সংকলনে: ড. মোহাম্মদ আমীন
এ পেজের সংযোগ: https://draminbd.com/প্রিয়-কবিতা-চিরায়ত-কবিতা/
সংযোগ: https://draminbd.com/প্রাচীন-বাংলা-কবিতা-পুরা/
সংযোগ: https://draminbd.com/সতেন্দ্রনাথ-দত্ত-সত্যেন/
কবিতাগুলো ইন্টারনেট থেকে সগৃহীত নয়। বিভিন্ন বই ও প্রযোজ্যক্ষেত্রে লেখকের মূল সংকলন হতে নেওয়া হয়েছে।
বঙ্গবাণী
আবদুল হাকিম (১৬২০ খ্রি.— ১৬৯০ খ্রি. )
কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।
সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ।।
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন।।
আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।
দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।।
আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।।
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।।
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ।।
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।
আবদুল হাকিম (১৬২০ খ্রি.— ১৬৯০ খ্রি. )
বঙ্গবাণী কবিতটি— সুস্পষ্টভাবে বাংলা ভাষার প্রশস্তি গেয়ে এবং বাংলাকে অবহেলাকারী বাংলাভাষীর প্রতি ঘৃণ্যোপদেশ দিয়ে বাংলা ভাষার পক্ষে রচিত প্রথম সুস্পষ্ট কবিতা। (ড. মোহাম্মদ আমীন)
আমার পণ
মদনমোহন তর্কালঙ্কার
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।
.
আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে,
আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।
.
ভাইবোন সকলেরে যেন ভালোবাসি,
এক সাথে থাকি যেন সবে মিলেমিশি।
.
ভালো ছেলেদের সাথে মিশে করি খেলা,
পাঠের সময় যেন নাহি করি হেলা।
.
সুখী যেন নাহি হই আর কারো দুখে,
মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে।
কাজের লোক
কবিপরিচিতি: পণ্ডিত রাজনারায়ণ তর্ক বাচস্পতি ও পদ্মাবতী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নিম্ন দামোদর এলাকার আমতার নারিট গ্রামে জন্ম। মৃত্যু: ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর।প্রথম বই— বাঙালির ছবি (১৮৮৫), পরবর্তীকালে ‘রংচং’ নামে পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত । ‘শিশুরঞ্জন রামায়ণ ( জানুয়ারি ১৮৯১) , ছেলেখেলা (১৮৯৮) , টুকটুকে রামায়ণ (১৯১০) , ছবির ছড়া ( ১৯৩৬) ” ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থ পুষ্পাঞ্জলি বড়োদের জন্য রচিত। ‘ছড়া ও কবিতা’ , ‘ছবি ও ছড়া’ প্রভৃতি ছাড়াও তিনি অনেকগুলো পাঠ্যপুস্তক রচনা করেছেন। সম্পাদিত গ্রন্থ:মহাকবি কৃত্তিবাস রচিত সপ্তকাণ্ড রামায়ণ ও মহাকবি কাশীরাম দাস রচিত অষ্টাদশ পর্ব মহাভারত তাঁর সম্পাদনায় সচিত্র আকারে প্রকাশিত হয় । নবকৃষ্ঞ ভট্টাচার্য এবং তাঁর বন্ধু প্রসিদ্ধ শিশুসাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকারের যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সংকলন গ্রন্থ ” আগমনী ” । নবকৃষ্ণ সংকলিত ‘কবিতা কুসুম’ কাব্যগ্রন্থ সেকালে বহুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
জীবনের শেষ দশটি বছর খুবই অসুস্থতার সঙ্গে কাটিয়েছেন । অবশেষে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর ( বাংলার ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের ১৮ ই ভাদ্র ) মারা যান। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত নারিট ফরোয়ার্ড লাইব্রেরি ১৩৫৭ বঙ্গাব্দে ( ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ) কবির নামে রূপান্তরিত হয়ে ” নারিট নবকৃষ্ণ পাঠাগার – এ পরিণত হয় । পাঠাগারের সামনে তার মর্মর মূর্তি বসানো হয়েছে ।
বিদ্যার মাহাত্ম্য
হেয়াত মামুদ
যার বিদ্যা নাই সে না জানে ভালমন্দ।
শিরে দুই চক্ষু আছে তথাপি সে অন্ধ।।
.
সে চক্ষু বিদ্যার বিনে আর কারো নয়।
বিদ্যা বড় ধন নাহি শুন মহাশয়।।
.
বিদ্যাধন যে বা রাখে ধনী বলে তারে।
চোরে চুরি করিবারে সে ধন না পারে।।
.
যতেক খরচ করো তত সে বাড়য়।
খরচ করিলে ধন কম নাহি হয়।।
.
লোকের বিক্রম বাড়ে বিদ্যার বিধানে।
পশুতে অধম যেই বিদ্যা নাহি জানে।।
.
বিদ্যার মহিমা ভাই কহিতে না পারি।
বিদ্যা পড় বিদ্য শিখ শ্রম পরিহরি।।
.
