অনিন্দ্য বড়ুয়া
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ‘চর্যাপদ’ তথা ‘চর্যাচর্য্বিনিশ্চয়’ এর পদগুলি।মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী(১৮৫৩-১৯৩২) নেপালের রাজ দরবার হতে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে চর্যাপদের পদগুলি আবিষ্কারের পর

থেকে, আরো ভালো ভাবে বলতে গেলে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা ’ নামে প্রকাশ করার পর থেকে চর্যাপদের ভাষার উত্তরাধিকার নিয়ে বাংলা সন্নিহিত ভাষা অঞ্চলগুলির মধ্যে কলমযুদ্ধ কম হয়নি।‘বিভিন্ন পণ্ডিত চর্যাপদাবলীতে ওড়িয়া,মৈথিলী ও অসমীয়া ভাষার আদিরূপ দেখতে পেয়েছেন।মনে রাখতে হবে যে বাঙ্গালা সমেত এই চারটি ভাষারই প্রত্নভাষা মাগধী অপভ্রংশ’।১
বিদগ্ধ গবেষকদের গবেষণায় ইতোমধ্যে নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণিত হয়েছে চর্যাপদের ভাষা প্রাচীন বাংলা ভাষা।নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে- বাংলার কোন অঞ্চলের ভাষা? রাজনৈতিক ডামাডোলের কেন্দ্রভূমি বাংলার মানচিত্র কখনো শ’খানিক বছরের বেশি একরকম থাকেনি, ঘন ঘন বদলেছে শাসক,মানচিত্র,ভাষা।এতোসব পালাবদলের পরও যে অঞ্চল নিজের ভাষায় কিছু পরভাষা আত্মস্থ করে নেয়া ছাড়া নিজের আদিত্ব ও অকৃত্রিমতা ধরে রাখতে পেরেছে তা হলো চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা।ইতোমধ্যে প্রমাণিত হতে শুরু করেছে চর্যাপদের কোন কোন লেখক চট্টগ্রামের অধিবাসী ছিলেন এবং অন্যদের অনেক পদ চট্টগ্রামে বসে রচিত হয়েছে।পদগুলির উপর লিখা বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থে চর্যার ভাষা অঞ্চলকে পূর্ববঙ্গ চিহ্নিত করার প্রয়াশ দেখা গেলেও ঐ সমস্ত লিখার ভিত্তিতেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের সুস্পষ্ট ইগিত পাওয়া যায়।‘যে দুটি চর্যায় “বঙ্গ” এবং ‘বঙ্গালী”র উল্লেখ আছে সেখানে ঐ দেশ সম্পর্কে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করা হয়েছে।একটিতে“বঙ্গ” দেশের মহিলাকে জায়া রূপে গ্রহণ করে ‘বিজ্ঞান” বোধ হারিয়ে ফেলার ইংগিত করা হয়েছে এবং অন্যটিতে দীন-দরিদ্রের অর্থে “বঙ্গালী” কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে’।২
‘প্রখ্যাত লেখক Regnad H. Blyth তাঁর ইংরেজিতে লেখা হাইকু গ্রন্থে (চার খণ্ড)হাইকুর প্রকার,দর্শন,ধর্মীয় চেতনা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তাঁর মতে হাইকুকে জেন ধর্মের নিরিখে বুঝতে চেষ্টা
