বাংলাদেশ (Bangladesh) : ইতিহাস ও নামকরণ

কীভাবে হলো দেশের নাম (এশিয়া)

ড. মোহাম্মদ আমীন

বাংলাদেশ (Bangladesh)

বাংলাদেশ প্রাচীন হলেও ইতিহাস অত প্রাচীন নয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে মহাবীর আলেকজান্ডার ভারতে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। মূলত তখন হতে উপমহাদেশে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা। প্রাচীনকালে গঙ্গা নদীর পূর্ব তীরে গঙ্গারিডি নামের একটি রাজ্য ছিল। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান ইতিহাসবেত্তাদের বিবরণ বিশ্লেষণে গঙ্গারিডি রাজ্যটি ছিল বর্তমান বাংলাদেশ। সুতরাং জানামতে, বাংলাদেশের প্রাচীন নাম গঙ্গারিডি। ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে প্রথম বঙ্গ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। বৌধায়ন ধর্মসূত্র অনুযায়ী এটি ছিল সর্বনিকৃষ্ট অঞ্চল। তাই নাম বঙ্গ।

রিয়াজুস সালাতিন গ্রন্থে বঙ্গ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি গল্প আছে। নুহ নবীর (নোহা) আমলে সংঘটিত মহাপ্লাবনে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়। পৃথিবীকে নতুনভাবে বসবাসযোগ্য করে তোলার জন্য নুহ নবি তার পুত্র হামকে পৃথিবীর দক্ষিণাংশে প্রেরণ করেন। হাম এর প্রথম পুত্র হিন্দ এবং দ্বিতীয় পুত্র বঙ্গ বা বং। হিন্দ এর নামানুসারে ভারতবর্ষের নাম হয় হিন্দুস্থান এবং দ্বিতীয় পুত্র বঙ্গ বা বং এ এলাকায় বসতি স্থাপন শুরু করেন। তাই এলাকাটির নাম হয় বং বা বঙ্গ।

মহাভারতেও বঙ্গ নামকরণ নিয়ে একটি গল্প আছে। বলি রাজা সমুদ্র পরিভ্রমণের সময় গঙ্গায় ভাসমান ঋষি দীর্ঘতমাকে দেখতে পেয়ে সযতেœ বাড়ি নিয়ে আসেন। বলি রাজা সন্তান উৎপাদনের জন্য তার স্ত্রী সুদেষ্ণাকে ঋষির নিকট সমর্পণ করেন। রাণী সমর্পিতা রাণীকে ঋষি বললেন, তোমার অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম নামের পাঁচটি পুত্র জন্ম নেবে। তাদের প্রত্যেকের নামে একটি করে রাজ্য হবে। বলি রাজার স্ত্রী সুদেষ্ণার গর্ভে ঋষি দীর্ঘতমার বঙ্গ নামীয় পুত্রের নামানুসারে এলাকার নাম হয় বঙ্গ।

৮০৫ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রকুট মহারাজ গোবিন্দের তাম্রশাসনে বঙ্গাল নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। বঙ্গ ও আল শব্দের সমন্বয়ে বাঙ্গাল শব্দের উদ্ভব। সেমিটিক ভাষায় আল শব্দের অর্থ সন্তান বা বংশধর বা জনগণ। সুতরাং বাঙ্গাল শব্দের অর্থ বঙ্গের সন্তান। গ্রিয়ারসন এর মতে বঙ্গ ও আলয় শব্দ হতে বাঙ্গাল নামের উদ্ভব। আলয় অর্থ বাসভূমি; সুতরাং বাঙ্গাল শব্দের অর্থ হচ্ছে বঙ্গদের বাসভূমি। সুকুমার সেন এর মতে বঙ্গ ও পাল শব্দ হতে বঙ্গপাল এবং বঙ্গপাল হতে বাঙ্গাল নামের উদ্ভব। বঙ্গপাল অর্থ বঙ্গে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী।

রিজিয়া রহমান বং থেকে বাংলা গ্রন্থে বাঙ্গাল নামের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি কিংবদন্তির অবতারণা করেছেন। প্রাগৈতিহাসিক যুগে বং নামের এক পুরুষ এবং এলা নামের এক রমণী সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে গঙ্গনদীর তীরে সৃষ্ট দ্বীপটিতে আশ্রয় পায়। এখানে তারা বসতি গড়ে তোলে। বং ও এলা নাম দুটি যুক্ত হয়ে এলাকার নাম হয় বঙলা এবং তাদের বংশধরগনের নাম হয় বঙাল। এ বঙলা শব্দ হতে এলাকার নাম হয় বাংলা বাঙ্গলা।

