টিএস রহমান
মাঝে মাঝে আমি পরিচিতজনদের ঠাট্টা করে বলি, ‘আচ্ছা বলুন তো, আপনার বাবার দাদা আর দাদার বাবা এ দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক কী?’
বিষয়টি যাদের জানা নেই তাঁরা প্রথমে একটু হকচকিয়ে যান। পরে হিসাব-নিকাশ করে হাসতে হাসতে বলেন, ‘একই ব্যক্তি।’
এটা নিছক ঠাট্টা। আমি করতে পারি কারণ আমি একজন মানুষ এবং আমার ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি আছে।
কিন্তু বাংলা একাডেমি তো ব্যক্তি নয়। এটি একটি প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় প্রতিষ্ঠান, বাঙালির ভালোবাসার ইন্সটিটিউশন। এর কি ব্যক্তিসম আবেগ-অনুভূতি থাকা উচিত? উচিত না। কিন্তু থাকে। লক্ষ্য করুন:
“উৎসর্গ
অপ্সরী চৌধুরী-কে
বাবার বাবা”।
এটি বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানের উৎসর্গপত্র। একাডেমি কোনো বই কাউকে উৎসর্গ করতে পারবে না তা নয়। উৎসর্গ করা যেতে পারে এবং তা হতে হবে দেশবরেণ্য কোনো ব্যক্তিত্বকে, মানবহিতৈষী কোনো প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু কে এই অপ্সরী চৌধুরী আর কেনোই বা সেখানে এতো ছলাকলা?
আমরা জানি না কে তিনি আর কেই বা বাংলা একাডেমির বাবার বাবা। বাবার বাবা তো দাদা। বাংলা একাডেমির বাবাই বা কে আর দাদাই বা কে কিছুই জানি না। বড়ই হেঁয়ালিপূর্ণ বিষয়টি যেহেতু বিস্তারিত কিছু বলা নেই।
আমরা এর ব্যাখ্যা চাইতে পারি বাংলা একাডেমির কাছে। আশা করি তাঁরা ব্যাখ্যাটি দেবেন। কারণ, এটি জনগণের প্রতিষ্ঠান। এটা কারুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় বা এটাকে ইজারাও দিতে পারেন না কেউ।
এখানে বাংলাভাষী একজন নাগরিক হিসেবে আমার অনুভূতিগুলি তুলে ধরছি। ভুল হতে পারে, সেটা ব্যক্তি হিসেবে আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা।
বাংলা একাডেমির অনেক ভালোকাজের একটি হলো ব্যবহারিক বাংলা অভিধান প্রণয়ন। একাডেমি এ বইয়ে অনেক শব্দ দিয়েছে এমন কি সাঁজোয়াল পর্যন্ত যার অর্থ তহসিলদার কিন্তু ‘কার্যালয়’ শব্দটি দেয় নি (প্রথম সংস্করণ)। সাঁজোয়াল কি কার্যালয়ের চাইতেও বেশি ব্যবহারিক?
সম্ভবত: ২০০০ খ্রিস্টীয় সনে একাডেমির বোর্ডসভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, তাঁরা ভুল ‘একাডেমী’ শব্দটি আর ব্যবহার করবেন না। ব্যবহার করবেন ‘একাডেমি’। কিন্তু সেটি তাঁরা কার্যকর করলেন ২০১৫-তে। বেদনাদায়ক এ আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা।
কষ্ট হলেও আমি বাংলা একাডেমির বই কিনি। হয়তো ভালোবাসা এবং আস্থার কারণে। সেদিন অনেক বইয়ের সাথে কিনেছি ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ বইখানিও। কিন্তু হতাশ হয়েছি। এর সবটুকু তো আলোচনা করা যাবে না এবং সম্ভবও নয়, আর সে বিদ্যেও আমার নেই। তাই মোটাদাগের কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলি।