করা উচিৎ…।’৩ অনুরূপ ভাবে চর্যাপদ বা দোহাকোষ বুঝতে চেষ্টা করা উচিৎ বৌদ্ধ ধর্ম ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বা চাটগাঁ ভাষার প্রেক্ষিতে।কারণ প্রথমত চাটগাঁ ভাষার মধ্যেই সংকলিত হয়ে আছে মাগধী প্রাকৃত তথা আদি বাংলা ভাষা।‘চাটগাঁ ভাষার দুর্বোধ্যতার কারণ হিসেবে অনেকেই বিভিন্ন বিদেশি(এই ক্ষেত্রে উপমহাদেশের কোন অঞ্চলকে বিদেশ ধরা হয়না) ভাষার মিশ্রণকে দায়ী করেন।আমারা যদি বার্মা-আরাকানাগত কতিপয় বৌদ্ধধর্মীয় শব্দ বাদ দিই তবে দেখা যাবে যে,লুঙ্গি,ফুঙ্গি,ডালা,কুলা,থামি ইত্যাদি শব্দ অনেক আগেই পৌঁছে গেছে সারা বাংলায়।পর্তুগিজরা শুধু চট্টগ্রামে বাস করেনি,বাস করেছে হুগলি আর ঢাকা অঞ্চলেও, মগদের সাথে বেঈমানি করার শর্তে মোগলদের আশ্রয়ধন্য হয়ে তারা শেষ নিবাস গেঁড়েছিল ঢাকায়।চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার কথা উঠলে প্রবল ভাবে উঠে আসে আরব বণিক আর তাদের ভাষার কথা ।সেই আরবরাইতো পরবর্তীতে দীর্ঘকাল শাসন করেছে প্রায় পুরা বাংলা,প্রবল সানুগ্রহ প্রর্দশন করেছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি,সে হিসেবে তাদের ভাষার প্রভাব আছে সর্ব বাংলায়।অন্যান্য যেসব ভাষার প্রভাব চট্টগ্রামের ভাষায় রয়েছে তারা বাংলায় প্রবেশ করেছে ভিন্ন ভিন্ন পথে।সুতরাং চাটগাঁ ভাষার দুর্বোধ্যতার জন্য বিদেশী ভাষার সংশ্লিষ্টতা নয়, এর নিয়ামক হচ্ছে মাগধী প্রাকৃত শব্দকে অনৈতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান সময় পর্য্ন্ত হুবহু ধরে রাখা,হুবহু বলতে অবিকৃত বোঝানো হচ্ছেনা,বিকৃতি যতটুকু ঘটেছে তা আত্মীকরণ কালেই ঘটেছে-ঘটেছে বলেই তা প্রাকৃত।’ ৪
দ্বিতীয়ত বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় তত্ত্বের উপর লেখা পদাবলী বৌদ্ধ ধর্মের প্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে,গবেষকরা করেছেনও তাই কিন্তু চর্যাপদকে যে অর্থে গূঢ় করার চেষ্টা করা হয়েছে সে অর্থে চর্যা ততটা গূঢ় নয়,গূঢ়তা হচ্ছে উৎপ্রেক্ষা এবং ব্যাঙ্গার্থের প্রাচুর্যের কারণে, যা তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক এবং রাজনীতি-সম্পৃক্ত ধর্মীয় বিরূপ পরিবেশের কারণে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল।নতুন ভাবে আবিষ্কারের পর আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সহ পরবর্তী গবেষকদের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার উপর দখল না থাকায় চর্যার ভাষাকে সান্ধ্যভাষা বা সন্ধ্যাভাষা বলে মনে হয়েছে,যার কিছুটা বোঝা যায় কিছুটা বোঝা যায় না।
পরের মুখে ঝাল খাওয়া কিছু কিছু বাঙালির মধ্যে বঙ্গ-বঙ্গাল-বাঙ্গলা নিয়ে তথাকথিত অপরিছন্নতা,নীচতা ও অস্পৃশ্যতার বোধ সবসময় জাগ্রত ছিলো,এখনো আছে।‘বৈদিক সাহিত্য পাঠে জানা যায় যে, এ অঞ্চলের অধিবাসীদের আর্য্ ঋষিরা ঘৃণার চোখে দেখতো এবং ম্লচ্ছ,পাপী,অনাচারী এবং ভ্রষ্ট ইত্যাদি বলে তাদের তিরস্কার করতো।আর্য্ ঋষি কতৃক ধীকৃত এই জনগোষ্ঠীর মধ্যেই বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নিহিত রয়েছে।’ ৫ দুটি কারণে বৌদ্ধরা আর্য্ঋষিদের কাছে ধীকৃত ছিলো,প্রথমত বৌদ্ধরাই প্রথম বর্ণভেদহীন ও অস্পৃশ্যতা বোধহীন ধর্ম তথা সমাজের অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাঁদের শ্রেণী বিভাজিত সুবিধাবাদের মূলে কুঠারাঘাত করেছিল।দ্বিতীয়ত বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে দেখা যায়, যতো প্রসিদ্ধ জ্ঞানী গুণী গৃহী ও ভিক্ষুর আর্বিভাব তৎকালীন সময়ে বৌদ্ধদের মধ্যে হয়েছিলো তাঁদের সিংহ ভাগ ছিল ব্রাহ্মণ সন্তান,যাঁরা বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে জানতে এসে আর ফিরে যেতনা।তাই তাদের দৃষ্টিতে বুদ্ধ এবং বৌদ্ধ ধর্মকে সময়ে সময়ে “মায়াবী” বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।সেই চিন্তা চেতনা থেকেই “বিজ্ঞান’বোধ হারানোকে আধুনিক সময়ের একজন লেখক অবজ্ঞাসূচক ধরে নিলেও বৌদ্ধ ধর্ম মতে বিজ্ঞান বোধ হারানো একটি মহান ধাপে উত্তরণ।এই ধর্মে দুঃখের যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে “বিজ্ঞান স্কন্ধ” পঞ্চ স্কন্ধের অন্যতম।সুতরাং বৌদ্ধ ধর্মের লীলাভূমি পূর্ব বাংলায় এসে চর্যাকারের বিজ্ঞান বোধ হারনো অবজ্ঞাসূচক হতেই পারেনা,বিশেষ করে চর্যাকার যখন বলে- সব হারিয়ে সংসারে সুখে দিন যাপন করছি।
ধান ভানতে শিবের গীত অপ্রাসঙ্গিক হলেও অপ্রয়োজনীয় নয়;শিবের গীত গাইলে শিবে ভক্তি আসার সাথে সাথে ছন্দও আসে ধান ভানায়।এবার চেষ্টা করছি ধান ভানাতে মন দেয়ার।চর্যার ভাষাকে সন্ধ্যাভাষা বলা হলেও সন্ধ্যার আঁধারের ঘোর অনেকটা কেটে যায় এর পাঠে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ ঘটালে।যে উচ্চ মার্গীয় ভাষা থেকে বের হয়ে এসে চর্যার পদকাররা খুব সাধারণ ও অসংস্কৃত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে দেহাতি ভাষার প্রয়োগে পদ রচনা করেছিলেন সেসব পদে উচ্চমার্গীয় শব্দের টোপর পড়ালে ধর্মীয় গাম্ভীর্যের আবেশ হয়তো আসে- কাব্যের সাবলীলতা বজায় থাকেনা।বিশেষত যখন বলা হচ্ছে ‘টীকাকারের মন্তব্যে ধরা পড়ে যে এসব হাজার হাজার চর্যা সংগ্রহের পর এর থেকে নির্বাচিত একশতটি চর্যার একটি সংকলন হয়েছিল,তার ভেতর থেকে মুনিদত্ত মাত্র…পঞ্চাশটির মতো নির্মল টীকা প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীদের জন্য।’ ৬
নির্মল শব্দটির উপর আরো ফেললে ধরে নেয়া যায় সংকলক বাছাই করার সময় একবার সরিয়ে রেখেছেন অসংস্কৃত ও দেহাতি শব্দ বহুল পদ,টীকা লিখার সময় বীর্য্ না লিখে ঔরস লিখার মতো করে সংস্কার করে নিয়েছেন কিছু শব্দ,আবার সম্পাদনা কালে যে সম্পাদকের স্বাধীণতা নিয়ে কিছু শব্দের পরিবর্তন ঘটাননি তার নিশ্চয়তা কোথায়?বিশেষ করে সংকলনটি যদি শিক্ষার্থীদের জন্যই করা হয়ে থাকে।সম্পাদিত তথা সুভাষিত চর্যাপদ থেকে গবেষক শামসুল আলম সাঈদ তাঁর রচনায় আমাদের কিছুটা ধরিয়ে দিয়েছেন যৌনগন্ধী ও দেহাতি ভাষার আভাষ তবে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার কোন ইংগিত তাঁর রচনাতেও নেই।১নং চর্যায় পাওয়া যায়—
