ফালি পাকিয়ে পাকিয়ে, তাই পাকানো wick filament বোঝাতে বাংলায় পতিলা কথাটা ব্যবহার হতো। এই পতিলা প্রথমে পলিতা হয়ে পরে পলতে হয়ে গেছে।
মা মাসিরা প্রদীপ জ্বালানোর আগে পলতের ডগাটাকে পাকিয়ে ছুঁচলো করে দিতেন। ছুঁচলো ডগাওয়ালা জিনিস বোঝাতে বাংলা কথাটা ছিল শলি। ছাতার শিকও শলি, টুথপিকও শলি। শলির কগনেট শব্দ কয়েকটা বেঁচে আছে – শলা শলাকা আর শূলে চড়ানোর শূল। তাই ছুঁচলো পলিতা মানে শলি-পলিতা। এই শলি-পলিতা>শলিতা এখন পতিলা বংশের একমাত্র ‘সলতে’ হয়ে জ্বলছে। ‘সলতে পাকানো’ ইডিয়ামটার মধ্যেও এই শলিতা পতিলা দুটোই লুকিয়ে আছে।
পিলসুজ
পারসি সুখ্তান سوختان মানে জ্বালানো পোড়ানো শুকোনো। যা জ্বলছে তা সুজ়-আনদান سوزاندن , পতিল-সুজ় فایل سوز পলতে- জ্বলন্ত, মানে জ্বলন্ত পলতে the burning wick. আরবিতে লেখা হতো ফ়তিল-সোজ় فایل سوز কিন্তু ফারসি পড়া বাঙালি এটার ঠিক পারসি উচ্চারণ করত পতিল-সুজ়। এই পতিল-সুজ় সোজা বাংলায় পিলসুজ। অর্থাৎ পিলসুজ এর পাতি বাংলা মানে – জ্বলন্ত পলতে। যোগরূঢ়ার্থে প্রদীপ।
ডেঁড়কো
বাংলা ডাণ্ডা, সাধুভাষায় দণ্ড। ড দ এর এই বদলা-বদলির অনেক উদাহরণ হয়। রাঢ়ে বৃষ্টি হলে রাস্তায় জল ‘ডাঁড়িয়ে’ যায়, পড়া না পারলে মাস্টার মশাই ছাত্রকে কান ধরে ‘ডাঁড়’ করিয়ে রাখেন। দু-আড়াই হাত লম্বা হাতলওয়ালা কোদাল, যার সাহায্যে বেশি না ঝুঁকে ডাঁড়িয়ে ডাঁড়িয়ে মাটি কোপানো যায় তা হচ্ছে ডেঁড়ো। রাঢ়ে আজও সম্পূর্ণ সজীব ডেঁড়ো কথাটা। এর দেঁড়ো রূপ নেই।
প্রদীপের আলো একটু বেশি করে ছড়ানোর জন্য প্রদীপকে একটু উঁচুতে তুলে দাঁড় = ডাঁড় করাতে কাঠের ডেঁড়কো দেড়কো ব্যবহার হতো। তলার বেসটা মোটা কাঠের, চওড়া ছড়ানো; মাঝখানে দাঁড় করানো সরু লম্বা কাঠের ডাণ্ডা, তার মাথায় প্রদীপ বসানোর জন্য একটা পাতলা কাঠ। এই হচ্ছে ডেঁড়কো।
আমি কাঠের ডেঁড়কো ব্যবহার করেছি। সে যুগে এর ফারসি নাম ছিল شمعدان শামাদান, পরে যার সংস্কৃতায়িত বাংলা করা হয়েছিল প্রদীপ-আধার দীপাধার। ডেঁড়কো-র ব্যুৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে এর সঙ্গে ধ্বনি মিলিয়ে রিভার্স এটিমোলজিতে করা হয়েছিল দীপবৃক্ষ।
দিন গেলে বাজারে মাটির প্রদীপের বদলে পিতলের প্রদীপ এবং কাঠের ডেঁড়কো-র বদলে পিতলের শৌখিন ডিজাইন করা ডেঁড়কো চলে এল। তারপর ধীরে ধীরে শেজবাতি লন্ঠন হ্যারিকেন চলে এলে রোজকার জীবনে প্রদীপের ব্যবহার কমে আসে। শুধু প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে বাড়ির ঠাকুরের সামনে পিতলের ডেঁড়কোতে পিতলের প্রদীপে তুলোর সলতে জ্বালানোর নিয়মটাই থেকে যায়। বাংলার জীবন থেকে ফারসি-ভাষা পিলসুজ শামাদান-ডেঁড়কো সব হারিয়ে যায়। গণজীবনে এবং গণমানসে এই অনুষঙ্গগুলো নেই বলে, ঠাকুরের সামনে টিকে থাকা দাঁড় করানো ডেঁড়কো প্লাস পিলসুজ মানে প্রদীপ দুটোকে লোকে একসঙ্গে পিলসুজ বলতে শেখে। আজকাল অনেকে ভুল করে পেতলের ডেঁড়কোটাকেই পিলসুজ বলে।
(ত্রুটি মার্জনীয়, শুদ্ধি প্রার্থনীয়)
উৎস: পিলসুজ মানে ল্যাম্পস্ট্যান্ড নয়, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
কলকাতা. ২০২০ জুলাই ০৭