ড. মোহাম্মদ আমীন
বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে দুটি মত চালু আছে। প্রথম মতÑ রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। অনুমান করা হয়, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সোমবার ১২ই এপ্রিল ৫৯৪ এবং গ্র্যাগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সোমবার ১৪ই এপ্রিল ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল। দ্বিতীয় মত: ভারতের মোগল স¤্রাট আকবরের নির্দেশে ইরান থেকে আগত জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজী হিজরি চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরিত করে, যা বর্তমানে বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ নামে পরিচিত। যেটাই সত্য হোক, পহেলা বৈশাখ রাজার হাতে রাজার মতো করে রাজার ও রাজ্যের কল্যাণের জন্য সূচিত। তাই তার আচরণও রাজার মতো। পহেলা বৈশাখ আসলেই রাজা। আসার এক মাস পূর্ব থেকে প্রকৃতিতে তার আগমন-বার্তা ছড়িয়ে দেয়Ñ আমি আসছি, সাবধান। চারিদিক উথালপাতাল করে দেয় মহোৎসবের সদম্ভ ত্রাসে। রাজা আসে ঢাকঢোল পিঠিয়ে, বৈশাখও আসে তেমনÑ অনেকের অনেক কিছু মাড়িয়ে ঝড়ো গতিতে, ঠিক রাজার মতো নৃশংস লীলায়। কোনো বাধাই প্রতিহত করতে পারে না, হাজার হোক রাজগতি; কী করার আছে সাধারণের! সবকিছু একাকার করে দেয় আপন গতির ত্রাসনাশ আর যাত্রাগিরির ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যে। প্রাচীনকালে রাজার গতিপথও ছিল এমন ভয়ঙ্কর সৃষ্টির উল্লাস আর ধ্বংসের কারুকাজীয় অবিনাশে অবিরাম খেলা।
খরতাপ ও ঝড়ো গতি বাংলা নববর্ষের দুটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শেক্সপিয়রের লেখা ১৮তম সনেটে পহেলা বৈশাখের এই দুটি বৈশিষ্ট্য প্রথম বারের মতো অনবদ্য দ্যোতনায় দ্যোতিত হয়:
“ Shall I compare thee to a summer’s day?
Thou art more lovely and more temperate:
Rough winds do shake the darling buds of May,
And summer’s lease hath all too short a date:
Sometime too hot the eye of heaven shines,
And often is his gold complexion dimm’d;
And every fair from fair sometime declines,
By chance, or nature’s changing course, untrimm’d;—”
বাংলায় পহেলা বৈশাখ নিয়ে কয়টি কবিতা রচিত হয়েছে এবং প্রথম কবিতাই বা কোনটি এ নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। তবে বাংলা সাহিত্যে এমন কোনো কবি নেই, যিনি বৈশাখ নিয়ে কবিতা লিখেননি, কিংবা যাদের কবিতায় বেশাখ আসনি। একটি সাধারণ গবেষণায় জানা যায়, বাংলায় বৈশাখ নিয়ে ছোটো-বড়ো ২৮৭৪টি রচিত কবিতা রচিত হয়েছে। পরোক্ষভাবে পহেলা বৈশাখ এসেছে- এমন কবিতার সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলা কবিতায় নববর্ষ যেভাবে, যত বহুমাত্রিকতায় এসেছে- তা অন্য-কোনো জাতির নববর্ষে আসেনি।
বৈশাখ নিয়ে রচিত প্রথম কবিতা কোনটি সেটি জানা যায় না। কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাব্যে বৈশাখের একটি স্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৫৪০-১৬০০ খ্রি.) বৈশাখকে দাবদাহ আর প্রাকৃতিক বিক্ষুব্ধতার আলেখ্যে তুলে ধরেছেন। এমন রুদ্র প্রকৃতি, বাড়ি বাড়ি মাংস বিক্রেতা ফুলরার জীবনে কী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, কাব্যে তা তুলে ধরা হয়েছে :
“বৈশাখে অনলসম বসন্তের খরা।
তরুতল নাহি মোর করিকে পসরা ॥
পায় পোড়ে খরতর রবির কিরণ।
শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞ্চার বসন ॥
নিযুক্ত করিল বিধি সবার কাপড়।
অভাগী ফুলরা পরে হরিণের দুড় ॥
পদ পোড়ে খরতর রবির কিরণ।
শিরে দিতে নাহি আঁটে অঙ্গের বসন।।
বৈশাখ হৈল আগো মোর বড় বিষ।
মাংস নাহি খায় সর্ব্ব লোকে নিরামিষ।।”