যে ছেলে না জানে বিদ্যা গরু তাথে ভাল।
বনে ঘাস খায়া বয় গৃহস্থের হাল।।
হেয়াত মামুদ ( জন্ম ১৬৯৩ খ্রি. — মৃত্যু ১৭৬০ খ্রি. )
কুটির
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
ঝিকিমিকি দেখা যায় সোনালি নদীর,
ওইখানে আমাদের পাতার কুটির।
এলোমেলো হাওয়া বয়,
সারা বেলা কথা কয়,
কাশফুলে দুলে ওঠে নদীর দুপার,
রূপসির শাড়ি যেন তৈরি রুপার।
কুটিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন,
নেচে নেচে খেলা করি ছোট দুটি বোন।
পরনে খড়কে-ডুরে,
বেণি নাচে ঘুরে ঘুরে,
পায়ে পায়ে— ‘রুনু ঝুনু’ হালকা খাড়ুর,
কেন নাচি নাই তার খেয়াল কারুর।
আকাশে গড়িয়া ওঠে মেঘের মিনার,
তারি ফাঁকে দেখা যায় চাঁদের কিনার।
গাছের পাতার ফাঁকে,
আকাশ যে চেয়ে থাকে,
গুনগুন গান গাই, চোখে নাই ঘুম।
চাঁদ যেন আমাদের নিকট কুটুম।
নৌকারা আসে যায় পাটেতে বোঝাই,
দেখে কী যে খুশি লাগে কী করে বোঝাই!
কত দূর দেশ থেকে,
আসিয়াছে এঁকেবেঁকে,
বাদলে ‘বদর’ বলে তুলিয়া বাদাম,
হাল দিয়ে ধরে রাখে মেঘের লাগাম।
দু-কদম হেঁটে এসো মোদের কুটির,
পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির।
চাল আছে ঢেঁকি ছাঁটা,
রয়েছে পানের বাটা,
কলাপাতা ভরে দেব ঘরে-পাতা দই,
এই দেখ আছে মোর আয়না কাঁকই।
যদি আস একবার, বলি—মিছা না,
মোদের উঠোনটুকু ঠিক বিছানা।
পিয়াল, পেয়ারা গাছে—
ছায়া করে রহিয়াছে,
ধুঁধুলের ঝাঁকা বেয়ে উঠিতেছে পুঁই,
খড়কুটো খুঁজে ফেরে দুষ্টু চড়ুই।
এসো এসো আমাদের সোনার কুটির—
ঝিকিমিকি করে জল নিটোল নদীর।
ঝিঙের শাখার পরে
ফিঙে বসে খেলা করে,
বেলা যে পড়িয়া এল, গায়ে লাগে হিম,
আকাশে সাঁঝের তারা, উঠানে পিদিম।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ( ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯০৩ — ২৯শে জানুয়ারি, ১৯৭৬)
জীবনের হিসাব
সুকুমার রায়
বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি শখের বোটে,
মাঝিরে কন, ”বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?”
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে হাসে।
বাবু বলেন, ”সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে, চারি আনাই মাটি।”
খানিক বাদে কহেন বাবু, ”বলত দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় থেকে নেবে?
বলত, “কেন লবণপোরা সাগর ভরা পানি?”
মাঝি সে কয়, ”আরে মশাই অত কী আর জানি?”
বাবু বলেন, ”এই বয়সে জানিসনেও তা কি—
জীবনটা তোর নেহাত খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!”
আবার ভেবে কহেন বাবু, ”বলত ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বলত দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলে, ”আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?”
বাবু বলেন, ”বলব কী আর; বলব তোরে কি তা—
দেখছি এখন, জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।”
খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন, নৌকোখানি ডুবল বুঝি দুলে!
মাঝিরে কন, ”এ কি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবল না কি নৌকা এবার? মরব না কি আজি?”
মাঝি শুধায়, ”সাঁতার জানো?”— মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে,“মশাই; এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে ,আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবনখানা ষোলো আনাই মিছে!”
সুকুমার রায় চৌধুরী (৩০শে অক্টোবর ১৮৮৭— ১০ই সেপ্টেম্বর ১৯২৩)
পারিব না
কালীপ্রসন্ন ঘোষ
পারিব না, এ কথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা, ভাব এক বার,
পাঁচজনে পারে যাহা,
তুমিও পারিবে তাহা,
পার কি না পার কর, যতন আবার
এক বারে না পারিলে দেখ শত বার।
.
পারিব না বলে মুখ করিও না ভার,
ও কথাটি মুখে যেন না শুনি তোমার,
অলস অবোধ যারা
কিছুই পারে না তারা,
তোমায় তো দেখি নাকো, তাদের আকার
তবে কেন পারিব না, বল বার বার?
.
জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার
হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়,
সাঁতার শিখিতে হলে
আগে তব নাম জলে,
আছাড়ে করিয়া হেলা, হাঁট বার বার
পারিব বলিয়া সুখে, হও আগুসার।
কালীপ্রসন্ন ঘোষ (২৩শে জুলাই, ১৮৪৩— ২৯শে অক্টোবর ১৯১০)
তুলনা
শেখ ফজলল করিম
সাত শত ক্রোশ করিয়া ভ্রমণ জ্ঞানীর অন্বেষণে—
সহসা একদা পেল সে প্রবীণ, কোনো এক মহাজনে।
শুধাল, ”হে জ্ঞানী, আকাশের চেয়ে উচ্চতা বেশি কার?”
