বাংলা ভাষার শব্দসম্ভার
ড. মোহাম্মদ আমীন
সাধারণভাবে মনে করা হয়, বাংলা ভাষায় প্রায় দেড় লাখ শব্দ রয়েছে। গবেষকদের মতে, এ শব্দগুলোর সব এখনো অভিধানভুক্ত করা যায়নি। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলা ভাষায় শব্দের সংখ্যা দুই লাখের অধিক। আবার অনেকে মনে করেন, এ সংখ্যা কমপক্ষে চার লাখ। বিভিন্ন গবেষক বিভিন্নভাবে বাংলার শব্দভান্ডারের সংখ্যা নির্ধারণ করেছেন। আসলে সবটিই বলা যায় অনুমান। প্রকৃতপক্ষে, বাংলা শব্দভান্ডারে শব্দ সংখ্যা কত তা জানার জন্য এ পর্যন্ত কোনো গবেষণা বা জরিপ কিছুই হয়নি।এ বিষয়ে শুবাচ তার নিজস্ব পরিসরে গত তিন বছর গবেষণা চালিয়ে শব্দ সংখ্যা নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কাজটি অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল। তাই শুবাচের পক্ষে তা সন্তোষজনকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। শুবাচ নিজস্ব পরিসরে গবেষণা করে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। কিন্তু তা যে যথার্থ— এমনটি কোনোভাবে বলা যাবে না। তবে এই গবেষণা থেকে বাংলা ভাষার শব্দসম্ভার সম্পর্কে একটা মোটিামুটি ধারণা পাওয়া যায়।
বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় অভিধান জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাংলা ভাষার অভিধান’। এটি ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় । এখানে প্রায় ৭৫ হাজার শব্দ সংকলিত হয়েছে। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে শব্দসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক লক্ষ পনের হাজার। সাধারণভাবে বৃৎহ কলেবরে সংকলিত একটি বাংলা অভিধানে কমবেশি ৭৫,০০০ পৃথক শব্দ তালিকাভুক্ত করা হয়ে থাকে। তন্মধ্যে ৬৭ ভাগ তৎসম, ২৮ ভাগ তদ্ভব এবং বাকিগুলো দেশি, বিদেশি এবং অন্যান্য। তবে শব্দসমূহের একটি বিশাল অংশ অব্যবহার, অতি প্রাচীন বা অত্যন্ত প্রযুক্তিগত হবার কারণে প্রকৃত ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে। সে বিবেচনায় গবেষকগণ মনে করেন, আধুনিক বাংলায় সাহিত্যিক কাজে ব্যবহৃত শব্দভাণ্ডারে ৬৭% তদ্ভব ও ২৫% তৎসম শব্দ রয়েছে। বাকি ৮% হলো দেশি, বিদেশি এবং অন্যান্য। অনেক গবেষক মনে করেন— এই হিসেবটিও যথার্থ নয়।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে অভিধান প্রণয়নের জন্য বাংলা একাডেমি একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিল। এ কমিটিতে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুনীর চৌধুরী, অজিত কুমার গুহ ও আহমদ শরীফের মতো পণ্ডিতবর্গ। সামসময়িক আরও অনেক বিশেষজ্ঞকেও এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ড. মুহম্মদ এনামুল হকের সম্পাদনায় স্বরবর্ণ অংশ, ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যাপক শিবপ্রসন্ন লাহিড়ীর সম্পাদনায় ব্যঞ্জনবর্ণ অংশ এবং ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে অখণ্ড পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ নামে প্রকাশিত হয়। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় পরিমার্জিত সংস্করণ। এতে ভুক্তি ও উপভুক্তি মিলে মোট ৭৩ হাজার ২৭৯টি শব্দের অভিধা পাওয়া যায়। শেষ সংস্করণে এ অভিধানে নতুন প্রায় দুই হাজার শব্দ যুক্ত হয়েছে। সে হিসেবে বাংলা শব্দের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৭৫ হাজার।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’- এটিই বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড়ো অভিধান। এতে প্রায় দেড় লাখ (শুবাচের গবেষণামতে এক লাখ উনপঞ্চাশ হাজার ৯২৩) শব্দ যুক্ত হয়েছে। এ হিসাবে গত ১০০ বছরে বাংলার শব্দ সংকলনে যুক্ত হয়েছে মাত্র ৩৫ হাজার শব্দ। তাহলে বাংলা ভাষার শব্দ সংখ্যা কি কেবল দেড় লাখ?