এড়িএউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস।
সুনুপাখ ভিতি লাহুরে পাস।।
পঙতি দুটিতে ব্যবহৃত শব্দাবলীর মধ্যে আস এবং লাহুরে পাস শব্দত্রয় ছাড়া সব কটি শব্দের একাধিক পাঠ পাওয়া যায়,ছান্দক শব্দটিকে ছন্দ,কামনা,বাসনা হিসেবে দেখানো হয়েছে বিভিন্ন লেখকের লেখায়,তাতেও গোল মেটেনি। কিন্তু চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ ঘটিয়ে যদি লিখা হয়—
২
এড়িএ উচ্ছান্দক* বান্ধ কর ণ কপাটের আস।
সুন্উ পাখ ভিতি লাহুরে পাস।।
তবে দুটি পঙতির প্রমিত রূপ হয়—
ফেলে রেখ উগ্রাবরণ বন্ধ কর নয় কপাট কামনা
শূন্যতাবাদ ভিত্তি করে ত্যাজ দুর্ভাবনা।
[এড়িএ> রেখে দিয়ে, উচ্ছান্দক>উগ্র ছান্দস-উগ্র গাত্রাবরণ, ণ কপাট>নয় কপাট>নয় ব্র্রহ্মইন্দ্রিয়, সুন্উ>শূন্য]
দ্বিতীয় চর্যাতেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে চাটগাঁ ভাষার শব্দ।এই চর্যার কবি ‘কুক্কুরী পা’ সম্ভবত চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র ছিলেন।অন্য সব চর্যার মতোই এই চর্যার ভিন্ন ভিন্ন পাঠ পাওয়া গেলেও পূর্ণ তৃপ্তি পাওয়ার মতো পাঠ একটিও পাওয়া যায়নি ভাবের সামঞ্জস্যহীন পঙতির কারণে,অতৃপ্তির বিষয়টি প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে ধর্মতত্ত্বের আড়ালে।কিন্তু চাটগাঁ ভাষার এবং তৎকালীন সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থার ইতিহাসের আশ্রয় নিলে নিমেষেই কেটে যায় অতৃপ্তি,কেটে যায় সামঞ্জস্যহীনতা।তৎকালীন বৌদ্ধ সমাজের পরিবার ব্যবস্থা অনুযায়ী নিয়ম ছিল মহিলা আর শিশুরা ঘুমাবে অন্দর মহলে(সাধারণত মাটির দেয়াল বা বাঁশের বেড়ায় নির্মিত),পুরুষরা থাকতো উঠানের অপর প্রান্তে দেউড়ি ঘরে।দুটি ঘরের দরজাই খুব সহজে খোলা যেত,অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ মহলের দরজাই থাকত না।নানা ছুতায় দম্পতিরা মিলিত* হতো পরষ্পরের সাথে। স্বামীর কোন ভাই না থাকলে বা নিতান্ত কিশোর বয়সী হলে কখনো কখনো বধূও চলে আসতো স্বামীর কাছে।গর্ভবতী স্ত্রীকে স্বামীর কাছে আসতে হলে একটা বিশ্বাসযোগ্য ছুতার অবশ্যই দরকার,যার চিত্রটি খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে এই চর্যায়।অপেক্ষা শুধু আলো-আঁধারি শব্দে চাঁটগা ভাষার প্রতিফলন;যে প্রতিফলনের আলোতে চর্যাটি হয়ে উঠবে— দুলে দুই পিঠা ধরণ না যায়
কুমির গরাসে তেঁতুল খায়।
দেউড়িটা খাঁ খাঁ;বৌ বিয়াতি
কানেট চোরনী বের হও অর্ধরাতি,
শ্বশুর ঘুমালে বধূ আস ঘরে-