জ্ঞানী বলে, ”বাছা, সত্যের চেয়ে উঁচু নাহি কিছু আর।”
পুনঃ সে কহিল, ”পৃথিবীর চেয়ে ওজনে ভারী কি আছে?”
জ্ঞানী বলে, ”বাছা, নিষ্পাপ জনে দোষারোপ করা মিছে।”
জিজ্ঞাসে পুনঃ, ”পাথরের চেয়ে কি আছে অধিক শক্ত?”
জ্ঞানী বলে, ”বাছা, সেই যে হৃদয়, জগদীশ-প্রেম-ভক্ত।”
কহিল আবার, ”অনলের চেয়ে উত্তাপ বেশি কার?”
জ্ঞানী বলে, ”বাছা, ঈর্ষার কাছে বহ্নিতাপও ছার!”
পুছিল পথিক, ”বরফের চেয়ে শীতল কি কিছু নাই?”
জ্ঞানী বলে, ”বাছা, স্বজন-বিমুখ হৃদয় যে ঠিক তাই।”
শুধাল সে জন, ”সাগর হইতে কে বেশি ধনবান?”
জ্ঞানী বলে, ”বাছা, তুষ্ট হৃদয় তারও চেয়ে গরীয়ান।”
শেখ ফজলল করিম (শেখ ফজলল করিম, (৯ই এপ্রিল ১৮৮২— ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬)।
কোথায় স্বর্গ?কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর/ মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেতে সুরাসুর”-এর রচয়িতা
আত্মত্রাণ
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।
এ নহে মোর প্রার্থনা,
তরিতে পারি শকতি যেন রয়।
সবার আমি ছাত্র
সুনির্মল বসু
আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে।
.
পাহাড় শেখায় তাহার সমান-
হই যেন ভাই মৌন-মহান,
খোলা মাঠের উপদেশে-
দিলখোলা হই তাই রে।
.
সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়
আপন তেজে জ্বলতে,
চাঁদ শেখাল হাসতে মোরে,
মধুর কথা বলতে।
ইঙ্গিতে তার শেখায় সাগর-
অন্তর হোক রত্ন আকর;
নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম
আপন বেগে চলতে।
.
মাটির কাছে সহিষ্ণুতা
পেলাম আমি শিক্ষা,
আপন কাজে কঠোর হতে
পাষাণ দিল দীক্ষা।
ঝরনা তাহার সহজ গানে,
গান জাগাল আমার প্রাণে;
শ্যাম বনানী সরসতা
আমায় দিল ভিক্ষা।
.
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানানভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র।
.
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়,
পাঠ্য যে সব পাতায় পাতায়
শিখছি সেসব কৌতূহলে,
নেই দ্বিধা লেশমাত্র।
কবিপরিচিতি: জন্ম: ২০শে জুলাই ১৯০২, ভারতের বিহার রাজ্যের গিরিডিতে পিতার কর্মস্থলে। পৈত্রিক নিবাস মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের মালখা নগর। সাহিত্যিক গিরিশচন্দ্র বসু তাঁর পিতামহ এবং বিপ্লবী ও সাহিত্যিক মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা মাতামহ। মৃত্যু: ২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭।
কাজের ছেলে
যোগীন্দ্রনাথ সরকার
‘দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিম-ভরা কৈ।’
পথে হেঁটে চলি, মনে মনে বলি, পাছে হয় ভুল;
ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয়, ছিঁড়ে দেবে চুল।
‘দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিম-ভরা কৈ।’
বাহবা বাহবা- ভোলা ভুতো হাবা খেলিছে তো বেশ।
দেখিব খেলাতে, কে হারে কে জেতে, কেনা হলে শেষ।
‘দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
ডিম ভরা বেল, দু’টা পাকা তেল, সরিষার কৈ।’
ওই তো ওখানে ঘুড়ি ধরে টানে, ঘোষেদের ননী:
আমি যদি পাই, তা হলে উড়াই আকাশে এখনি।
দাদখানি তেল, ডিম-ভরা বেল, দু’টা পাকা দৈ,
সরিষার চাল, চিনি-পাতা ডাল, মুসুরির কৈ!
এসেছি দোকানে-কিনি এই খানে, যদি কিছু পাই;
মা যাহা বলেছে, ঠিক মনে আছে, তাতে ভুল নাই!