জাতীয় জ্ঞানকোষ ‘বাংলাপিডিয়া’র প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “বাংলা একাডেমির অভিধানে সংকলিত শব্দসংখ্যা দিয়ে বাংলা শব্দভাণ্ডারের শব্দসংখ্যা নির্ধারণ করা যাবে না। কারণ বাংলা একাডেমি যে অভিধানগুলো করেছে, তা সাহিত্যভিত্তিক। বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে যুক্ত হয়েছে কেবল সেসব শব্দ, যা বাংলা সাহিত্যে ঢুকেছে। এর বাইরেও অগণিত শব্দ রয়ে গেছে। তাঁর মতে, আমাদের ভূখণ্ডের সব যুগের, সব শ্রেণির, সব ধর্মের, সব সংস্কৃতির শব্দকে সংকলিত করলে বাংলা শব্দের সংখ্যা দুই লাখের কম হবে না। কিন্তু এসব শব্দ সংকলিত করার কোনো উদ্যোগ এখনও গ্রহণ করা হয়নি। এশিয়াটিক সোসাইটি ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এ রকম একটি উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফলকাম হয়নি।”
আর একটি হিসেবমতে, ১১টি স্বরবর্ণ ও তিনটি অতিরিক্ত চিহ্নসহ ৩৯ টি ব্যঞ্জনবর্ণ নিয়ে বাংলা বর্ণমালার অবয়ব। বর্ণগুলোর সমন্বয়ে তৎসম, দেশি, বিদেশি, তদ্ভব ইত্যাদি মিলে সৃষ্ট মোট শব্দের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার। এর মধ্যে পঞ্চাশ হাজার তৎসম, আড়াই হাজার আরবি-ফারসি, অনুমান চারশ তুর্কি, এক হাজার ইংরেজি, দেড়শ পর্তুগিজ-ফারসি, কিছু বিদেশি এবং বাদবাকি তদ্ভব ও দেশি শব্দ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখরের মতে, বাংলা শব্দভান্ডারে শব্দসংখ্যা চার লাখের কম হবে না(কালের কণ্ঠ, ২১.০২.২০১৪)। হায়াৎ মামুদের মতে, “বাংলা শব্দভান্ডারে শব্দ সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি হবে। তবে, এ বিষয়ে ব্যাপকভিত্তিক কোনো গবেষণা না হওয়ার কারণে প্রকৃত সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।”
কেউ কেউ মনে করেন, সবদিক বিবেচনা করলে বাংলা ভাষায় শব্দের সংখ্যা তিন লাখের কাছাকাছি হয়ে যাবে। অথচ এ পর্যন্ত মাত্র দেড় লাখ শব্দ অভিধানভুক্ত করা গিয়েছে, অন্যদিকে সাহিত্যে আছে মাত্র – পঁচাত্তর হাজার শব্দ। বেশির ভাগ শব্দ আসলে কথায় আছে লেখায় নেই। যা বাংলা ভাষার জন্য কোনও শুভলক্ষণ নয়।
শুবাচের গবেষণামতে, বাংলায় শব্দ সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার। তবে, অভিধানভুক্ত শব্দের সংখ্যা সব মিলিয়ে এক লাখ ৫১ হাজারের মতো। শুবাচের গবেষণামতে, বাংলা শব্দভান্ডারের শব্দসমূহের মধ্যে ৬৬.১ ভাগ তৎসম এবং ২৮.৬ ভাগ তৎসম বাকিগুলো দেশি ও অন্যান্য। তবে বর্তমানে সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার অনেক কমে গেছে। অব্যবহার, প্রাচীনত্ব, অপরিচিত, অভিধানের বাইরে অবস্থান— প্রভৃতি কারণে অনেক সংস্কৃত শব্দ অপরিচিত হয়ে গিয়েছে। এসব বিবেচনায় বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডারে বর্তমানে ৬৬.৮ ভাগ তদ্ভব, ২৪.৬ ভাগ তৎসম এবং বাকি ৮.৬ দেশি, বিদেশি এবং অন্যান্য শব্দ রয়েছে বলে মনে করা যায়।