কই খোঁজ কানফুল? নেয় যদি চোরে! ………।
[পিঠা- স্তন, ধরণ না যায়- ছোঁয়া/ধরা যায়না, কানেট চোরনী- নিজের কানের অলংকার নিজে চুরি করে অর্থাৎ কৌশলগত কারণে লুকিয়ে রেখে লুকিয়ে রেখে।]
এভাবে প্রায় প্রতিটি পদেই ছড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শব্দ।পরিসরের হিসেব বিবেচনায় রেখে বিস্তারিত না লিখে কিছু শব্দ তুলে ধরছি—চীঅণ>চিকন, দুয়ারত>দরজায়, দেখই-আ>যে দেখেছে(চর্যা-৩)/ ঘিনি>ঘৃণা করে, ন>না(চর্যা-৬)/ মনগোঅর>গোমড়ামুখো-অভিমানী, উআস>অভূক্ত, তে>ও*(চর্যা-৭)/ পুচ্চী> জিজ্ঞেস করেছি(চর্যা-৮)/ ঘলিলি>প্রবেশ করলি, ভাঞ্জী>ওলট-পালট করে(চর্যা-১০)/ উইত্তা>উপুর হয়ে আছে এমন(চর্যা-৩০)/ উজু>সোজা, হাথে>হাতে(চর্যা-৩২)/ টালত>স্তুপে>অনেকের সঙ্গে মিলিত আকারে, নিতিয়া*>আত্মীয়হাড়ীত>হাড়িতে(চর্যা৩৩)ইত্যাদি
___________________________________________________________
*বিশ্বাস করা হতো দৈহিক মিলনের ফলে পুরুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটে,ফলে অভিভাবকরা বিশেষ করে মায়েরা পুত্র-পুত্রবধূর দৈহিক মিলন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতেন নানা ভাবে।‘পুত্রার্থে গমণং ভার্য্যা’তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন তারা।
*ব্রহ্মা যখন দেবতা বরুণকে সৃষ্টি করলেন তখন অন্যান্য দেবতারা আগুনের তাপে তার কাছে যেতে পারছিলেন না,এই অবস্থায় তারা ছান্দস নামের একপ্রকার আবরণ গায়ে জড়িয়ে বরুণের কাছে গিয়েছিলেন।বলা হয়ে থাকে এই ছান্দস থেকেই পরবর্তীতে ছন্দ শব্দটির উৎপত্তি হয়।ছন্দজ্ঞান সম্পন্ন উচ্চ শিক্ষিত চর্যা কবিদের এটা জানা থাকাই স্বাভাবিক,তাই তারা ছান্দস থেকে ছান্দক ও উগ্র-ছান্দক< উছান্দক করে নিতে পেরেছিলেন।চাটগাঁ ভাষায় উগ্র ও অতি অর্থে ‘উ’ ‘উয়া’ প্রভৃতি উপসর্গের অনেক ব্যাবহার প্রচলিত আছে যেমন-উ’য়া>গোঁয়ার/তিরিক্ষি, উরঘুইন্যা>উগ্রগন্ধি, উয়া-মঙ্গল>গোঁয়ার গোবিন্দ।
*ব্যক্তি;সর্বনাম।
*সবকটি পাঠেই দেখানো হয়েছে “নিতি আবেশী”।হওয়া বিধেয় “নিতিয়া বেশি> আত্মীয় বেশি”।
৩
প্রাচীন বাংলা সাহিত্য বলতেই চর্যাপদের পরই আসে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তণের নাম।আদি যুগের (৬৫০-১২০০)ভাষা থেকে মধ্যযুগের(১২০০-১৮০০) ভাষা আধুনিক তথা বর্তমান প্রমিত ভাষার কাছাকছি হওয়ার কথা হলেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তণে দেখা যায় চন্দ্রবিন্দুর বহুল ব্যাবহার আবার চাটগাঁ ভাষার ছড়াছড়ি—
তাহাত আগত রাধা এড়ায়ি কেমনে।
হেন্ক উপায় তোহ্মে কহ মোর থানে।।৭
অথবা
কোন অসুভঁ খনে পাঅ বড়ায়িলো।
হাঁছি জিটি আয়র উঝট না মানিলো।।৮
অথবা
জেঠ মাস গেল আষার পরবেশ।
সামলে মেঘেঁ ছাইল দক্ষিণ প্রদেশ।।৯
