ড. মোহাম্মদ আমীন
ঝড়
কোনো স্থানের বায়ুমণ্ডল কোনো কারণে উত্তপ্ত হলে বায়ু হালকা হয়ে উপরে উঠে গেলে সেই শূণ্যস্থান পূরণ করার জন্য আশেপাশের বাতাস তীব্র বেগে ছুট আসতে শুরু করে। এরকম তীব্র বায়ুপ্রবাহকে ঝড় বলা হয়। সাধারণত এরকম ঝড়ের সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে থাকে স্থলঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডো, বজ্রবিদ্যুৎ প্রভৃতি। উত্তর গোলার্ধের বাংলাদেশে সাধারণত বৈশাখ মাসে প্রচণ্ড গরমের সময় হঠাৎ করেই এজাতীয় ঝড় হয়।
বজ্রপাত
মেঘ তৈরি হওয়ার সময় বিভিন্ন প্রকার চার্জ সঞ্চিত হয়। এ চার্জ মেঘের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় ধনাত্মক ও ঋনাত্মক আধান হিসেবে সুপ্ত থাকে থাকে। দুটো মেঘ নিকটে এলে বিপরীতধর্মী আধানগুলো একে অপরের সাথে আকর্ষিত হয়ে সংযোগ ঘটে। ফলে বিদ্যুৎ চমকায়। বিদ্যুৎ চমকানোর ফলে আশেপাশের বাতাস দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে প্রসারিত এবং ঠাণ্ডা হয়ে সংকুচিত হয়। এ আকস্মিক সংকোচন ও প্রসারণের ফলে যে শব্দের সৃষ্টি হয় সেটিই বজ্রপাত। হাওড় এলাকায় জলীয় বাষ্প বেশি হয়। এজন্য হাওড় অঞ্চলে বজ্রপাতের সংখ্যা বেশি। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই মে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রতিবছর বিপুল প্রাণহানি সত্ত্বেও সরকারি নথিতে এর পূর্বে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে গণ্য করা হতো না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত জাতীয় পরিকল্পনায় মোট ১২টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা উল্লেখ আছে। তন্মধ্যে বজ্রপাত ছিল না। এখন যুক্ত হয়েছে।
কালবৈশাখী ঝড়
বাংলাদেশে সাধারণত বৈশাখ বা এপ্রিল-মে মাসে প্রচণ্ড গরমের সময় হঠাৎ করেই যে ঝড় আঘাত হানে তা কালবৈশাখী নামে পরিচিত। এই ঝড় শুরু হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবল বেগে ধেয়ে যায়। সঙ্গে থাকে বজ্রপাত ও বৃষ্টি। প্রায় সময় শিলাবৃষ্টিও সহচর হয়। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে সাধারণত এই ঝড় শেষ বিকেলে হয়ে থাকে। কারণ সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকরিত তাপ বায়ুমণ্ডলে বিকেলের দিকে বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এই ঝড়ের গতিবেগ ঘন্টায় ৪০-৬০ কিলোমিটার হয়। তবে ১০০ কিলোমিটারও অতিক্রম করার নজির আছে। এই ঝড়ের ব্যাপ্তি স্বল্পতর থেকে ১ ঘন্টা পর্যন্ত হতে পারে।
বজ্রঝড় ও আশ্বিনের ঝড়
এটি প্রকার ক্রান্তীয় ঝড়। বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ সহযোগে সংঘটিত ভারি বর্ষণ অথবা শিলাবৃষ্টিকে বজ্রঝড় বলে। গ্রীষ্মের উষ্ণ ও আর্দ্র দিনে উত্তপ্ত বায়ু হাল্কা হয়ে উপরে উঠতে থাকে এবং দ্রুত ঠান্ডা হয়ে গাঢ় কৃষ্ণ বর্ণের বজ্রমেঘ উৎপন্ন করে। ঝঞ্ঝাপূর্ণ এই মেঘ সচরাচর উল্লম্বভাবে প্রায় ৮ কিমি দীর্ঘ এবং প্রায় ৫ কিমি পর্যন্ত প্রশস্ত হয়ে থাকে। সাধারণত একেকটি পৃথক বজ্রঝড় নিয়ে একটি সম্মিলিত বজ্রঝড়ের সৃষ্টি হয়; যা প্রায় ৩০ কিমি পর্যন্ত প্রশস্ত হতে পারে এবং ৫ ঘণ্টারও অধিককাল স্থায়ী হয়। একটি একক বজ্রঝড় ৫০ কিমি এলাকা জুড়েও বিস্তৃত হয়ে অতিকায় বজ্রঝড়ের রূপ নিতে পারে। বাংলাদেশে মার্চ অথবা এপ্রিল মাসে এবং বর্ষামৌসুমের শেষদিকে অক্টোবর/নভেম্বর মাসে সন্ধ্যার দিকে প্রচন্ড তীব্রতা সহকারে বজঝড় সংঘটিত হয়ে থাকে। গ্রীষ্মের প্রথমভাগে এ ধরনের বজ্রঝড় ‘কালবৈশাখী’ নামে এবং বর্ষা ঋতুর শেষভাগে ‘আশ্বিনের ঝড়’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
জলোচ্ছ্বাস
সমুদ্রে অত্যধিক মাত্রায় বায়ুপ্রবাহের কারণে প্রচণ্ডভাবে ফুঁসে ওঠা পানি যখন সংলঘ্ন স্থলভাগে আছড়ে পড়ে, তখন তাকে জলোচ্ছ্বাস বলা হয়। সমুদ্রে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আসে তীব্র জলস্রোত, যা উপকূলভাগে আছড়ে পড়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরকম জলোচ্ছ্বাস ১০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। বাংলাদেশে আঘাতকারী ঘূর্ণিঝড়গুলির সঙ্গে আসা ঝড়ো-জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা সাধারণত ৩ থেকে ৬ মিটার হয়ে থাকে। ১৯৭০ সালের ১২ ও ১৩ই নভেম্বর মেঘনা মোহনায় আঘাতকারী স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাসটি ভরা কটালের সময়ে হয়েছিল এবং জলরাশি ৩.০৫ থেকে ১০.৬ মিটার পর্যন্ত উঁচুতে উঠে যায় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিমি এবং প্রায় তিন লাখ মানুষ এ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে নিহত হয়। শতাব্দীর আরেক ভয়াবহতর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসটি সংঘটিত হয় ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে এপ্রিল। এটি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা ও খুলনা এলাকায় আঘাত হানে এবং প্রায় ১৫,০০০ মানুষ, ৭০,০০০ গবাদি পশু মারা যায়। মোট ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৬,০০০ কোটি টাকা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ : প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ
——————————————————————————-