আবুল ফজল আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে বাংলা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তারমতে বং ও আল শব্দ দুটি যুক্ত হয়ে বঙ্গাল>বাঙ্গাল নামের উদ্ভব। আল শব্দের অর্থ বাঁধ। প্রাচীন বঙ্গের রাজন্যবর্গ দশ গজ উঁচু এবং বিশ গজ প্রশস্ত বাঁধ বা আল নির্মাণ করতেন। এ বং নামের সাথে আল যুক্ত হয়ে এলাকার নাম হয় বাঙ্গাল> বঙ্গ+ আল। কেউ কেউ মনে করেন, বঙ জনগোষ্ঠীর লোকেরা নিচু জমিকে প্লাবন হতে রক্ষার জন্য উঁচু বাঁধ বা আল দিয়ে রাখতো। বঙ ও আল শব্দ যুক্ত হয়ে নাম হয় বাঙ্গাল।

অনেক ইতিহাসবেত্ত মনে করেন, বান্স শব্দ হতে বঙ্গ শব্দের উদ্ভব। বান্স তিব্বতি শব্দ। এর অর্থ স্যাঁতস্যাঁতে কিংবা জলময়। প্রাচীনকালে এলাকাটি জলমগ্ন ও স্যাঁতস্যাতে ছিল। তাই তিব্বতিরা এলাকাটিকে বান্স নামে অভিহিত করেন। এ বান্স হতে বঙ্গ নামের উদ্ভব হতে পারে। অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা মনে করেন, বং শব্দ হতে বঙ্গ নামের উদ্ভব। প্রাচীনকালে গঙ্গাবিধৌত এ অঞ্চলে বং বা বঙ্গ নামের জনগোষ্ঠীর লোক বাস করতো। বং বা বঙ্গ গোষ্ঠীর লোক বসবাস করতো বলে এলাকার নাম হয় বঙ্গ।

বাংলাদেশের মোট আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার বা ৫৬,৯৭৭ বর্গমাইল। জলীয় ভাগের পরিমাণ ৬.৪%। মোট জনসংখ্যা ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে ১৫,৬৫,৯৪,৯৬২ এবং প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যা ১,০৩৩। আয়তনের দিক হতে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৯৪-তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু জনসংখ্যার দিক হতে ৮ম। অন্যদিকে জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক হতে বাংলাদেশ পৃথিবীর ১২-তম জনবহুল দেশ। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে বাংলাদেশের জিডিপি (পিপিপি) ৫৭২.৪৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলার (৩৪-তম) এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ৩,৫৮১ (১৪৪-তম) ইউএস ডলার। জিডিপি (নমিনাল) ২০৫.৩২৭(৪৪-তম) বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ১,৩১৪ ইউএস ডলার (১৫৫-তম)। গিনি ও এইচডি আই মধ্যম। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত হতে পৃথক হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২৬ মার্চ পাকিস্তান হতে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হয়। জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ। এ দেশের ৩০% লোক দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনবহুল রাষ্ট্র। এর সাংবিধানিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব সীমান্তে ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মায়ানমার অবস্থিত। এছাড়াও দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। এ দেশের ভূখন্ড ভৌগোলিকভাবে একটি উর্বর বদ্বীপের অংশ বিশেষ। বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় দীর্ঘ সময় ধরে বাঙালি জাতি বাস করছে। প্রাচীন “বঙ্গ” ভূণ্ডের পূর্বাংশ পূর্ব বাংলা নামে পরিচিত, যা বর্তমানে বাংলাদেশ। পৃথিবীতে যে ক’টি রাষ্ট্র জাতিরাষ্ট্র হিসাবে মর্যাদা পায় তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

বাংলাদেশের বর্তমান সীমান্ত তৈরি হয়েছিল ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাবসানে, বঙ্গ (বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি) এবং ব্রিটিশ ভারত বিভাগ করা হয়েছিল। বিভাগের পরে বর্তমান বাংলাদেশের অঞ্চল তখন পূর্ব বাংলা নামে পরিচিত, যেটি নবগঠিত দেশ পাকিস্তানের পূর্ব অঞ্চল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। পাকিস্তান অধিরাজ্যে থাকাকালীন ‘পূর্ববাংলা’ থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে পরিবর্তন করা হয়।

বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম যদিও আয়তনের হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে ৯৪তম; ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অষ্টম। বাংলাদেশের প্রায় ৫৬% লোক কৃষি কাজে জড়িত থাকলেও রাজস্ব আয়ের সিংহভাগ আসে তৈরি পোশাক শিল্প হতে। অধিক হাসাকে বাংলাদেশ অপরিপক্কতা হিসাবে গণ্য করা হয়। তাই বাংলাদেশের মানুষ সহজে হাসে না। সম্ভবত এ দেশের জনগণ সবচেয়ে কম হাসে। অবশ্য এর সঙ্গে আর্থিক সংকটও জড়িত। পেটে ভাত না থাকলে তো আর মুখে হাসি আসে না। কম হাসলেও তারা অবন্ধুসুলভ নয়।

মাতৃভাষার জন্য বাঙালিরা জীবন দিলেও শুদ্ধ মাতৃভাষা লেখায় শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত সর্বশ্রেণির বাঙালির চরম অবহেলা ও অজ্ঞতা লক্ষণীয়। পৃথিবীর আর কোনো জাতি মাতৃভাষার প্রতি এমন অবহেলা দেখায় না। বাংলায় লিখিতভাবে শুদ্ধ প্রমিত দাপ্তরিক পত্রের সংখ্যা খুব কম।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছন্ন সমুদ্র সৈকত। বাংলাদেশ ২০০০ সাময়িকী এবং দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। অথচ সংবাদপত্র পাঠর হার মোট জনসংখ্যার ১৫%। মহাস্থানগড় বাংলাদেশের প্রাচীন শহর। প্রতিবছর বাংলাদেশে গড়ে ৮০টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। গভীরতা গড়ে ২০ মিটার। একসময় এ নদী ছিল সৌন্দর্যের আধার। এখন এ নদীর পানি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দুষিত। পান করা দূরে থাক, হাত-মুখ ধোয়াও বিপজ্জনক। প্রাকৃতিকভাবে অনেক সুন্দর হলেও বাংলাদেশে পর্যটকদের সংখ্যা আশানুরুপ নয়। তবে কোনো বিদেশি পর্যটক দেখলে সবাই অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। তাই বাংলাদেশ শ্বেত চামড়ার পর্যটকেরা নিজেদের হলিউডে অভিনেতা মনে করতে পারেন সহজে। সংরক্ষিত সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো এটাকে পৃথিবীর ঐতিহ্য ঘোষণা করে। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে এখন পর্যটকদের জন্য প্রায় সকল আধুনিক সুবিধা গড়ে তোলা হয়েছে। ইনানি পৃথিবীর সুন্দরতম সৈকতের একটি।

বাংলাদেশকে বলা যায় রিক্সার শহর। শহরে-গ্রাম, মহাসড়ক-মেটোপথ সর্বত্র রিক্সা আর আর রিক্সা। বাংলাদেশের রিক্সাসমূহ প্রতিদিন ২,৯০,০০,০০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। যা লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলাচলরত সকল প্রকার যানবাহনের অতিক্রান্ত দূরত্বের দুইগুণেরও বেশি। আর একটি আকর্ষণীয় তথ্য : একজন ব্যক্তি ৫০০০ এর অধিক বিদেশি মুদ্রা বাংলাদেশ হতে বাইরে নিতে পারেন না, আবার আনতেও পারেন না।

সূত্র : কীভাবে হলে দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।


মৌরিতানিয়া (Mauritania) : ইতিহাস ও নামকরণ

মরক্কো (Morocco) : ইতিহাস ও নামকরণ

মরিশাস (Mauritius) : ইতিহাস ও নামকরণ

মোজাম্বিক (Mozambique): ইতিহাস ও নামকরণ

এশিয়া : এশিয়া মহাদেশ : ইতিহাস ও নামকরণ

আফগানিস্তান (Afghanistan) : ইতিহাস ও নামকরণ

আযারবাইজান (Azerbaijan) : ইতিহাস ও নামকরণ

আর্মেনিয়া (Armenia) : ইতিহাস ও নামকরণ

বাহরাইন (Bahrain) : ইতিহাস ও নামকরণ

বাংলাদেশ (Bangladesh) : ইতিহাস ও নামকরণ

 

Language
error: Content is protected !!