দাদখানি বেল, মুসুরির তেল, সরিষার কৈ,
চিনি-পাতা চাল, দু’টা পাকা ডাল, ডিম-ভরা দৈ।
যোগীন্দ্রনাথ সরকার (২৮শে অক্টোবর, ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দ — ২৬শে জুন,১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দ )
হারাধনের দশটি ছেলে
যোগীন্দ্রনাথ সরকার
হারাধনের দশটি ছেলে
ঘোরে পাড়াময়,
একটি কোথা হারিয়ে গেল
রইল বাকি নয়।
হারাধনের নয়টি ছেলে
কাটতে গেল কাঠ,
একটি কেটে দুখান হলো
রইল বাকি আট।
হারাধনের আটটি ছেলে
বসলো খেতে ভাত,
একটির পেট ফেটে গেল
রইল বাকি সাত।
হারাধনের সাতটি ছেলে
গেল জলাশয়,
একটি সেথা ডুবে ম’ল
রইল বাকি ছয়।
হারাধনের ছয়টি ছেলে
চড়তে গেল গাছ,
একটি ম’ল পিছলে পড়ে
রইল বাকি পাঁচ।
হারাধনের পাঁচটি ছেলে
গেল বনের ধার,
একটি গেল বাঘের পেটে
রইল বাকি চার।
হারাধনের চারটি ছেলে
নাচে ধিন ধিন,
একটি ম’ল আছাড় খেয়ে
রইল বাকি তিন।
হারাধনের তিনটি ছেলে
ধরতে গেল রুই,
একটি খেলো বোয়াল মাছে
রইল বাকি দুই।
হারাধনের দুইটি ছেলে
মারতে গেল ভেক,
একটি ম’ল সাপের বিষে
রইল বাকি এক।
হারাধনের একটি ছেলে
কাঁদে ভেউ ভেউ,
মনের দুঃখে বনে গেল
রইল না আর কেউ।
কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, আমার যাদুমণি,
সোনার ঘড়ি কি বলিছে, বল দেখি শুনি?
বলিছে সোনার ঘড়ি, “টিক্ টিক্ টিক্,
যা কিছু করিতে আছে, করে ফেল ঠিক।
যে জন না বুঝে, তারে ধিক্ শত ধিক।”
বলিছে সোনার ঘড়ি, “টিক্ টিক্ টিক্।”
কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, আমার যাদুধন,
অন্য কোনো কথা ঘড়ি বলে কি কখন?
মাঝে মাঝে বলে ঘড়ি, “টঙ্-টঙ্-টঙ্,
মানুষ হইয়ে যেন হয়ো না ক সঙ।
পলাশে কে ভালবাসে দেখে রাঙা রঙ্।”
মাঝে মাঝে বলে ঘড়ি, “টঙ্-টঙ্-টঙ্।”
তোতা পাখি
যোগীন্দ্রনাথ সরকার
আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মউ,
এতো ডাকি তবু কথা
কও না কেন বউ ?
কথা কব কী ছলে,
কথা কইতে গা জ্বলে!
কবিপরিচিতি: যোগীন্দ্রনাথ সরকার ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। মারা যান ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে জুন। তাঁকে বাংলা শিশু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছড়াকার বলা হয়। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সিটি বুক সোসাইটি নামের একটি প্রকাশনা সংস্থা স্থাপন করেন। এখান থেকে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর প্রথম বই ছেলেদের রামায়ণ, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘টুকটুকে রামায়ণ’, কুলদারঞ্জন রায়ের ‘ইলিয়াড’ প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত মোট গ্রন্থ ৭৮।
উপদেশ
স্বর্ণকুমারী দেবী
স্বর্ণকুমারী দেবী (২৮শে আগস্ট, ১৮৫৫ – ৩রা জুলাই, ১৯৩২) কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতকার ও সমাজসংস্কারক। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য মহিলা সাহিত্যিক। রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ বোন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো ছিলেন।]
বড়লোক যদি তুমি হতে চাও ভাই,
ভালো ছেলে তাহা হলে আগে হওয়া চাই।
খেলার সময় রেখ, তাতে ক্ষতি নাই।
পিতামাতা গুরুজনে দেবতুল্য জানি,
যতনে মানিয়া চল তাঁহাদের বাণী।
ক্রোধে হয়ো না কো অন্ধ, স্নেহে ধর পাণি।
প্রতিবাদী দাসদাসী আত্মীয় স্বজন,
ভালোবাসি সবে কহ সুমিষ্ট বচন।
নিজেরে মানো গো সুখী, বালক সুজন।
জগতের সৃষ্টিকর্তা যিনি ভগবান,
যাঁহা হতে হইতে পাইয়াছ সুখ-শান্তি প্রাণ;
মাগিয়া মঙ্গল, তাঁর কর নাম-গান।
হরিশচন্দ্র মিত্র: তিনটি কবিতা
হরিশচন্দ্র মিত্র (১৮৩৭— ৪ঠা এপ্রিল, ১৮৭২ খ্রি.); কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক। জন্ম: ঢাকায়, নিম্নমধ্যবিত্ত-দরিদ্র পরিবারে। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার প্রথম সংবাদপত্র মাসিক কবিতা কুসুমাবলী প্রকাশ। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবিতাপত্রিকা। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে মাসিক অবকাশরঞ্জিকা পত্রিকা সম্পাদনা। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা সাপ্তাহিক ঢাকা দর্পণ প্রকাশ। সম্পাদনাকৃত অন্যান্য পত্রিকা: কাব্য প্রকাশ (১৮৬৪), হিন্দু হিতৈষী (১৮৬৫), হিন্দু রঞ্জিকা (১৮৬৮)। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক মিত্র উনিশ শতকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত সর্বোৎকৃষ্ট সাময়িকীসমূহের অন্যতম। প্রথম গ্রন্থ শুভস্য শীঘ্রং, নাটক। নাটক, কাব্যগ্রন্থ ও গীতিনাট্য ছাড়াও তিনি সরলপাঠ (১৮৬৩), কবিতা কৌমুদী (৩ খন্ড), ছাত্রসখা, কুসুমলতা ও চরিতাবলীর অর্থ-সহ অনেক পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন।
বড় কে
আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়
লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।
বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার
সংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার।
গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে
বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।
সময়
খেলায় মজিয়া শিশু কাটাইয়ো না বেলা
সময়ের প্রতি কভু করিও না হেলা।
আজি যে সময় গত, হইল তোমার
আসিবে না পুনঃ তাহা আসিবে না আর।
তাই বলি বৃথা কাল করিও না ক্ষয়
আপনার কাজ কর থাকিতে সময়।
পরিচ্ছদ
মহামূল্য পরিচ্ছদ, রতন ভূষণ,
নরের মহত্ত্ব নারে করিতে বর্ধন।
জ্ঞান-পরিচ্ছদ, আর ধর্ম-অলংকার,
করে মাত্র মানুষের মহত্ত্ব বিস্তার।
মানুষের সেবা
আবদুল কাদির
হাশরের দিন বলিবেন খোদা— হে আদম সন্তান
তুমি মোরে সেবা কর নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান।
মানুষ বলিবে— তুমি প্রভু করতার,
আমরা কেমনে লইব তোমার পরিচর্যার ভার?