পদগুলিতে ব্যবহৃত শব্দ- আগত-<অগ্রে, আয়র>হাঅঁর<অন্যের দীর্ঘশ্বাস-যা পরশ্রীকাতরতা থেকে উঠে আসে এবং এই প্রক্রিয়াটি যাত্রা কালে যে দেখে বা শুনে তার যাত্রা সাময়িক স্থগিত করতে হয়,উঝট>হোঁচট, জেট মাস>জ্যৈষ্ঠ মাস প্রভৃতি এখনো হুবহু টিকে আছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়,যেমন টিকে আছে- বড়ায়ি<বড়-আইয়া>বড়দিদিমা/ঠাকুরমা,কেহ্নে>কেমনে;খেমা>ক্ষমা/নিস্তার,যেহ্ন<য্বেন>যেমন; নিন্দউলী<নিন্দারালী>নিদ্র্রা আনয়নকারী;রাএ<রা কাড়ে>শব্দ/ডাক/চিৎকার দেয়;বিচনী>বিচঅইন>ব্যজনী/পাখা;চৈতমাস>চৈত্র মাস;চাইহ <চাইঅ>চাহিও>দেখিও/খুঁজিও; লাগপাই>নাগাল পাই; পোঅ<পোআ>পো-ছেলে; জাইউ>যেও; ঝুঁর<ঝুরি>
ঝিমাই/ক্লান্তিকর দীর্ঘ অপেক্ষায় কাটাই;তেরছ>তীর্য্ক-কোণাকোণি,হাথত>হাতে; বয়সত>বয়সেতে,এড়> রাখ/ছাড়;আশিন মাস>আশ্বিন মাস;বেকত>বেবাকে-সবকিছুতে,কিলাআঁ<কিলাই>কিলিয়ে; কোঅলী <কঁঅল্> কোমল, ভাঁগি>ভেঙে; জআঅ<জি’আ>জিজ্ঞেস কর্; ঘাঅত<ঘা’ত>ঘায়ে ইত্যাদি।১০
এর পরবর্তী বিদ্যাপতি,আলাওল,নারায়ণ দেব সহ মধ্যযুগের এবং আধুনিক যুগের পুরোভাগের অনেক লেখকের লিখায় ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে চাটগাঁ ভাষায় প্রচলিত শব্দ সম্ভার।বাংলা সাহিত্যের গণ্ডি পেরিয়ে আরো পেছনে তাকালে দেখা যায় অশোকের ভাবরু শিলালিপিতে উৎকীর্ণ প্রথম পঙতিতে উল্লেখ আছে-‘প্রিয়দসি লাজা মগধে সংঘং অভিবাদেতুনং(মগধের প্রিয়দর্শি রাজা সংঘকে বন্দনা করে বলছি…।) ১১ এতেই দেখা যায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু মানুষ ‘র’ স্থলে ‘ল’ ব্যবহার করে লাজা,লেলগাড়ি,লাতাকুড়া(মোরগ),লাজ্জাক,লোজিনা ইত্যাদি বাগভঙ্গি ব্যবহার করলেও তাতে দোষের কিছু নেই;আছে প্রত্ন উচ্চারণের গর্বিত ধারাবাহিকতার গর্বিত উত্তরাধিকার।
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার এতো ছড়াছড়ি থাকা সত্ত্বেও হলফ করা বলা যাচ্ছে না চর্যাপদের উৎসস্থল চট্টগ্রাম।তবে নিশ্চিত করে বলা যায় এর কিছু অংশ চট্টগ্রামের সাধক কবিদের হাতে রচিত হয়েছে এবং কেউ কেউ চট্টগ্রামে বসেই সম্পাদন করেছেন তাঁদের রচনা কার্য্,নিশ্চিত ভাবে বলা যায় আমাদের আঞ্চলিক ভাষাটিতে আজো বাঁধা পড়ে আছে প্রচীন বাংলার শব্দাবলী।
চর্যাপদের সম্পদকের ভূমিকায় দেখা যায়-‘দ্বাদশ শতকের পশ্চিম বঙ্গের লেখক সর্বানন্দ “অমরকোষের” উপরে লেখা তাঁর টীকাতে শুষ্ক মৎস্য প্রিয় “বাঙ্গাল বাচ্চারা” অর্থাৎ “শুকনো মাছ খেতে ভালোবাসে এমন অমার্জিত বঙ্গালীদের” কথা বলেছেন।শুকান বা শুঁটকী মাছ আজও পূর্বতম বঙ্গে(বা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বতম অংশ) জনপ্রিয়।’ ১২