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩ খ্রি) বৈশাখকে দেখেছেন প্রকৃতির মতো বহুমুখী ক্রিয়া আর বৈচিত্র্যিক রূপময়তার উৎস হিসেবে। বৈশাখী প্রকৃতির সঙ্গে তিনি খুঁজে পেয়েছেন মানব মনের মিল এবং সে মিলে দেখেছেন মানুষের প্রাত্যহিক কর্মকা-ের উপর হার্দিক প্রভাব আর চিরন্তন ঋতুচক্রের পারিবর্তনিক বোধের অনুপমতায় সুখ-দুঃখ আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিহ্ববলতা –
“ভূতরূপে সিন্ধুজনে গড়ায়ে পড়িল
বৎসর কালের ঢেউ, ঢেউর গমনে
নিত্যগামী রথ চক্র নীরবে ঘুরিল
আবার আয়ুর পথে হৃদয় কাননে
কত শত আশা লতা শুকায়ে মরিল
হায়রে কব তা কারে, কবিতা কেমনে
কি সাহসে আবার তা রোপিব যতনে
সে বীজ, যে বীজ ভূতে বিভল হইল।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১ খ্রি) যেন বৈশাখের কবি। তাঁর জন্মও বৈশাখ মাসে। হয়তো তাই বৈশাখের প্রতি তাঁর অন্যরকম টান থাকতে পারে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বৈশাখ এসেছে বহুমাত্রিকতার দ্যোতনায়Ñ সুরে ছন্দে, রূদ্রতায়, রুক্ষতা আর জীবনের মতো পারিবর্তনিক অনুভবের চঞ্চল অভিজ্ঞতায়। তিনি বৈশাখে যেমন দেখেছেন ধ্বংস রূপ, তেমনি দেখেছেন নতুন বছরের নতুন প্রত্যাশার উল্লাস। ‘বৈশাখ আবাহন’ কবিতায় তাঁর এই বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার রূপ দেদীপ্যমান :
“এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক – – –
যাক পুরাতন স্মৃতি যাক ভুলে যাওয়া গীতি
অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক।”
‘বৈশাখ আবাহন’ বাংলা সাহিত্যে বৈশাখ নিয়ে লেখা সর্বাধিক গাওয় কবিতা/গান। বৈশাখ নিয়ে সর্বাধিক পরিচিত ও পঠিত ছড়ার রচয়িতাও রবীন্দ্রনাথ; ছড়াটি হচ্ছে :
“আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।”
বৈশাখকে রবীন্দ্রনাথ অবলোকন করেছেন রুদ্ররূপেও। কল্পনা কাব্যের ‘বৈশাখ” কবিতায় রবীন্দ্রনাথের রুদ্র বৈশাখ ভিন্ন মাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে রোচিষ্ণু মোহনীয়তায় :
“ হৈ ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,
ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,
তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল
কারে দাও ডাক-
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ?”
শুধু রুদ্র রূপ নয়, বৈশাখের রুক্ষ রূপও রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়ায়নি। বৈশাখের রুক্ষ রূপ তুলে ধরে তিনি শান্তির প্রার্থনায় আনত হয়েছেন শক্তির কাছে :
“হৈ বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ।
উদার উদাস কণ্ঠ যাক ছুটে দক্ষিণে ও বামে
যাক নদী পার হয়ে, যাক টলি গ্রাম হতে গ্রামে,
পূর্ণ করি মাঠ।”
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রি:)-এর জন্ম রবীন্দ্রনাথের মতো বৈশাখ মাসে নয়, তবু তিনি স্বভাব আর কাব্যভাবে বৈশাখের মতো রুদ্র, প্রকৃতির মতো আশান্ত। তিনি সময়ের মতো বিপ্লবী জয়লেখ আর নতুন সৃষ্টি-নেশায় মগ্ন যোদ্ধার মতো বিদ্রোহীত্বকে বৈশাখে প্রত্যক্ষ করেন। তিনি বৈশাখের তা-বীয় আগমনে ভীত নন, বরং উল্লসিত, মাতোয়ারা আর আনন্দে আত্মহারা। তাই কবিতায় তিনি উদ্বেল হয়ে উঠেন বিদ্রোহের কালঝড় আর সাইক্লোনের প্রাবল্যে :
“ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর
প্রলয় নূতন সৃজন বেদন
আসছে নবীন জীবন ধারা অসুন্দরে করতে ছেদন
তাই যে এমন কেশে-বেশে
মধুর হেসে
ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর ।”
নজরুলের বৈশাখ বিপ্লবীর অস্ত্র যেন। বজ্রের মতো গর্জে ওঠে সে অস্ত্র। তাঁর সন্ধ্যা কাব্যের ‘কাল বৈশাখী’ কবিতায় স্বভাবসিদ্ধ অগ্নিঝরা কণ্ঠে তাই দেখতে পাই :
“বারেবারে যথা কাল-বৈশাখী ব্যর্থ হল রে পুব-হাওয়ায়
দধীচি-হাড়ের বজ্র-বহ্নি বারেবারে যথা নিভিয়া যায়,
কে পাগল সেথা যাস হাঁকি
বেশাখী কাল-বৈশাখী!”