বলিবেন খোদা— দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে,
তারি শুশ্রূষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে।
খোদা বলিবেন— হে আদম সন্তান,
আমি চেয়েছিনু ক্ষুধায় অন্ন, তুমি কর নাই দান।
মানুষ বলিবে— তুমি জগতের প্রভু,
আমরা কেমনে খাওয়াব তোমারে, সে কাজ কি হয় কভু?
বলিবেন খোদা— ক্ষুধিত বান্দা গিয়েছিল তব দ্বারে,
মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে তাহা যদি খাওয়াইতে তারে।
পুনরপি খোদা বলিবেন—শোন হে আদম সন্তান,
পিপাসিত হয়ে গিয়েছিনু আমি, করাওনি জল পান।
মানুষ বলিবে— তুমি জগতের স্বামী,
তোমারে কেমনে পিয়াইব বারি, অধম বান্দা আমি?
বলিবেন খোদা—তৃষ্ণার্ত তোমা, ডেকেছিল জল আশে,
তারে যদি জল দিতে তুমি তাহা, পাইতে আমায় পাশে।
আবদুল কাদির (১লা জুন, ১৯০৬ —১৯শে ডিসেম্বর, ১৯৮৪) কবি, সাহিত্য-সমালোচক ও ছান্দসিক। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার আড়াইসিধা গ্রামে। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাঁচটি বিষয়ে লেটার-সহ ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সম্পাদনা করেছেন বিখ্যাত কাব্য সঙ্কলন কাব্য মালঞ্চ, মুসলিম সাহিত্যের সেরা গল্প, নজরুল রচনাবলি (প্রথম খণ্ড-পঞ্চম খণ্ড), রোকেয়া রচনাবলি, শিরাজী রচনাবলি, লুৎফর রহমান রচনাবলি, ইয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলি, আবুল হুসেন রচনাবলি, কাব্যবীথি ইত্যাদি।
কাজলা দিদি
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলাকাজলা দিদি কই?
পুকুর পাড়ে নেবুর তলে,
থোকায় থোকায় জোনাই জ্বলে,
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাই তো জেগে রই,
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
.
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো,
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন,
দিদি বলে ডাকি তখন,
ও ঘর থেকে কেন মা আর, দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি, তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
.
বল্ মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল বিয়ে হবে!
দিদির মতো ফাঁকি দিয়ে,
আমিও যদি লুকাই গিয়ে,
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে?
আমিও নাই— দিদিও নাই—কেমন মজা হবে!
.
ভুঁইচাঁপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াসনে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল |
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে
বুলবুলিটা লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা ছিঁড়তে গিয়ে ফল,
দিদি যখন শুনবে এসে বলবি কি মা বল্।
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
নেবুর তলে পুকুর পাড়ে,
ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপেঝাড়ে,
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাই তো জেগে রই,
রাত্রি হলো মাগো, আমার কাজলা দিদি কই?
——————————————————————————————
কবিপরিচিতি: যতীন্দ্রমোহন বাগচী ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে নভেম্বর নদিয়া জেলার জমশেরপুরে জমিদার পরিবারে (বর্তমান বাগচী জমশেরপুর) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১লা ফেব্রুয়ারি মারা যান।
চাষী
সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।
দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিল বড়?