আলোচ্য বইখানির সম্পাদক শ্রদ্ধেয় জামিল চৌধুরী। সম্পাদনা সহযোগী আছেন ছয়জন। মুখবন্ধে নাম আছে শুধু জামিল চৌধুরীর। তিনি তাঁর মুখবন্ধে অনেক কথা বলেছেন যার সবটা একটি অভিধানের জন্য প্রয়োজনীয় নয়। কিছু বিষয়ের অবতারণা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপ্রয়োজনীয়, ক্ষেত্রবিশেষে অযৌক্তিকও। যেমন, চন্দ্রবিন্দুর অবস্থান ডানদিকে সরিয়ে আনার যুক্তিটি। রেফ-এর ‘র’ আগে উচ্চারিত হয় বলে আগে আনবেন আর চন্দ্রবিন্দু পরে উচ্চারিত হয় বলে পরে নেবেন এটা বালখিল্যসুলভ যুক্তি। যিনি পড়েন তিনি শুধু বর্ণটি দেখেন না, দেখেন এর কার-ফলা প্রভৃতিও এবং জানেন উপরে রেফ থাকলে আগে এবং নিচে র-ফলা থাকলে বর্ণটির পরেই তা উচ্চারিত হবে।
তিনি বলেছেন, “বাংলায় ‘সহ’ শব্দের অর্থ দুটি — ১ সহিত, সমেত (উদাহরণ-সহ)। ২ সহ্য করার ক্ষমতাবিশিষ্ট (ঘাতসহ)। এই অর্থভেদ বোঝানোর জন্য প্রথমোক্ত শব্দটি হাইফেন দিয়ে লেখা হয়েছে এবং অন্যটি হাইফেন ছাড়া লেখা হয়েছে।” এটা কোন্ ধরনের যুক্তি? বাংলায় ‘সহ (সমেত অর্থে)’ শব্দটি ‘সহ (সইতে পারে)’ অপেক্ষা বেশি ব্যবহৃত হয় আর বেশি ব্যবহৃত ক্ষেত্রটিতে হাইফেন চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বরং এর উল্টোটি করলে সেটি যৌক্তিক হতো অর্থাৎ ‘সহ (সমেত অর্থে)’ মূলশব্দের সাথে সেঁটে দিয়ে যেমন – ‘বইসহ এসো (বইসমেত এসো)’ এবং ‘সহ (সইতে পারে অর্থে)’ হাইফেন দিয়ে লিখে যেমন – ‘কাঁচটি তাপ-সহ (কাঁচটি তাপ সইতে পারে)’। নিদেনপক্ষে ‘সহ (সইতে পারে)’ শব্দটিকে ‘সহো’ করতে পারতেন।
সম্পাদক মহোদয় শুধু ‘সহ’-র বেলায় হাইফেন দেন নি, ‘বিভক্তি’-র ক্ষেত্রেও দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতায় তিনি লিখেছেন, “প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জানাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক বন্ধুবর আনিসুজ্জামান-কে। ….. কৃতজ্ঞতা জানাই ….. নিনা শাহীন চৌধুরী-র প্রতি।” কিন্তু তিনি পরের অনুচ্ছেদে লিখেছেন, “….অধ্যাপক নারায়ণচন্দ্র বিশ্বাসকে তাঁদের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানাই।” এখানে কিন্তু হাইফেন নেই। তাহলে কি আনিসুজ্জামান সাহেব পেটের ছেলে আর নারায়ণবাবু পিঠের ছেলে? নাকি কেরানিরা যা লিখে এনেছেন তাতে চোখ বুজে সই করেছেন? আমাদের বিনীত নিবেদন, এই সমস্ত করনিকসুলভ মনোভাব ত্যাগ করলেই ভালো হয়। করনিক ভালো, কিন্তু করনিকসুলভ মনোভাব ভালো না। আমলা ভালো, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক মনোভাব ভালো না।
প্রসঙ্গক্রমে বলি, তৎকালে কিছুটা এ রকম সমস্যায় পড়েছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাগণ। সমস্যাটি ছিল ‘উপর্যুক্ত’ শব্দটি নিয়ে (উপরি+উক্ত=উপর্যুক্ত, যেমন-উপরি+উপরি=উপর্যুপরি)। কারণ তাঁরা বহুল ব্যবহৃত কিন্তু অশুদ্ধ ‘উপরোক্ত’ শব্দটি ব্যবহার করতে চান না। আবার উপর্যুক্ত লিখলে সাধারণ মানুষ ‘উপযুক্ত’ শব্দটির সাথে তালগোল পাকিয়ে ফেলতে পারেন। এজন্য অনেক ভেবেচিন্তে তাঁরা উপরি এবং উক্ত সমাসবদ্ধ করে লিখলেন ‘উপরি-উক্ত’। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, সংবিধানে এর পরে যতোগুলি সংশোধনী এসেছে সব জায়গায় লেখা হয়েছে ‘উপরোক্ত’ এই অশুদ্ধ শব্দটি।