এসব আংশিক সত্য অপ্রিয় সংলাপ চট্টগ্রাম বাসীকে তথা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার দাবীকে চর্যাপদের আরো কাছে এনে দেয়;আরো কাছে এনে দেয় কাব্যে চন্দ্রন্দিুর সীমিত ব্যবহার ও সংস্কৃত শব্দের কম ব্যবহার।যেখানে ‘ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকদের রচনায় ব্যবহৃত শতকরা ২৫টি শব্দ তৎসম,…
৪
৫টি অর্ধ-তৎসম,…২টি দেশী শব্দ।’১৩ সেখানে চর্যাপদের দুই পদকর্তা ‘ভুসুকু পা এবং সরহ বা সরোরুহবজ্রের চর্যায় ব্যবহৃত শব্দাবলীর শতকরা ১২ টি তৎসম,২০টি অর্ধ-তৎসম,৭ভাগ চলিত বাংলা এবং ৫৬ ভাগ প্রাচীন বাংলা! ’।১৪ বিস্ময়কর এই তথ্য বাংলা ভাষার উৎপত্তির ভিন্ন দুটি উৎস-ধারর গতি নির্দেশ করে, যার মধ্যে অধিক প্রাকৃত ধারাটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার কাছাকাছি।
=======
১।ব্রতীন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়,হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা,সম্পদনায়: হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মহাবোধি বুক এজেন্সী,কলিকাতা,২০০০খ্রিঃ, পৃষ্ঠা-১০।
২।প্রাগুক্ত- পৃষ্ঠা-১০।
৩।জাপানের সাহিত্য ও সাহিত্যিক, মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন, নিপ্পন একাডেমি, চট্টগ্রাম, ১৯৯৯খ্রিঃ, পৃষ্ঠা-৫৪।
৪।আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্য চর্চা ও চট্টগ্রামের অবস্থান, প্রাবন্ধিক, দৈনিক সুপ্রভাত বাংলদেশ, ২৮ জুন ২০১৩খ্রিঃ, চট্টগ্রাম।
৫।নৃবিজ্ঞান, ড. সৈয়দ আলী নকী ও ড. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রভাতী প্রকাশনী, ঢাকা, চতুর্থ সংস্করণ, আগস্ট ২০০৫ খ্রিঃ, পৃষ্ঠা- ৫৮।
৬।চর্যাপদ: তাত্ত্বিক সমীক্ষা,শামশুল আলম সাঈদ, অ্যার্ডান পাবলিকেশন, ঢাকা,ফেব্রুয়ারি ২০০৯খ্রিঃ, পৃষ্ঠা- ভূমিকা।
৭।শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বড়ু চণ্ডীদাস, সম্পাদনা-মাহবুবুল আলম, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানী, ঢাকা, ২০১১খ্রিঃ, পৃষ্ঠা-২২।
৮।প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৪৮।
৯।প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৩৯।
১০।প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- যথাক্রমে ২৫; ৩০; ৩৪; ৩৮; ৪০; ৫৩; ৬৬; ৭৪; ৭৭; ৮৩; ৮৫; ৮৮; ১১২; ১১৪; ১১৬; ১৪০; ১৫২; ১৫৩; ১১৩; ১৪৭।
১১।অশোক শিলালিপির আলোকে প্রাচীন ভারতে সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা, ড. এফ দীপংকর ভিক্ষু,প্রকাশক সরজিৎ বড়ুয়া রুরু ও শ্যামন্ত বড়ুয়া, চট্টগ্রাম, ডিসেম্বর ২০১১খ্রিঃ।
১২।প্রগুক্ত-১, পৃষ্ঠা-ভূমিকা।
১৩।উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা, ড. শাহজাহান মনির, স্টুডেন্টস পাবলিকেশন্স, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, জ্যৈষ্ঠ,
১৪১৭,পৃষ্ঠা- ১৬৮, ১৬৯ ও ১৭১।
১৪।প্রাগুক্ত-১, পৃষ্ঠা ২৭ ও ২৮ হতে শতকরা হিসাব সংকলিত।