ড. মোহাম্মদ আমীন
বতসোয়ানা (Botswana)
বতসোয়ানা দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থিত একটি স্থলবন্দি দেশ। সরকারি নাম রিপাবলিক অব বতসোয়ানা। এর দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব দিকে সাউথ আফ্রিকা, পশ্চিম ও উত্তরে নামিবিয়া এবং উত্তর-পূর্ব দিকে জিম্বাবুয়ে অবস্থিত। দেশটির কাজাঙ্গুলা সীমান্তের কয়েক শ মিটার অংশ জাম্বিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এ দেশের অধিবাসীরা বতসোয়ানা নামে পরিচিত। একবচনে এটি মতসোয়ানা । বতসোয়ানা সমতল ভূমি হলেও এর ৭০ ভাগ কালাহারি মরুভূমির অন্তর্ভুক্ত। বতসোয়ানা পৃথিবীর শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশের একটি। স্বাধীনতার পর অবিচ্ছিন্ন গণতন্ত্র এবং উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির জন্য বতসোয়ানার কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী উদাহরণ হয়ে আছে। এইচডিআই বিবেচনাতেও দেশটি পৃথিবীর সেরা কয়েকটি দেশের অন্যতম এবং সাব-সাহারান আফ্রিকায় দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী। এর রাজধানী গ্যবরন এবং মুদ্রা পুলা।
তসোয়ানা একটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির নাম। তারা সেতসোয়ানা নামক একটি উর্বর ভূখ-ে বসবাস করত। মূলত পুরো অঞ্চলে সোয়ানা উপজাতীয় লোকদের প্রবল প্রাধান্য ছিল। কথিত হয়, সেতসোয়ানায় বসবাসরত প্রধান উপজাতি সোয়ানা-এর নাম হতে বতসোয়ানা নামের উৎপত্তি। লিভিংস্টোনের মতে, সোয়ানা শব্দের অর্থ অভিন্ন বা সমান। আবার অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায়, শব্দটির অর্থ মুক্ত বা জয়। বতসোয়ানার প্রাচীন নাম ছিল বেছুয়ানাল্যান্ড । এটি ছিল ব্রিটিশ অধিকৃত ভূখ-। বেছুয়ানাল্যান্ডের প্রাচীন নাম ছিল বেচুয়ানা। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর দেশটি স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে নাম রাখা হয় বতসোয়ানা। যার অর্থ মুক্ত বা জয়। প্রাচীন জার্মান ও ব্রিটিশদের নিকট থেকে বতসোয়ানা নামটি গৃহীত হয়। স্বাধীনতার দিনই বতসোয়ানার বর্তমান পতাকা গৃহীত হয়।
বতসোয়ানার মোট আয়তন ৫,৮১,৭৩০ বর্গকিলোমিটার বা ২,২৪,৬১০ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলীয় ভাগের পরিমাণ ২.৬%। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের হিসাবমতে, বতসোয়ানার জনসংখ্যা ২১,৫৫,৭৮৪ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটার লোকসংখ্যা ৩.৪ জন । আয়তন বিবেচনায় বতসোয়ানা পৃথিবীর ৪৮-তম বৃহত্তম দেশ এবং জনসংখ্যা বিবেচনায় ১৪৫-তম। কিন্তু জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় পৃথিবীর ২৩১-তম জনবহুল দেশ।
২০১২ খ্রিস্টাব্দের হিসাবমতে, বতসোয়ানার জিডিপি (পিপিপি) ৪০.৫৫১ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ১৮,৮২৫ ইউএস ডলার। অন্যদিকে, জিডিপি (নমিনাল) ১৭.২২২ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ৭,৯৯৫ ইউএস ডলার। মুদ্রার নাম পুল। রাজধানী গ্যাবরন। সরকারিভাবে বতসোয়ানার অধিবাসীদের বতসোয়ানা বা মতসোয়ানা বলা হয়। বতসোয়ানার সরকারি ভাষা ইংরেজি ও সেতসোয়না। তবে গ্রামের ছোট ছোট শিশু থেকে সবাই সাবলীলভাবে ইংরেজি বলতে পারে। বতসোয়ানার ৭০% অধিবাসী খ্রিস্টান। স্থানীয় ধর্মবিশ্বাসী ছাড়াও অল্পকিছু সংখ্যক মুসলিম, হিন্দু ও বাহাই রয়েছে। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের আদম শুমারি অনুযায়ী মুসলিমের সংখ্যা ছিল ৫,০০০।