কবির আক্ষেপ, বৈশাখ তার প্রকৃত রুদ্ররূপ ধরে আবির্ভূত হয়নি। তাই এখনও বিদেশি শত্রু আমাদের ঘাড়ে বসে আসে। বৈশাখকে তাঁর আহ্বান; এসে যেন শেষ করে দেয় শত্রুদের চিহ্ন :
“কাল- বৈশাখী আসেনি হেথায়, আসিলে মোদের তরু-শিরে
সিন্ধু-শকুন বসিত না আসি’ ভিড় করে আজ নদীতীরে।
জানি না কবে সে আসিবে ঝড়
ধূলায় লুটাবে শত্রুগড়।”
রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের পর বাংলা ভাষায় বাংলা নববর্ষকে নিয়ে দীর্ঘতম কবিতা লেখিয়েদের মধ্যে অন্যতমÑ কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৯-১৯৭৪ খ্রি.)। তিনি ‘বৈশাখ’ ও ‘বৈশাখের কালো ঘোড়া’ নামে যে-দুটি কবিতা রচনা করেছেন তা বৈশাখের কবিতায় ভিন্ন মাত্রা দান করেছে। বৈশাখ তার কাছে মহাশক্তির প্রতীক, যা কল্যাণ সাধনের জন্যেই আবির্ভূত হয় :
“ধ্বংসের নকীব তুমি হে দূর্বার, দুধর্ষ বৈশাখ
সময়ের বালুচরে তোমার কঠোর কণ্ঠে
শুনি আজ অকুণ্ঠিত প্রলয়ের ডাক।”
ফররুখ তার ‘বৈশাখের কালো ঘোড়া’ কবিতায় বৈশাখকে বিমূর্ত করেছেন মহাশক্তিধররূপে। এখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে রবীন্দ্রনাথের ঢঙে বৈশাখকে জীর্ণতার বিরুদ্ধে লড়ার আহ্বান করেছেন :
“বৈশাখের কালো ঘোড়া উঠে এলো। বন্দর, শহর
পার হয়ে সেই ঘোড়া যাবে দূর কোকাফ মুলুকে,
অথবা চলার তালে ছুটে যাবে কেবলি সম্মুখে
প্রচ- আঘাতে পায়ে পিষে যাবে অরণ্য, প্রান্তর।”
ফররুখ আহমদের কাছে বৈশাখ শুধু মাস নয়, শুধু নবর্ষের সূচনা নয়; একই সঙ্গে বিপ্লবের মমতা, নির্ভীকতার পাঠ, আপোষহীনতার মন্ত্র। তার এ দৃঢ়দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায় ‘বৈশাখ’ কবিতায় :
“সংগ্রামী তোমার সত্তা অদম্য, অনমনীয় বজ্র দৃঢ় প্রত্যয় তোমার
তীব্র সংঘর্ষের মুখে বিশাল সৃষ্টিকে ভেঙে অনায়াসে কর একাকার
সম্পূর্ণ আপোষহীত, মধ্যপথে কোন দিন থামেনা তো জানে না বিরতি
তোমার অস্তিত্ব আনে ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে অবিচ্ছিন্ন অব্যাহত গতি
প্রচন্ড সে গতিবেগ ভাঙে বস্তি, বালাখানা, ভেঙে পড়ে জামশিদের জাক
লাভ-ক্ষতি সংজ্ঞাহীন, নিঃশঙ্ক, নিঃসঙ্গ তুমি
হে দুর্বার, দুর্জয় বৈশাখ।”
জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪ খ্রি) প্রকৃতির সঙ্গে মানুষ আর ইতিহাসকে বিলীন করে দিয়ে চিরজীবী করে রেখেছেন। তাঁর কবিতায় হৃদয়ানুভূতি যেমন অবিনাশী তেমনি বিস্তৃত, প্রাণগতিক ও মোহনীয়। বৈশাখকে তিনি দেখেছেন শুভ্রতার প্রতীক, মেঘের ভেলা আর সাদা কড়ির মিলন। ‘ঘুমিয়ে পড়ব আমি’ কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে প্রাকৃতিক অনাবিলতায় :
