ড. মোহাম্মদ আমীন
সংযোগ: https://draminbd.com/বলদ-তিন-প্রকার/
প্রশ্নপত্রে লেখা হয়েছে : ‘বলদ’ শব্দের অর্থ কী? ‘বলদ’ দিয়ে একটি বাক্য রচনা করো।
বাংলায় ‘বলদ’ তিন প্রকার। প্রথমটি তদ্ভব বলদ, দ্বিতীয়টি বাংলা বলদ এবং তৃতীয়টি সংস্কৃত বলদ। তিনটি বলদের নামই (বানান) অভিন্ন, কিন্তু উচ্চারণ ভিন্ন। তাই বলদগুলোকে চিনতে হলে তাদের ডাক বা চিৎকার তথা উচ্চারণ শোনা আবশ্যক।
প্রশ্নে বর্ণিত বলদের উচ্চারণ নির্দেশ করা হয়নি। সুতরাং, প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার আগে আর একটি প্রশ্ন এসে যায় এবং সেটি হচ্ছে, এটি কোন বলদ?
বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত এবং সংস্কৃত ‘বলীবর্দ’ শব্দ থেকে আগত তদ্ভব ‘বলদ’ শব্দের সংস্কৃতঘেঁষা অর্থ হচ্ছে- ষাঁড়, বৃষ, যে ষাড়ের মুণ্ড ছিন্ন করা হয়েছে, যে গোরু হাল বা গাড়ি টানে প্রভৃতি। অভিধানে শব্দটির আর একটি অর্থ আছে, যা বাংলায় প্রচুর ব্যবহৃত হয় এবং সেটি হচ্ছে, নির্বোধ। বাংলায় ‘বলদ’ অর্থ নির্বোধ। তাই কাউকে ‘বলদ’ ডাকলে কষ্ট পায়; কে চায় নির্বোধ আখ্যয়িত হতে? তবু কোনো না কোনো সময় বাংলা বলদ নামি ভর্ৎসিত হয়নি, এমন মানুষ বাংলাদেশে নেই। এখন তো, প্রায় স্ত্রীর কাছে তাদের স্বামী একটা বাংলা বলদ।
যাই হোক, এগুলো অন্য বিষয়।
বলদের উপর্যুক্ত অর্থ প্রকাশে ব্যবহৃত ‘বলদ’ শব্দের উচ্চারণ হচ্ছে, ‘বলোদ্’। প্রশ্নে যেহেতু ‘বলদ’ শব্দের উচ্চারণ দেওয়া হয়নি, সেহেতু উত্তর যথার্থ হবে কি না তা সংশয়ে থেকে যায়।‘বলদ’ [উচ্চারণ- বলোদ্] শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ষাঁড়, বৃষ এবং যে গোরু হাল বা গাড়ি টানে’ সেটিও বলদ।
আমরা সাধারণত গোরুবিষয়ক অভিধায় বলদ বলতে কেবল বুঝি- যে ষাড়ের মুণ্ড ছিন্ন করা হয়েছ। কিন্তু অভিধানে, ষাড়, বৃষ এবং যে গোরু হাল বা গাড়ি টানে’ সেটিও বলদ; এদের বলদ হওয়ার জন্য মুণ্ড ছিন্ন করার প্রয়োজন নেই।
তবে বলদ যখন সংস্কৃত (বল্+√দা+অ) তখন শব্দটির অর্থ – বল দেয় এমন, বলদায়ক। তখন এর উচ্চারণ বলোদ নয়, বলোদো।
অতএব, শুধু বানানের উপর নয়, উচ্চারণের উপরও শব্দের অর্থ নির্ভর করে। তদ্ভব বলদ যতই অবাঞ্ছিত হোক না কেন, সংস্কৃত বলদ সবার প্রত্যাশিত।
প্রশ্নের ‘বলদ’ যেহেতু নিঃশ্চুপ ( উচ্চারণ দেওয়া হয়নি), সেহেতু এর উত্তর হতে পারে অনেকগুলো। যেমন : বলদ (ষাঁড়) : বলদটির শিং বেশ ধারালো। বলদ (বৃষ) : বলদটি ভীষণ লড়াই করে। বলদ (যে ষাঁড়ের মুষ্ক ছিন্ন করা হয়েছে) : মুণ্ড চিহ্ন করার পর ষাঁড়টি শান্ত। বলদ (দামড়া) : সাদা গাভিটা একটা বলদ বাচ্চা দিয়েছে। বলদ (যে গোরু হাল বা গাড়ি টানে) : বলদ টানে গরুর গাড়ি। বলদ (নির্বোধ) : বাংলাও জানো না, তোমার মতো বলদ আর দেখিনি। বলদ (বলদায়ক) : মোদি বিজেপি দলের বলদ। যদি বাক্য না-লিখে কেউ, ‘বল’ শব্দের অর্থ লিখতে বলেন, তাহলে তা যথাযথভাবে লেখা সম্ভব নয়।