মিরকাটস একজাতীয় বেজি। এ জাতীয় এত বেশি সংখ্যক বেজি পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের এক জরিপে দেখা গিয়েছে, বতসোয়ানায় যত হাতি আছে, আফ্রিকার আর কোনো দেশে তত হাতি নেই। বতসোয়ানায় প্রায় ১,৩৩,৮২৯ টি হাতি আছে। হাতির সংখ্যা বিবেচনায় তাঞ্জানিয়া দ্বিতীয়। এখানে রয়েছে ১,০৮,৮১৬টি হাতি। বতসোয়ানার মোট ভূখ-ের ৩৮% ন্যাশনাল পার্ক ও বন্যপ্রানীর অভয়ারণ্য হিসাবে সংরক্ষিত।
বতসোয়ানার ওকাভাঙ্গো বদ্বীপ পৃথিবীর বৃহত্তম অর্ন্তদেশীয় বদ্বীপ । এটি পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর ও দর্শনীয় একটি স্থান। হাজার হাজার প্রাণী ও গাছপালা এ হ্রদের জলে জীবনধারণ করে। ১২ বর্গকিলোমিটারব্যাপি বিস্তৃত মাকগাডিংগাডি প্যান পৃথিবীর বৃহত্তম লবণাক্ত প্যানের অন্যতম। এখানকার আবহাওয়া রুক্ষ, তপ্ত এবং খুব কম বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টি হলে পুরো এলাকা, অসম্ভব সুন্দর নীল রঙ ধারণ করে। চারিদিক হতে ছুটে আসে ফ্লেমিঙ্গোসহ হাজার হাজার জন্তু।
বতসোয়ানা ও জাম্বিয়ার সীমান্ত মাত্র ১৫০ মিটার। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ততম সীমান্ত। কাজুঙ্গুলা ফেরি দিয়ে খুব অল্পসময়ে দুই দেশের সীমানা পাড় হওয়া যায়। উত্তর-পশ্চিমাংশে বতসোয়ানার সঙ্গে জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়ার সীমান্ত রয়েছে। এখানে একটি স্থানে চারটি দেশ মিলিত হয়েছে। এরূপ মিলনস্থানকে চৌবিন্দু বলা হয়। যদিও জিম্বাবুয়ে ও বতসোয়ানা স্থলসীমান্তে মিলিত হয়নি, তবে উভয় দেশের সীমান্ত জিম্বাবুয়ে নদী দ্বারা বিভক্ত। এখানে একটি স্থান আছে, যেখান থেকে তিনটি দেশ মাত্র ১৫০ মিটার দূরে। এ একটি জায়গা থেকে চারটি দেশের মোবাইল ফোন সংকেত পাওয়া যায়। পৃথিবীতে এমন সীমান্ত আর কোথাও নেই।
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্য হতে স্বাধীনতার সময় বতসোয়ানা ছিল পৃথিবীর একটি দরিদ্রতম দেশ। স্বাধীনতার এক বছরের মাথায় ওরাপা এলাকায় হীরার খনি আবিষ্কৃত হয়। ফলে বতসোয়ানা আফ্রিকার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়। মূল্যমান বিবেচনায় বতসোয়ানা পৃথিবীর বৃহত্তম হীরা উৎপাদনকারী দেশ তবে উৎপাদনের পরিমাণ বিবেচনায় এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় হীরা উৎপাদনকারী দেশ।
অনেকের মতে, রাশিয়া ও কানাডার পর বতসোয়ানা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ডায়মন্ড উৎপাদনকারী দেশ। পৃথিবীর মোট উৎপাদনের ১৭.৭% হীরা বতসোয়ানায় উৎপাদিত হয়। ডায়মন্ডের রাজস্বের কিয়দংশ হতে বতসোয়নায় ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করা হয়। এইডস রোগীর সংখ্যার ক্ষেত্রে সোয়াজিল্যান্ডের পর বতসোয়ানার স্থান। প্রাকৃতিকভাবে দেখার অনেক কিছু থাকলেও যোগাযোগের কারণে পর্যটকদের জন্য এখনও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠতে পারেনি।