পুণ্য অত হবে নাক সব করিলে জড়।
মুক্তিকামী মহাসাধক মুক্ত করে দেশ,
সবারই সে অন্ন জোগায় নাইক গর্ব লেশ।
ব্রত তাহার পরের হিত, সুখ নাহি চায় নিজে,
রৌদ্র দাহে শুকায় তনু, মেঘের জলে ভিজে।
আমার দেশের মাটির ছেলে, নমি বারংবার
তোমায় দেখে চূর্ণ হউক সবার অহংকার।
কবি পরিচিতি: রাজিয়া খাতুন চৌধুরানী ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে নোয়াখালী জেলার হরিরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মারা যান ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘পথের কাহিনি’ ও কাব্যগ্রন্থ ‘উপহার’। তবে তিনি অনেক গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন। এসব লেখা এখন আর উদ্ধার করা সম্ভব নয়।
স্বাধীনতার সুখ
বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই—
“কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই;
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা ‘পরে,
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।”
বাবুই হাসিয়া কহে— “সন্দেহ কি তায়?
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়;
পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।”
[কবি পরিচিতি: প্রখ্যাত কবি, গীতিকার ও সুরকার রজনীকান্ত সেন (২৬শে জুলাই, ১৮৬৫ — ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ১৯১০) বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি কালজয়ী নাম। ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও দেশের প্রতি গভীর মমতা বা স্বদেশপ্রেম তাঁর গানের প্রধান আলোচ্য বিষয়। প্রীতি ও হাস্যরসের গান রচনাতেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নীতিকথা তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য।
তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত দেশাত্ববোধক গান—
“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই;
দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই৷”
একটি বিখ্যাত প্রার্থনাসংগীত—
“তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর, মলিন মর্ম মুছায়ে;
তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে।”
“শৈশবে সদুপদেশ যাহার না রোচে,
জীবনে তাহার কভু মূর্খতা না ঘোচে।
চৈত্রমাসে চাষ দিয়া না বোনে বৈশাখে,
কবে সেই হৈমন্তিক; ধান্য পেয়ে থাকে?”]
আমাদের গ্রাম
বন্দে আলী মিঞা
আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,
এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।
আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,
আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইয়াছে প্রাণ।
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন,
মিলেমিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।
সকালে সোনার রবি পুব দিকে ওঠে,
পাখি ডাকে, বায়ু বয়, নানা ফুল ফোটে ।
কবি, ঔপন্যাসিক, শিশু-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিত্রকর। জন্ম ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জানুয়ারি পাবনা জেলার রাধানগর গ্রামে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। তিনি পাবনার মজুমদার একাডেমী থেকে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে কলকাতা আর্ট একাডেমীতে ভর্তি হন এবং ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম দর্শন পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগদান। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা। কলকাতা থাকাকালীন রবীন্দ্র-নজরুলের সান্নিধ্য। তখন তাঁর প্রায় ২০০ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। পল্লি প্রকৃতির সৌন্দর্য তার কবিতার প্রধান উপজীব্য। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জুন মারা যান।
কত বড়
সুকুমার রায়
ছোট্ট সে একরতি ইঁদুরের ছানা,
ফোটে নাই চোখ তার, একেবারে কানা।
ভাঙা এক দেরাজের ঝুলমাখা কোণে
মার বুকে শুয়ে শুয়ে মার কথা শোনে।
যেই তার চোখ ফোটে সেই দেখে চেয়ে—
দেরাজের ভারি কাঠ চারিদিক ছেয়ে।
চেয়ে বলে মেলি তার গোল গোল আঁখি—
“ওরে বাবা! পৃথিবীটা এত বড় নাকি?”
ইলশে গুঁড়ি
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম,
ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
দিনের বেলায় হিম।
কেয়াফুলে ঘুণ লেগেছে,
পড়তে পরাগ মিলিয়ে গেছে,
মেঘের সীমায় রোদ হেসেছে
আলতা-পাটি শিম্।
ইলশে গুঁড়ি হিমের কুঁড়ি,
রোদ্দুরে রিম্ ঝিম্।
.
হালকা হাওয়ায় মেঘের ছাওয়ায়
ইলশে গুঁড়ির নাচ,
ইলশে গুঁড়ির নাচন্ দেখে
নাচছে ইলিশ মাছ।
কেউ বা নাচে জলের তলায়
ল্যাজ তুলে কেউ ডিগবাজি খায়,
নদীতে ভাই জাল নিয়ে আয়,
পুকুরে ছিপ গাছ,
উলসে ওঠে মনটা, দেখে
ইলশে গুঁড়ির নাচ।
.
ইলশে গুঁড়ি পরীর ঘুড়ি
কোথায় চলেছে,
ঝমরো চুলে ইলশে গুঁড়ি
মুক্তো ফলেছে!
ধানেক বনে চিংড়িগুলো
লাফিয়ে ওঠে বাড়িয়ে নুলো;
ব্যাঙ ডাকে ওই গলা ফুলো,
আকাশ গলেছে;
বাঁশের পাতায় ঝিমোয় ঝিঁঝিঁ,
বাদল চলেছে।
.
মেঘায় মেঘায় সূর্য্যি ডোবে
জড়িয়ে মেঘের জাল,
ঢাকলো মেঘের খুঞ্চে-পোষে
তাল-পাটালীর থাল।
লিখছে যারা তালপাতাতে
খাগের কলম বাগিয়ে হাতে
তাল বড়া দাও তাদের পাতে
টাটকা ভাজা চাল;
পাতার বাঁশী তৈরি করে
দিও তাদের কাল।
.