কারণ বাক্য এবং উচ্চারণ পরিপ্রেক্ষিতে শব্দটি ভিন্নার্থ ধারণ করে। যেমন : কমল, তুই বল, শুধু বল দিয়ে বল খেলা যায় না।” এই বাক্যে তিনটি ‘বল’ আছে এবং তিনটি ‘বল’ এর অর্থ বাক্যে পদটির অবস্থান অনুযায়ী ভিন্ন। বাক্য এবং ক্ষেত্র বিশেষে উচ্চারণ পরিপ্রেক্ষিতে শব্দের অর্থ নির্ধারিত হয়। তাই শব্দ ও পদের অর্থ সবসময় অভিন্ন হয় না। এজন্য শুধু শব্দের নিজস্ব অর্থ, ভাব প্রকাশের জন্য যথেষ্ট নয়।
শব্দের আভিধানিক অর্থ যাই হোক না কেন, বাক্যের উপরই শব্দের অর্থ বহুলাংশে নির্ভরশীল। আবার অনেক সময় বাগ্ধারা বা নানা শাব্দিক সজ্জার কারণে শব্দের আভিধানিক অর্থ পুরোটাই বদলে যেতে পারে। নিচের বাক্যগুলো দেখুন
(১) অর্থ, নয়ছয় করায় তাকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করা হলো।
(২) নয়ছয় যোগ করলে কত হয়।
(৩) অর্ধচন্দ্র পূর্ণচন্দ্রের চেয়ে সুন্দর।
প্রথম বাক্যে ‘অর্থ’ মানে টাকা। ‘নয়ছয়’ মানে অপচয় এবং ‘অর্ধচন্দ্র’ মানে গলাধাক্কা। কিন্তু আভিধানিকভাবে, ‘অর্থ’ বলতে ধনসম্পদ বা টাকাকাড়ি ছাড়াও ধনবিজ্ঞান, শব্দের তাৎপর্য, হেতু, তত্ত্ব, সত্য, জাগতিক সৌভাগ্য, ইচ্ছা, অভিলাষ, জ্ঞাতব্য বিষয়, কাম্য বস্তু, কল্যাণ প্রভৃতি বোঝায়।
‘অর্ধচন্দ্র’ অর্থ অর্ধেক চন্দ্র এবং ‘নয়ছয়’ অর্থ নবম ও ষষ্ঠ। কেউ যদি বাক্য বিবৃত না করে কেবল জানতে চান, ‘অর্থ’, ‘অর্ধচন্দ্র’ বা ‘নয়ছয়’ মানে কী? তাহলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাক্যের মতো উত্তর আসতে পারে। আবার দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাক্যের ‘নয়ছয়’ এবং ‘অর্ধচন্দ্র’ শব্দের উত্তর আসতে পারে প্রথম বাক্যের ‘নয়ছয়’ এবং ‘অর্ধচন্দ্র’ শব্দের অর্থের মতো। যা বাক্য বিবেচনায় যথার্থ নয়।
বাক্য ছাড়া কোনো শব্দের অর্থ যথাযথভাবে বলা যায় না। কারণ একটি শব্দের একাধিক অর্থ আছে। অধিকন্তু বাক্যে ব্যবহৃত হলে উদ্দেশ্য এবং পরম্পরা অনুযায়ী শব্দের অর্থেরও পরিবর্তন হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, শ্বেত হস্তী মানে সাদা হাতি নয় আবার বল, মানে শুধু শক্তি নয়। চোখের বালি মানে যে, চক্ষু এবং ধুলো নয় তাও আমরা জানি।
‘পদার্থ’ অর্থ কখনো আয়তন ও ভরবিশিষ্ট বস্তু আবার কখনো পদ বা শব্দের অর্থ। কোনটি হবে তা বলে দেবে বাক্য। অতএব কেউ কোনো শব্দের অর্থ জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট বাক্যটিও যুক্ত করে দেওয়া সমীচীন।