“ঘুমিয়ে পড়ব আমি একদিন
তোমাদের নক্ষত্রের রাতে
শিয়রে বৈশাখ মেঘ সাদা
যেন কড়ি শঙ্খের পাহাড়।”
আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫ খ্রি:)-এর কাছে বৈশাখ কল্যাণের দূত। তার বৈশাখ উষার লালিত্যে ভরপুর নিঃসন্ধিগ্ধ মুগ্ধতাÑ মৃদণাভি দুলনায় যে নিজেই নিজেকে মুগ্ধ করে রাখে সমৃদ্ধ মৃণ্ময়তায়। বৈশাখ তাঁকে অনেক দেয়, কিন্তু তিনি কী দিতে পারেন, কী দিতে পারেন কেবল কয়েক পঙ্ক্তি কবিতা ছাড়া? কবির এ আকুতি ফুটে উঠেছে ‘হে বৈশাখ’ কবিতায় :
“মৃগনাভি-দুলনায় নিজেকেই নিজে মুগ্ধ করে রেখেছ
ঊষার লালিত্যে
আর মধ্য দিনের আগমনে তুমি অকৃত্রিম
তোমাকে আমি কী দিতে পারি
কী দেব বলো হে বৈশাখ।”
কবি সুকান্ত ভট্টচার্য (১৯২৬-১৯৪৭ খ্রি:) কবিতায়, লেখায়, চিন্তায় আর চেতনায় মানুষ ও প্রকৃতির মিল খুঁজে বেড়িয়েছেন। প্রকৃতির সঙ্গে মানব মনের সম্পর্ক যেমন নিবিড় তেমন গভীর, প্রকৃতি সহজে মানুষের মনকে দোলয়িত করতে পারে, কিন্তু মানুষের মন প্রকৃতিকে দোলায়িত করতে পারে না। তাই প্রকৃতি মানুষের জীবন অত্যন্ত গুরুত্ববহ। তার বৈশাখ শুধু ধ্বংসের নয়, নতুনরূপে জেগে উঠার প্রেরণাদীপ্ত উজ্জীবক। এটিই ধ্বনিত হয়েছে তাঁর বৈশাখের নির্ঝর রূপমালার লাবণ্যিক অনুপমতায় :
“এসো এসো এসো হে নবীন এসো এসো হে বৈশাখ
এসো আলো এসো হে প্রাণ ডাক কালবৈশাখীর ডাক
বাতাসে আলো ঝড়ের সুর
যুক্ত করো নিকট দূর
যুক্ত করো শতাব্দীতে দিনের প্রতিদানে। ”
কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬ খ্রি.)-এর বৈশাখ দারিদ্রের বিমূর্ত রূপ। তিনি নাগরিক কবি, নগরে তিনি দেখেছেন, বৈশাখের আঘাতে কীভাবে ভেঙে পড়ে বস্তির ছোটো ছোটো ঝুপড়ি, কীভাবে বন্ধ হয়ে যায় রাস্তাঘাট, শ্রমজীবী মানুষের আয়ের পথ এবং এ সুযোগে কীভাবে অভাব, অনটন আর যন্ত্রণায় ঘিরে ধরে সাধারণ মানুষকে। বৈশাখে তিনি দেখতে পান মানুষের অসহায়ত্ব :
“রাত্রি ফুরালে জ্বলে ওঠে দিন
বাঘের থাবায় মরছে হরিণ
কাল বোশেখের তান্ডবে কাঁপে পড়ো পড়ো চাল
শূন্য ভাঁড়ারে বাড়ন্ত চাল ইচ্ছে তার ইচ্ছে ।”
কবি গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪ খ্রি.) কাছে বাংলা নববর্ষের আগমনী মাস বৈশাখ একটি অবিরাম আশীর্বাদ। তাঁর বৈশাখ ঝিমিয়ে পড়া মানুষকে নতুনভাবে উদ্দীপ্ত কলে, প্রলয়মূর্তির বাধাহীন বাসনায় প্রবল আবেগে জেগে তোলে আগামীর স্বপ্নে। নববর্ষ বা নওরোজ তার তেজদীপ্ত ঘোড়ার ধ্বস্ত তিমির দৌড়। ‘‘নববর্ষের আশির্বাদ’’ কবিতায় তার সমর্পিত কথমালা ধ্বনিত হয়েছে এভাবেই :
“ওই এলোরে ওই এলো
নতুন বর্ষ ওই এলো
তরুণ তপন উঠলোরে
ধ্বস্ত তিমির ছুটলোরে
নওরোজের এই উৎসবে।”
ওঠ জেগে আজ ওঠ সবে।’’
