কীভাবে হলো দেশের নাম (ইউরোপ)
ড. মোহাম্মদ আমীন
ফ্রান্স (France)
ফ্রান্স বা ফরাসি প্রজাতন্ত্র ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। এটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতির একটি। ফ্রান্স আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে; বিশ্বের প্রায় সর্বত্র এর প্রাক্তন উপনিবেশগুলি ছড়িয়ে আছে। আটলান্টিক মহাসাগর, ভূমধ্যসাগর, আল্পস পর্বতমালা ও পিরেনিজ পর্বতমালা-বেষ্টিত ফ্রান্স বহুদিন ধরে উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপের মাঝে ভৌগোলিক, আর্থনীতিক ও ভাষিক সংযোগসূত্র হিসাবে ভূমিকা পালন করে আসছে। ফ্রান্স মোটামুটি ষড়ভুজাকৃতির। এর উত্তর-পূর্বে বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গ, পূর্বে জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও ইতালি, দক্ষিণ-পশ্চিমে অ্যান্ডোরা ও স্পেন, উত্তর-পূর্বে ইংলিশ চ্যানেল, পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর, উত্তরে উত্তর-সাগর এবং দক্ষিণ-পূর্বে ভূমধ্যসাগর। ফ্রান্সের ভালোভাবে দেখলে মনে হবে প্যাঁচা।
ল্যাটিন ফ্যাঞ্চিয়া (Francia) শব্দ হতে ফ্রান্স (France) নামের উদ্ভব। এর আক্ষরিক অর্থ ফ্রাঙ্কদের দেশ। আসলে নামটি পুরো ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্য প্রকাশে ব্যবহার করা হতো। জার্মানি ভাষায় ফ্রাঞ্চকে এখনও ফ্রাঙ্করাইক (Frankreich) বলা হয়। যার অর্থ (Frank Reich) বা ফ্রাঙ্কস অধিরাজ্য (Realm of the Franks)।
ফ্রান্সের মোট আয়তন ৬,৪৩,৮০১ বর্গকিলোমিটার বা ২,৪৮,৬০০ বর্গমাইল। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, মোট জনসংখ্যা ৬,৭১,০৭,০০০ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১১৬। আয়তন বিবেচনায় ফ্রান্স পৃথিবীর ৪১-তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু জনসংখ্যা বিবেচনায় ২০-তম। অন্যদিকে জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় ৮৯-তম। সরকারিভাবে ফ্রান্সের অধিবাসীরা ফ্রেঞ্চ নামে পরিচিত। প্যারিস ফ্রান্সের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। সরকারি ভাষা ফ্রেঞ্চ। আয়তনের দিক থেকে ফ্রান্স ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র; রাশিয়া ও ইউক্রেনের পরেই এর স্থান। আর জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ইউরোপের চতুর্থ বৃহত্তম রাষ্ট্র। মূল ভূখণ্ডের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ফ্রান্সের দশটি উপনিবেশ আছে, যেগুলো বেশির ভাগই প্রাক্তন ফরাসি সাম্রাজ্য থেকে পাওয়া।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, ফ্রান্সের মোট জিডিপি (পিপিপি) ২.৬৪৭ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ৪১,২২১ ইউএস ডলার। জিডিপি (নমিনাল) ২.৪২৩ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ৩৭,৭২৮ ইউএস ডলার। মাথাপিছু আয় বিবেচনায় ফ্রান্স পৃথিবীর ২০-তম ধনী রাষ্ট্র। মুদ্রার নাম ইউরো।
ফ্রান্স বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জাতি-রাষ্ট্রের অন্যতম। মধ্যযুগে ডিউক ও রাজপুত্রদের রাজ্যগুলো একত্রিত করে একজন শাসকের অধীনে এনে ফ্রান্স গঠিত হয়। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে সেপ্টেম্বর ফ্রান্স প্রজাতন্ত্রের যাত্রা শুরু করে। এর আগে ছিল রাজতন্ত্র। ফ্রান্স জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য-দেশের একটি এবং এর ভেটো প্রদানের ক্ষমতা আছে।
১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক পতাকা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে নেপোলিয়নের আর্মি পতাকা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই থেকে এটাকে জাতীয় পতাকা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। তখন হতে এটি ফ্রান্সের জাতীয় পতাকা।
ফ্রান্সের সরকারি নাম ফ্রেঞ্চ রিপাবলিক। ফ্রান্স ইউরোপীয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশের মধ্যে বৃহত্তম দেশ। ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের মোট আয়তনের প্রায় একপঞ্চমাংশ ফ্রাঞ্চের। দেশের মোট আয়তনের এক চতুর্থাংশ বন। এটি সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের পরে। ছয় পার্শ্বিক আকৃতির জন্য ফ্রান্সকে অনেক সময় ষড়ভূজ the hexagon) দেশ বলা হয়। এখনও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ফ্রান্সের অধীন ১৫টি ভূখণ্ড রয়েছে।