ব্যাকরণের কাজ হচ্ছে ভাষাকে ভাসিয়ে যাওয়া হতে সযত্ন আদরে রক্ষা করা, ঠিক যেটি করে থাকে ভেলা বা আধুনিক জলযান। কিন্তু জলযান যখন নিজেই ডুবিয়ে মারার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন মানুষ ওই জলযানকে ভেঙে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে।শব্দ, বাক্য ও ভাষাকে দ্ব্যর্থহীন প্রাঞ্জলতা, সর্বজনীন নান্দনিকতা এবং আদর্শ অবয়ব প্রদানপূর্বক কার্যকর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠাই ব্যাকরণের উদ্দেশ্য। তাই এটি একটি নির্দিষ্ট বিধি অনুসরণ করে চলে, কিন্তু যেক্ষেত্রে ব্যাকরণবিধি নিজেই কার্যকর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে কিংবা অর্থদ্যোতনায় সংশয় আনে, সেক্ষেত্রে ব্যাকরণকে সরিয়ে ফেলাই উত্তম। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়া যাক :
ব্যাকরণমতে যদি বলি তাহলে,
করিলাম থেকে করলাম (সাধু থেকে চলিত)।
বলিলাম থেকে বললাম
ধরিলাম থেকে ধরলাম
চলিলাম থেকে চললাম
কিন্তু,
‘আসিলাম থেকে আসলাম’ ব্যাকরণসম্মত হলেও লেখা সমীচীন নয়।
কেন?
একমাত্র কারণ সংশয়মূলক অর্থ। “আমি আসলাম “, শব্দের অর্থ হতে পারে -I came, বা I am Aslam. এমন দ্ব্যর্থবোধকতা হতে পাঠক-শ্রোতাকে রক্ষা করার জন্য লিখতে হবে, “আমি আসলাম” বাক্যের ‘আসলাম’ শব্দের পরিবর্তে লিখুন “আমি এলাম।”
যদি আপনার বক্তব্য, I am Aslam হয়, তাহলে লিখতে পারেন, “আমি আসলাম”।
আর একটা উদাহরণ দেখুন:
ব্যাকরণ বিধিমতে যদি বলা হয়, তাহলে –
বলিল থেকে বলল
ধরিল থেকে ধরল
মরিল থেকে মরল
এগুলো বিধিসম্মত;
কিন্তু
“আসিল’ থেকে ‘আসল’ ব্যাকরণসম্মত হলেও লেখা সমীচীন নয়। কারণ, সেক্ষেত্রে শব্দটির অর্থদ্যোতনায় সংশয় সৃষ্টি হতে পারে। যদি বলা হয়, “সে আসল। এর অর্থ হতে পারে He is real, অথবা “He came”। কিন্তু আপনি যদি লিখেন সে এল, তাহলে অর্থদ্যোতনায় কোনো সংশয় সৃষ্টি হবে না।
আর একটি শব্দ, কমল।
‘কমল’ শব্দটির অর্থ হতে পারে পদ্ম অথবা কমিল, আবার কারও নামও হতে পারে। সাধু ‘কমিল’ শব্দের চলিত রূপ ‘কমল’ ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ হলেও প্রায়োগিকভাবে প্রত্যাশিত নয়।
কারণ– “জল কমল” — বাক্যের অর্থ হতে পারে ‘জল কমে গেল’। আবার হতে পারে ‘জলের পদ্ম’। বক্তা বা লেখক কোনটা বলতে চাইছেন, তা ‘জল কমল’ বাক্য দিয়ে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় না।
তাই লিখুন, “জল কমে গেল”, যদি সত্যি সত্যি জল কমে যায়।
‘কমল’ দিয়ে পদ্ম বোঝালে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু ‘কমল’ ব্যক্তির নামও হতে পারে। হতে পারে সে ব্যক্তি ছেলে কিংবা মেয়ে।
প্রকাশক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.