ড. মোহাম্মদ আমীন
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়: আধুনিক গানের বিস্ময়
ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না, সেদিন নিশিথে বরিষণ শেষে, ও আমার চন্দ্রমল্লিকা, কে প্রথম কাছে এসেছে-এর মতো অসংখ্য কালজয়ী গানের লেখক পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মে হাওড়ার সালকিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করেন। তাঁর পিতা কান্তিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন নির্বাকযুগের অভিনেতা । পারিবারিক

কারণে শিল্পধর্মী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্ক শিশুবেলায় পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে। তিনি সতেরো বছর বয়সে চলচ্চিত্র পরিচালক সরোজ মুখোপাধ্যায়ের ‘অভিমান’ ছবির জন্য প্রথম গান লেখেন। কলেজ জীবনের শুরুতেই মাসিক ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। কবিতা দিয়ে শুরু হলেও অল্প দিনের মধ্যেই গীতিকার হিসেবেই সুপরিচিত হতে লাগলেন পুলক বাবু।
যে-কোনো পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ও তাৎক্ষণিকভাবে গান লেখার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। একবার পূজোর গান নিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে গেলেন পুলক বাবু। হেমন্ত পুলকবাবুকে দেখে বললেন, “পুলক, কতদিন পরে এলে; একটু বসো।” সেই কথাটাই গেঁথে গেল পুলক বাবুর মনে। লিখে ফেললেন: কতদিন পরে এলে একটু বসো, তোমায় অনেক কথা বলার ছিল যদিই শোনো।
মান্না দে’র সাথে পুলক বন্দোপাধ্যায়ের সাথে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। একবার এক অনুষ্ঠানে ভূপেন হাজারিকা মান্না দে-কে বললেন, “মান্না, কী করে তুমি এত সুন্দর করে গান গাও বলো তো?” উত্তরে মান্না দে বিনয়ের হাসি হেসে বলেছিলেন, “এই জীবনে যদি পুলকের জন্ম না হতো তাহলে মান্না দে’রও জন্ম হতো না”। মান্না দের বাড়িতে গিয়ে পুলক বাবু দেখলেন তিনি রান্নায় ব্যস্ত। তখন তিনি বসার ঘরে এসে কাগজে কিছু লিখে ফেললেন। মান্না দে কাছে আসতেই পড়ে শোনালেন সে লেখা। গানটি ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘প্রথম কদমফুল’ ছবিতে সুধীন দাশগুপ্তের সুরে মান্না দে গেয়েছিলেন “আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না”।
বাংলা গানের প্রায় সব প্রতিষ্ঠিত শিল্পীই তাঁর লেখা গান গেয়েছেন । এইচএমভি. এবং আকাশবাণীর গীতিকারদের নিয়ে বিতর্কের সময় তিনি কিছুদিন প্রিয়ব্রত ছদ্মনামটি ব্যবহার করেন। মান্না দের গাওয়া অধিকাংশ প্রেমের গানই তাঁর রচনা। পঞ্চাশ বছরের উপর তিনি যা গান লিখেছেন তার সংখ্যা চার হাজারের মতো। রবিশঙ্কর, নৌসাদ, আলী আকবর খান, লতা, আশা, কিশোর

কুমার, রফি, তালাত মাহমুদ, মুকেশ, গীতা দত্ত, আর ডি বর্মণ, বাপ্পী লাহিরী, যতিন ললিত, তরুণ বন্দোপাধ্যায়, হৈমন্তি শুকলাসহ আরো অনেকের সঙ্গে পুলক বাবু কাজ করেছেন।
হেমন্ত, মান্না দে, গীতা দত্ত, লতা, আশা, হৈমন্তী, শ্যামল, ভূপেন, প্রতিমা, উৎপলা, অরুন্ধতী, সতীনাথ, অনুপ, আরতী মুখোপাধ্যায়সহ অনেক জ্ঞানী-গুণী শিল্পী তাঁর গানে সুরোরোপে গান গেয়েছেন।
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শঙ্খবেলা’ চলচ্চিত্রে তার সুরোরোপিত গান আজও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। লতা ও মান্নাদে’র দ্বৈত গান ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ এবং লতা’র কণ্ঠে ‘আজ মন চেয়েছে’ চলচ্চিত্রটিকে ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছিল। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘প্রথম কদম ফুল’ চলচ্চিত্রের জন্য ‘আমি শ্রী শ্রী ভজ হরি মান্না’ গান রচনা করেন। “সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল”,”গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি”,নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখীরা”,”খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার” বাংলা ছবির এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গীতিকার। মান্না দের গাওয়া তাঁর লেখা “মা” গানগুলিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য । গান লেখার পাশাপাশি তিনি উপন্যাস,চিত্রনাট্য ও ছড়া লিখেছেন । তাঁর লেখা গানের সংকলন ‘আমার প্রিয় গান’, ছড়ার সংকলন ‘বাহাত্তুরে’,গল্প সংকলন ‘শেষ সংলাপ’। ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’ তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ।
বাংলা গানের জগতে অসংখ্য হৃদয়গ্রাহী গানের স্রষ্টা, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই সেপ্টেম্বর ৬৪ বছর বয়সে হুগলী নদীতে লঞ্চ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন। স্প্যালডিং গ্রে ছিলেন খ্যাতিমান কমেডিয়ান এবং লেখক। তিনি বাইপোলার

ডিসঅর্ডারে ভুগছিলেন। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই জানুয়ারি ৬২ বছর বয়সে তিনি নিখোঁজ হন। পুলিশ নদী থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তিনি ফেরি থেকে মাঝ নদীতে ঝাঁপ আত্মহত্যা করেছিলেন।
পুলক বন্দোপাধ্যায় কেন আত্মহত্যা করেছেন তা ঠিকভাবে জানা না গেলেও অনেকে বলেন, ষাটের পর তিনি আগের মতো লিখতে পারতেন না। যা তাঁকে হতাশ করে দিয়েছিল। আবার অনেকে মনে করেন, আগে যারা তার গানের জন্য অনেক প্রশংসা করতেন সবাই এড়িয়ে চলতে শরু করে। দেখুন: আত্মহত্যা: অভিনেতা অভিনেত্রী গীতিকার ও অন্যান্য।
নিচে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু জনপ্রিয় গান কথা-সহ পড়তে পারেন, শুনতে পারেন।
কিছু প্রয়োজনীয় পোস্ট—