টলস্টয় বলেছেন, “জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন— বই বই এবং বই।” টলস্টয় আসলে কোন তিনটি বইয়ের কথা বলেছেন, তা তিনি জানেন এবং কেন বলেছেন তা আমরা এক সুন্দর ব্যাখ্যায় মনের মধ্যে ধারণ করে নিয়েছি। যদিও সেই ব্যাখ্যাত ধারণা অনুসারে কাজ করি না। বাঙালির ভাবা আর কাজে কেবল তিনটি জিনিসই আছে এবং তা হলো— তফাত তফাত আর তফাত। টলস্টয়ের বই আছে তিনটি। আমাদের বই আছে চারটি। টলস্টয়ের চেয়ে একটি বেশি। হয়তো এজন্য বাঙালি এত হুজুগে। আধুনিক বাংলা অভিধানেও বই চার প্রকার। যথা: বই বই বই এবং বই। চার বইয়ের এক বই পড়ার জন্য, এক বই খাওয়ার জন্য, এক বই আস্থা বা অবিশ্বাস জ্ঞাপনের জন্য এবং বাকি বইটি বহন বা ক্রিয়া সম্পাদনের জন্য।
প্রয়োগ: বইটি আর বইগুলো বই করে ছেলেটি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গেল।
১. বই:এটি আরবিবই এবং বাংলায় সর্বাধিক ব্যবহৃত বই। অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত ও আরবি ‘বহি’ থেকে উদ্ভূত বাংলা ‘বই’ শব্দের অর্থ— একসঙ্গে গেঁথে সেলাই করা বা আঠা দিয়ে জোড়া এবং মোড়কে আবৃত লিখিত বা মুদ্রিত পৃষ্ঠার সংকলন, পুস্তক, গ্রন্থ, খাতা(হিসাবের বই, তালিকার বই ) ইত্যাদি। বই জ্ঞানের ভান্ডার। বইমেলায় বই কিনতে যাব।
সংস্কৃত গ্রন্থ শব্দের অর্থ— বই, শাস্ত্র প্রভৃতি। সুতরাং, বই ও গ্রন্থ পরস্পর সমার্থক।
২. বই: এটি দেশিবই। বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত দেশি বই শব্দের অর্থ কচুর লতি। কচুর লতি লাগলে কানের লতি চুলকায়। বই কুটে কেউ হাত দিয়ো না কানের লতিতে, এই কথাটি লেখা আছে রাঁধার বহিতে। বাজার হতে আনা বইগুলো কেটেকুটে আগুনে বসিয়ে দিল মেয়ে। বাবা বই পড়ে বই খেয়ে তৃপ্তি পেল ভারি।
কচুর লতি অর্থে বই শব্দটির প্রয়োগ বিরল।
৩. বই: এটি খাঁটি বাংলা বই। এ বই দেখা যায় না। খাঁটি বাঙালির মতো পুরোটাই অনুভবের বিষয়। আস্থা আর অবিশ্বাসের বিষয়। তাই কথা দিয়ে প্রকাশ করতে হয়।সংস্কৃত ব্যতীত হতে উদ্ভূত এবং বাক্যে সাধারণত অব্যয় হিসেবে ব্যবহৃত খাঁটি বাংলা বই অর্থ— ছাড়া, ব্যতীত, ভিন্ন, অন্য। তুমি বই আর কে করবে এমন কাজ!
তুতুমি বইআমার আর, কে আছে গো সই/ তাই তোমায় বই, আমি গোপনে দি বই। রাগ করো না সই আমার, রাগ করো না সই।
৪. বই: এটি বাংলাবই। অভিধানমতে, বাংলা বই অর্থ— (ক্রিয়ায়) বহন করি। সে বোঝা বই। বিশেষ্যে বাংলা বই বহন শব্দের বর্তমান কালের উত্তম পুরুষের রূপ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। আমরা প্রত্যেকে জীবনের বোঝা বই করি, বইকি।
প্রয়োগ: বই (পুস্তক) একটি বই (বোঝা)। এর চেয়ে বই (কচুর লতি) তোলা অনেক ভালো।
সামগ্রিক প্রয়োগ:
“বই মানে কচুর লতি, বই মানে পুস্তক,
বই মানে বহন করা” শিখিয়েছেন শিক্ষক।
বইকি:বইকি বাংলা শব্দ এবং পদ হিসেবে অব্যয়। বইকি শব্দটি ঔচিত্য নিশ্চয়তা আগ্রহ প্রভৃতি নির্দেশক শব্দ। যেমন: তুমি নিশ্চয় যাবে। তুমি যাবে বইকি। আমরা যাব বইকি।
বই কী:‘বই কী’ দুটি শব্দের সমন্বয়ের গঠিত একটি শব্দগুচ্ছ। এর মাধ্যমে বই কোন ধরনের বিষয় বা বস্তু তা জানতে চাওয়া হয়; বই বিষয়ে জানার আগ্রহ, অভিজ্ঞতা, মন্তব্য কিংবা অজ্ঞতা প্রকাশে শব্দগুচ্ছটি ব্যবহার করা যায়। যেমন:
প্রয়োগ: বই কী? বই কীতা আমি জানি না। বই কী জিনিস তা বলো-না ভাই? বই কী জিনিস দেখতে চাই। বই কী তা আমি জানি।
বই কি:বই ও কি দিয়ে বই কি শব্দগুচ্ছ গঠিত। বাক্যে কোনো বস্তু বই কি না কিংবা বই বিষয়ক কোনো সন্দেহ নিরসনের জন্য হ্যাঁ বা না কথায় উত্তর দেওয়া যায় এমন প্রশ্নে ‘বই কি’ কথাটি প্রয়োগ করা হয়।
তোমার ব্যাগে এগুলো বই কি? বই কি এনেছ বাবা? বইটা কি পড়া যায়? বইগুলো কি দেখেছে? বই কি মাগনা পাওয়া যায়?