আল মাহমুদ ‘‘বোশেখ মাসে এ কোন খরা’’ কবিতায় বৈশাখকে শান্তির পরশ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। ছোটো চার লাইনের কবিতায় তিনি বৈশাখকে পরিবেশন করেছেন সুখের আকড় হিসেবে :
“ঋতুর রাজা বোশেখ এসো,
খোলো স্রোতের মুখ
তৃষ্ণাকাতর হাজার বুকে
লাগুক পানির সুখ।”
সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬) নতুনকে জানার প্রয়াসে নিবেদিত থেকেছেন সবসময়। বৈশাখের প্রতিটি নড়চড়া, প্রতিমুহূর্তের আলোড়ন তাঁর হৃদয়ে দিয়েছে বিস্ময়ের তাড়না। ‘বৈশাখ’ কবিতায় তিনি দেখেছেন নতুন ধরা উন্মোচিত হচ্ছে নতুনভাবে নতুন প্রত্যাশার অভিনব কলহাস্যে :
‘‘আমি কে
আমি পারিনে চিনতে আজ
কি অবাক কি অবাক
পুরোনো আমাকে নতুন নতুনে
সাজিয়েছে বৈশাখ
দুচোখ আমার নতুন নীলিমা
নতুন পৃথিবী ডাকে
দেখি বার বার উৎসব দিনে
বাংলায় বাংলা।’’
কবি হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩) অনুভবে প্রকৃতির মতো চঞ্চল আর প্রকৃতির উপাদানসমূহের মতো বর্ণীল আবেগে সবাক। বৈশাখ তার কাছে আবেগের অনুভূতির আর অনন্ত প্রকৃতির অবিশ্রান্ত প্রকাশ। তাঁর কবিতায় বৈশাখ আপ্লুত প্রকৃতির চঞ্চল ঝরণার মতো নিমগ্ন অনুভূতি যেন :
‘‘এসো বৈশাখ, আবেগস্নিগ্ধ অভিষেকে
নিজকে তুমি স্থাপন করো
ভালোবাসায় আপ্লুত হও আরো—।’’
নির্মলেন্দু গুণ বৈশাখ নিয়ে লিখেছেন অ্যালেগরি কবিতা- ‘খাজাঞ্চিবাবুর নববর্ষ’। এই কবিতায় তিনি নৈরাশ্যকে চিত্রায়িত করছেন। বাংলাদেশ অর্র্জিত হয়েছে, কিন্তু কী পেয়েছেন সে হিসেবে মেলাতে তিনি রাজি নন। মহাজন ও খাজাঞ্চিবাবু রূপকের মাধ্যমে কবি দ্ব্যর্থ ভাষায় প্রকাশ করেছেন, খাজাঞ্চিবাবু অর্থাৎ রাজনীতিবিদগণ ব্যর্থ হয়েছেন। মহাজন, তথা জনতার আদালতে তারা ধরা পড়ে গেছেন।
পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মেতে উঠেন প্রকৃতির মতো ভেদাভেদহীন বৈশাখী মুখরতার সুনেহ সখ্যে। শহুরে বৈশাখের ইলিশ-সংস্কৃতি নিয়ে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করেন; আমি শহুরেদের ইলিশেও বৈশাখের উচ্ছ্বাস দেখি, দেখি আবেশিত প্রফুল্লতার হার্দিক কুমুদ।মূলত উৎসবের বহুমাত্রিক বিন্যাসই সর্বজনীনতা, পহেলা বৈশাখে এটিই দেখা যায়। শহরের ইটপাথরের মাঝে এক টুকরো ইলিশ যদি নগরবাসীর পান্তাভাতের লবণে স্বাদ-আঙুলের ঝড়ো ছোঁয়ায় নড়ে উঠে তাতে ক্ষতি কী! আমি উদার কণ্ঠে বলি
পান্তা ভাতের পানি আর পদ্মা নদীর ইলিশ
কাঁটাগুলো সরিয়ে দাও হে চৌদ্দশ ছাব্বিশ
এটাই আমার প্রার্থনা গো লবণ মাখা হাতে
প্রতিবছর এসো তুমি ভর্তা-বাজির সাথে
মাটির থালায় শুকনো মরিচ হলেই চলে বেশ
তাতেই হেসে গড়াগড়ি সোনার বাংলাদেশ।