খেজু পাতায় সবুজ টিয়ে
গড়তে পারে কে?
তালের পাতার কানাই ভেঁপু
না হয় তাদের দে।
ইলশে গুঁড়ি জলের ফাঁকি
ঝরছে কত বলব তা কী!
ভিজতে এল বাবুই পাখী
বাইরে ঘর থেকে;
পড়তে পাখায় লুকালো জল
ভিজলো নাকো সে।
.
ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
পরীর কানের দুল,
ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
ঝরো কদম ফুল।
ইলশে গুঁড়ির খুনসুড়িতে
ঝাড়ছে পাখা টুনটুনিতে
নেবুফুলের কুঞ্জটিতে
দুলছে দোদুল দুল্;
ইলশে গুঁড়ি মেঘের খেয়াল
ঘুম-বাগানের ফুল।
কবিপরিচিতি: ভারতীয় সাহিত্যে “ননসেন্স ছড়া”র প্রবর্তক; লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরাচিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক সুকুমার রায় ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তাঁর সন্তান। সুকুমার রায়ের লেখা কবিতার বই আবোল তাবোল, গল্প হ-য-ব-র-ল, গল্প সংকলন পাগলা দাশু, এবং নাটক চলচ্চিত্তচঞ্চরী বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা “ননসেন্স”-প্রকৃতির ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম হিসেবে খ্যাত। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ১০ই সেপ্টেম্বর ৩৫ বছর বয়সে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
আমাদের ছোট নদী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।
আর-পারে আমবন তালবন চলে,
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।
সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোট মাছ ধরে।
বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।
আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।
রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে;-
শুন মোর কথা, ধনি, নিন্দ বিধাতারে।
নিদারুণ তিনি অতি;
নাহি দয়া তব প্রতি;
তেঁই ক্ষুদ্র-কায়া করি সৃজিলা তোমারে।
মলয় বহিলে, হায়,
নতশিরা তুমি তায়,
মধুকর- ভরে তুমি পড় লো ঢলিয়া;
হিমাদ্রি সদৃশ আমি,
বন-বৃক্ষ-কুল-স্বামী,
মেঘলোকে উঠ শির আকাশ ভেদিয়া!
দূরে রাখি গাভী-দলে,
রাখাল আমার তলে
বিরাম লভয়ে অনুক্ষণ,-
শুন, ধনি, রাজ-কাজ দরিদ্র পালন!
আমার প্রসাদ ভুঞ্জে পথ-গামী জন।
কেহ অন্ন রাঁধি খায়
কেহ পড়ি নিদ্রা যায
এ রাজ চরণে।
মধু-মাখা ফল মোর বিখ্যাত ভূবনে!
তুমি কি তা জান না ললনে?
দেখ মোর ডাল-রাশি,
কত পাখি বাঁধে আসি
বাসা এ আগারে!
ধন্য মোর জনম সংসারে!
কিন্তু তব দুঃখ দেখি নিত্য আমি দুঃখী
নিন্দ বিধাতায় তুমি, নিন্দ, বিধুমুখী!
নীরবিলা তরুরাজ; উড়িল গগনে
যমদূতাকৃতি মেঘ গম্ভীর স্বননে;
মহাঘাতে মড়মড়ি
রসাল ভূতলে পড়ি
হায়, বায়ুবলে
হারাইল আয়ু-সহ দর্প বনস্থলে!
ঊর্ধ্বশির যদি তুমি কুল মান ধনে;
করিও না ঘৃণা তবু নিচ-শির জনে।
মামার বাড়ি
মামার দেশে চলে।
নিমন্ত্রণ
তুমি যাবে ভাই— যাবে মোর সাথে আমদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই— যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।
ছোট গাঁওখানি— ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কে বা কাকের চক্ষু নিয়া।
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী,
বিনাসুতি মালা গাঁথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।
তুমি যাবে ভাই— যাবে মোর সাথে ছোট সে কাজল গাঁয়
গলাগলি ধরি কলাবন যেন ঘিরিয়া রয়েছে তায়,
দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া,
বনের হাওয়ায়, গাছের ছায়ায়, ধরিয়া রাখিবে তায়,
বুকখানি তার ভরে দেবে বুঝি মায়া আর মমতায়।
তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে— নরম ঘাসের পাতে,
চুম্বন রাখি অম্বরখানিরে মেজে লয়ো নিরালাতে।
মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,
হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,
তোমার পায়ের রঙখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।
তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গে করি,
নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী (তরি);
মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া,
ঢেলা কুড়াইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি,
সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি।
তুমি যদি যাও— দেখিবে সেখানে মটর-লতার সনে,
শিম-আর-শিম হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে সেই ক্ষণে;
তুমি যদি যাও সে-সব কুড়ায়ে,
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,
খাব আর যত গেঁয়ো চাষিদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,
হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব জনে জনে।
তুমি যদি যাও— শামুক কুড়ায়ে, খুব— খুব বড় করে
এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে;
কারেও দেব না, তুমি যদি চাও
মনের খুশিতে দিয়ে দেব তাও,
মালাটিরে তুমি রাখিও কিন্তু শক্ত করিয়া ধরে,
ও পাড়ার সব দুষ্ট ছেলেরা নিতে পারে জোর করে।
সন্ধ্যা হইলে ঘরে ফিরে যাব, মা যদি বকিতে চায়,
মতলব কিছু আঁটিব যাহাতে খুশি তারে করা যায়!
লাল আলোয়ানে ঘুঁটে কুড়াইয়া
বেঁধে নিয়ে যাব মাথায় করিয়া,
এত ঘুষ (ঘুস) পেয়ে যদি বা তাহার মন না উঠিতে চায়,
বলিব— “কালিকে মটরের শাক এনে দেব বহু তায়।”
খুব ভোর করে উঠিতে হইবে, সুয্যি উঠারও আগে,
কারেও কবি না দেখিস্ পায়ের শব্দে কেহ না জাগে;
কাদার বাঁধন গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগেভাগে,
সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে।
ভর দুপুরেতে একরাশ কাদা আর একরাশ মাছ,
কাপড়ে জড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ;
“ওরে মুখ-পোড়া ওরে রে বাঁদর।’’
কতদিন আমি শুনি নারে ভাই, আমার মায়ের পাছ;
যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ।
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়,
ঘন কালো বন-মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।
মোর শিশুকাল, লুকায়েছে হায়!
আজিকে সে-সব সরায়ে সরায়ে খুঁজিয়া লইব তায়,
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।
তোরে নিয়ে যাব— আমাদের গাঁয়ে ঘন-পল্লব তলে,
লুকায়ে থাকিস, খুঁজে যেন কেহ পায় না কোনই বলে;
মেঠো কোনো ফুল কুড়াইতে যেয়ে,
হারাইয়া যাস্ পথ নাহি পেয়ে;
অলস দেহটি মাটিতে বিছায়ে ঘুমাস্ সন্ধ্যা হলে,
সারা গাঁও আমি খুজিয়া ফিরিব তোরি নাম বলে বলে।
কবিপরিচিতি: জন্ম ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে। পূর্ণ নাম: মোহাম্মাদ জসীম উদ্দীন মোল্লা। বাবা আনসার উদ্দিন মোল্লা। মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট। তাঁর নকশী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আমার হার কালা করলাম রে, আমায় ভাসাইলি রে, কাজল ভ্রমরা রে এরূপ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের রচয়িতা।
পুরস্কার: প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), একুশে পদক (১৯৭৬), স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর, ১৯৭৮)। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান।
মৃত্যু ঢাকায়, ১৪ই মার্চ ১৯৭৬। শেষ ইচ্ছা অনুসারে ফরিদপুর জেলার আম্বিকাপুর গ্রামে দাদির কবরের পাশে দাফন। গোবিন্দপুরে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে পক্ষকালব্যাপী জসীম মেলা উৎসব হয়। তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে।
ঠিক আছে
সুকুমার বড়ুয়া
অসময়ে মেহমান
ঘরে ঢুকে বসে যান
বোঝালাম ঝামেলার
যতগুলো দিক আছে
তিনি হেসে বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে ।
রেশনের পচা চাল
টলটলে বাসি ডাল
থালাটাও ভাঙা-চোরা
বাটিটাও লিক আছে
খেতে বসে জানালেন
ঠিক আছে ঠিক আছে ।
মেঘ দেখে মেহমান
চাইলেন ছাতাখান
দেখালাম ছাতাটার
শুধু কটা শিক আছে
তবু তিনি বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে ।
ছড়াকার পরিচিতি: সুকুমার বড়ুয়া ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার মধ্যম বিনাজুরি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম সর্বানন্দ বড়ুয়া, মা কিরণবালা বড়ুয়া। হাতেখড়ি হতে প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত মামা বাড়িতে থেকে শেষ করেন। এরপর বড়ো বোনের বাড়িতে এসে ডাবুয়া স্কুলে ভর্তি হন৷ সেই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর অধ্যয়নের সমাপ্তি ঘটে। অল্প বয়স থেকে তিনি বিভিন্ন মেসে কাজ করেছেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য ফলমূল, আইসক্রিম, বুট বাদাম ইত্যাদি ফেরি করে বিক্রি করেছেন৷ ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চৌষট্টি টাকা বেতনের চাকুরিতে যোগ দেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে পদোন্নতি ৩য় শ্রেণির কর্মচারীতে উন্নীত হন। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টোর কিপার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বিষয়-বৈচিত্র্য, আকর্ষণীয় উপস্থাপন, ছন্দ ও অন্তমিলের মোহনীয় সমন্বয় তার ছড়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অতি সাধারণ বিষয়ও তার প্রাঞ্জল ভাষার পরশে অসাধারণ হয়ে উঠে। অর্জিত উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৭), বাংলাদেশ শিশু একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭) ও একুশে পদক (২০১৭) অন্যতম।
প্রতিদিন খসড়া
আমাদের টেপাভুল: অনবধানতায়
— — — — — — — — — — — — — — — — —
আশু গৃহে তার দেখিবে না আর
কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে
যতদিন ভবে, না হবে না হবে,
ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।