শব্দের শেষে হাইফেন দিয়ে বিভক্তি প্রভৃতি লেখার প্রচলিত কিছু নিয়ম আছে। তা হলো, মূল শব্দটি যদি ভিন্ন ভাষার হয় বা একই ভাষার কিন্তু ভিন্ন গোত্রের হয়, মূল শব্দটি যদি ইনভার্টেড কমার মধ্যে থাকে প্রভৃতি। তেলে-জলে মিলবে না অথচ একটি পদ বানাতে হবে তখন মাঝে একটি হাইফেন বসিয়ে তা করা হয়। যেমন, Karim-এর বই, ২১-কে তিন দিয়ে ভাগ করো, ‘সহ’-র ক্ষেত্রে ইত্যাদি।
অভিধানখানি উচ্চারণজর্জরিত। পাঠ করলে নিজেকে আর বাঙালি মনে হয় না, মনে হয় ভিন্ন ভাষার বিদেশি হিসেবে বাংলা শিখছি, উচ্চারণ শিখছি।
মূলত: বিদেশিদের জন্য আলাদা একটি উচ্চারণ অভিধান দরকার কিন্তু সাধারণ অভিধানকে উচ্চারণজর্জরিত করা সমীচীন নয়। এতে উচ্চারণে প্রণেতাগণের পাণ্ডিত্য প্রকাশ পেলেও সাধারণ পাঠক বিরক্ত হন।
নতুন একটি আবিষ্কারের কথাও জানা যায় অভিধানখানি পাঠ করলে। সেটি হলো ‘সার্বজনীন’ শব্দটির অর্থে। এর একক অর্থ দেয়া হয়েছে ‘সকলের মধ্যে প্রবীণ বা জ্যেষ্ঠ’। জানি না এই অর্থটি কোত্থেকে আবিষ্কৃত হলো।
(অবশ্য অধিকাংশ অভিধানে ‘সর্বজনীন’ এবং ‘সার্বজনীন’ এই শব্দদ্বয়ের যে অর্থ দেয়া আছে তা আমার কাছে কেমন যেনো গোলমেলে এবং প্যাঁচানো মনে হয়। এ জন্য সর্বজনীন মানে ‘একজন বা স্বল্পসংখ্যক মানুষের দ্বারা কৃত কিন্তু সকলের জন্য হিতকর বা ব্যবহার্য বা প্রযোজ্য; যেমন জমিদারের খননকৃত পুষ্করিনী যা সর্বসাধারণের ব্যবহার্য’ এবং সার্বজনীন মানে ‘সবার দ্বারা কৃত বা সবার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত; যেমন সার্বজনীন দুর্গাপূজা’ হতে পারে। অবশ্য এটা সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত মতামত, সাধারণ মানুষ এই অর্থ গ্রহণ নাও করতে পারেন।)
আমার বদভ্যাস হলো গল্প বলা, ভারি বিষয়ের আলোচনা করা নয়। আমি রন্ধনশিল্পী, ডাক্তার নই। উপাদেয় খাবার পরিবেশনই আমার কাজ, রোগীকে ঔষধ গেলানো নয়। তাই আসুন, গল্প শোনাই।
আমার পুত্র প্রথম স্কুলে ভর্তি হলো। কতোই বা বয়েস, তিন-চার বছর। শিশুই বলা চলে। একদিন দেখলাম সে লিখছে, ১৩x২=২৪। আমি বললাম, বাবা ওটা তো ২৬ হবে। সে বললো, না না মিস বলেছে ২৪। পরে স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম, মিস ছাব্বিশই বলেছেন কিন্তু আমার পুত্রধন শুনেছে চব্বিশ এবং সেটাই লিখে এনেছে।
আমার গল্পের মূল প্রতিপাদ্য হলো, ‘না না মিস বলেছে’। দুগ্ধপোষ্য শিশুর কাছে যে রকম মিস, অনেকের কাছেই সে রকম বাংলা একাডেমি, অভ্রান্ত। এ রকম ‘আরেক মিস’ বলেছেন এক রকম আর আমি তার উল্টো বলে ‘অজ্ঞ, গণ্ডমূর্খ’ প্রভৃতি গালিও খেয়েছি সম্প্রতি এক বিদুষীর কাছে। কল্যাণ হোক সে বিদ্যাবতীর॥
সূত্র : টিএস রহমান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)।
প্রয়োজনীয় লিংক : শুদ্ধ বানান শুদ্ধ ভাষা