বইটা:আরবি উৎসের বাংলা শব্দ ‘বই’-এর সঙ্গে পদাশ্রিত নির্দেশক ‘টা’ যুক্ত হয়ে ‘বইটা’ শব্দটি গঠিত। এর অর্থ: বইটি, নির্দিষ্ট একটি বই, একটি নির্দিষ্ট বই, কোনো একটি নির্দিষ্ট বহি। স্যমন্তক বইটা পড়ব। আমি বইটা পড়ব। দুলাল তুমি বইটা নিয়েছ? বইটা নিয়েছি বইকি।
বইঠা: সংস্কৃত বহিত্র থেকে উদ্ভূত বইঠা অর্থ (বিশেষ্যে)— নৌকো বাওয়ার জন্য ব্যবহৃত চওড়ামুখ পাতলা কাঠের ছোটো দাঁড়। মনমাঝি তোর বইঠা নে রে আমি আর বাইতে পারলাম না।
প্রয়োগ: বইঠার কাছে বইটা, পড়ে নিও ওইটা।
বইটা বইঠা বই বই বই
প্রকাশক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
বইঠার কাছে বইটা,
লাফায় পাশে কইটা।
আমি বই; কে যাবে আর বাজার,
বই আনব বই করে, খেতে হবে সবার।
অর্থ:
বইঠা অর্থ: নৌকোর ছোটো দাঁড়;
‘বইটা’ অর্থ: পুস্তকটি;
‘আমি বই’ অর্থ: আমি ছাড়া
‘বই আনব’ অর্থ: কচুর লতি আনব;
‘বই করে’ অর্থ: বহন করে।
বইপত্র ও বইপুস্তক: বাংলা বই ও সংস্কৃত পত্র মিলে বইপত্র (বই+পত্র) । বাক্যে সাধারণত বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত বইপত্র অর্থ— বইখাতা প্রভৃতি, পাঠসামগ্রী। বইপত্র ঠিকমতো গুছিয়ে নাও। বাংলা বই ও সংস্কৃত পুস্তক সমন্বয়ের বইপুস্তক (বই+পুস্তক) শব্দটি নির্মিত। এর অর্থ— (বিশেষ্যে) বইপত্র, বইখাতা প্রভৃতি পাঠসামগ্রী।
বইপত্র ও বইপুস্তক সমার্থক।
বইপোকা:বইপোকা বাংলা শব্দ। বাক্যে বিশেষ্য হিসেব ব্যবহৃত বইপোকা অর্থ— পুস্তকধ্বংসকারী কীট। তবে শব্দটির আলংকারিক ও বহুল প্রয়োগিত অর্থ— সারাক্ষণ বই পড়া যার নেশা, বইপ্রেমী, বই না পড়ে থাকতে পারে না এমন ব্যক্তি। বইপোকার অত্যাচারে নষ্ট হয়ে যাওয়া বইটি পড়তে না পেরে বইপোকা ছেলেটি হতাশ হয়ে গেল বিলকুল। বইপোকাদের হাত আর বইপোকাদের মুখ দুটোই বইয়ের হায়াত কমিয়ে দেয়।
বইমেলা:বাংলা ‘বই’ ও সংস্কৃত ‘মেলা’ শব্দের মিলনে গঠিত ‘বইমেলা’ শব্দের অর্থ— গ্রন্থ প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের স্থান। অনেকে লিখেন বই মেলা। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে কেবল ‘বইমেলা’ শব্দটি রয়েছে।
‘গ্রন্থমেলা’ শব্দের অর্থ— বিক্রয় ও প্রচারের উদ্দেশ্যে পুস্তকের প্রদর্শনী, বইমেলা ইত্যাদি। সুতরাং বই আর গ্রন্থ শব্দের মতো ‘বইমেলা’ ও ‘গ্রন্থেমেলা’ শব্দও পরস্পর অভিন্নভাবে সমার্থক এবং নির্বিচারে অভিন্নার্থে প্রয়োগযোগ্য।