ফ্রাঞ্চের মোট জনগণের ৮৫ ভাগ শহরে বাস করে। জনসংখ্যার ৮০ ভাগ রোমান ক্যাথলিক, ৫-১০% মুসলিম, ২% প্রোট্যস্ট্যান্ট, ১% ইহুদি এবং ৪% কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বিশ্বাসে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি এবং কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী নন।
জার্মানির পর জিডিপি বিবেচনায় ফ্রান্স দ্বিতীয় বৃহত্তম আর্থিক সমৃদ্ধ দেশ। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্স ৮,৭৭৯টি রেজিস্টার্ড যানবাহনসহ যত সংখ্যক ইলেকট্রিক কার বিক্রি করেছে তার পরিমাণ জার্মানি ও নরওয়ের বিক্রীত সংখ্যার দ্বিগুণ। পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট ও ফেস ট্রান্সপ্ল্যান্ট দুটোই ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ফ্রান্সের জর্জ পম্পিডো হাসপাতালে সম্পন্ন হয়েছে।
সমলিঙ্গেও বিয়ে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ হতে ফ্রান্সে বৈধ। সমলিঙ্গের বিয়ে বৈধকরণে ফ্রান্স ইউরোপে নবম এবং পৃথিবীতে ১৪-তম স্থানের অধিকারী।
ইউরোপের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ফ্রেঞ্চ আল্পস মাউন্ট ব্লান্ক ৪,৮১০ মিটার উঁচু। ফ্রান্সের লুভরে জাদুঘর (Louvre Museum) পৃথিবীর সবচেয়ে অধিক পরিদর্শিত জাদুঘর। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ৯.৩ মিলিয়ন মানুষ এটি পরিদর্শন করে। সংখ্যাটি সুইডেনের মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান।
ফ্রান্সের নাগরিকগণ বেশ দেশপ্রেমিক, রাজনীতিক সচেতন এবং বন্ধু ও প্রতিবেশীদের প্রতি সহানুভুতিশীল। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত মেট্রিক পদ্ধতির আবিষ্কারক ফ্রান্স। ফ্রান্সে বর্তমানে ব্যবহৃত আইনগত পদ্ধতি এখনও নেপলিয়নের প্রচলিত আইন দ্বারা প্রভাবিত। পৃথিবীর অন্যতম কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি, যেমন ডেকার্টে, প্যাসকেল, ভল্টেয়ার, ভাওদেলায়ার, ফ্লাউবার্ট, জ্যা পল সাত্রে, আলবার্ট ক্যামুস ফ্রান্সের নাগরিক। এ পর্যন্ত ফ্রান্স সাহিত্যে ১৫ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। পর্যটন বিবেচনাতেও ফ্রান্স পৃথিবীর অন্যতম একটি দেশ। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ৮৪.৭ মিলিয়ন লোক ফ্রান্স ভ্রমণ করেছে।
ফরাসিরা বিশ্বে শামুকখোর জাতি। প্রতিবছর গড়ে একজন ফ্রেঞ্চ ৫০০ শামুক খায়। ব্যাঙ খাওয়াতেও তারা বেশ পটু। ফ্রান্স পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও অধিক মদ উৎপাদনকারী দেশের অন্যতম। এখানে মদ প্রস্তুতের জন্য ১৭টি নির্দিষ্ট এলাকা রয়েছে। বিয়ারকে বিলাসী পানীয় গণ্য করা হয়। তবে অনেক খাবারের সঙ্গে বিনামূল্যে মদ্য প্রদান করা হয়।
লুইস (Louis XIX) কেবল ২০ মিনিটের জন্য ফ্রান্সের রাজা হয়েছিলেন। ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্স পৃথিবীতে প্রথম সমলিঙ্গের যৌনকর্মকে আইনি ঘোষণা করে। ফ্রান্সে একজন মৃত ব্যক্তিকেও আইনগতভাবে বিয়ে করা যায়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট চালর্স ডি গল গিনিস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান পেয়েছে। তাকে ৩২ বার হত্যা চেষ্টার পরও তিনি অক্ষত ছিলেন।
ফ্রান্স ডিজিটাল ক্যালকুলেটর, হট এয়ার বেলুন, প্যারাসুট, ব্রেইল, গ্র্যান্ড প্রিক্স রেসিং এবং পাবলিক ইন্টার একটিভ কম্পিউটার আবিষ্কারের জন্য খ্যাত। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সে ফিলিপ খান ক্যামেরা ফোন আবিষ্কার করেন। ফ্রান্সের তটরেখার দৈর্ঘ্য ৩৪২৭ কিলোমিটার। এটি প্যারিস হতে পেট্রার দৈর্ঘের সমান। ট্রেনের বিলম্বযাত্রা পরিহারের লক্ষ্যে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ফ্ল্যাটফর্মে যুগলদের চুম্বন নিষিদ্ধ করা হয়। ফ্রান্সের অধিবাসীর জন্য প্রতিবছর ১১.২ বিলিয়ন গ্লান মদ প্রয়োজন হয়।
================================================================================
ডেনমার্ক (Denmark) : ইতিহাস ও নামকরণ
এস্তোনিয়া (Estonia) : ইতিহাস ও নামকরণ
ফিনল্যান্ড (Finland) : ইতিহাস ও নামকরণ
সূত্র: কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক