ড. মোহাম্মদ আমীন
যে-লোক ইংরেজিতে একটা শুদ্ধ বাক্যও উচ্চারণ করতে পারে না, সেও বলে, বাংলার মতো কঠিন এবং ইংরেজির মতো সহজ ও বোধগম্য ভাষা আর নেই। গতকাল একজন কথা প্রসঙ্গে বলল, “বাংলা খুব কঠিন ভাষা। ইংরেজি অনেক সহজ, অনেক কাছের মনে হয় ।” বাংলা যদি এত কঠিন হয় তো, আপনি বাংলা বলেন কেন?
যারা ইংরেজি জানে না, তারাই বলে- বাংলা কঠিন ভাষা। মাতৃভাষা মায়ের মতো; যার মা নেই, তার জন্মও নেই। যার মাতৃভাষা নেই, তার শিক্ষা সূচিত হবে কীভাবে? বাংলা ভাষায় যতটি বর্ণ ততটি অক্ষর, কিন্তু ইংরেজিতে অক্ষরের সংখ্যা বর্ণের প্রায় দ্বিগুণ। এমন ভাষা কীভাবে বাংলার চেয়ে মধুর হয়, সহজ হয়?
বার্ট্রান্ড রাসেল-সহ আরও অনেক ইংরেজ ভাষাবিদের মন্তব্য, “ English is an abnormal language”. তবু, মাতৃভাষা হিসেবে ইংরেজিই তাদের প্রিয় ভাষা।
প্রতিবন্ধী হলেও নিজের মা-ই শ্রেষ্ঠ। বিজাতীয় ভাষা কীভারে মাতৃভাষার চেয়ে সহজ, বোধগম্য ও কাছের হয়? কুলাঙ্গার না-হলে মায়ের বর্তমানে নিজের মায়ের চেয়ে অন্যের মা কীভাবে কাছের হয়? নিজের মাকে সবাই চেনে, কিন্তু সবাই ভালোবাসে না; অনেকে ধনী প্রেমিকার স্মার্ট মায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ঐতিহ্যহীন জাতির বিবেকহীন সন্তানগণ মাতৃভাষারূপী মায়ের সঙ্গে এমন আচরণ করে। আমি বিদেশি ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি না, কিন্তু আগে মাতৃভাষা। সন্তান নিজের মাকে যেমন সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, তেমনি প্রত্যেকের উচিত মাতৃভাষাকে অন্য ভাষার চেয়ে বেশি ভালোবাসা।
মন্তব্যের জবাব :
একজন মন্তব্য করেছেন- “মাতৃভাষা নিশ্চয়ই বেশী কাছের। এখানে ভালবাসার প্রশ্ন তোলারই অবকাশ নেই। তবে একথা ঠিক যে বাংলা আসলেই অনেক কঠিন ভাষা। ইংরেজি শেখা নিঃসন্দেহে বাংলার চাইতে সহজতর। (যেখানে দুটো ভাষাই কোন লার্নারের কাছে সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ।)”
আমিও তা-ই বলছি। অনেক লোক দেখেছি, যার বলে, মা খুব কাছের, এখানে ভালোবাসার অবকাশ নেই। আসলে তারা মাকে বিরক্ত মনে করে, কারণ মা যে রুগ্ণ-দীন। অনেক লোক দেখেছি– যারা নিজের রুগ্ণ-পাতলা মাকে বোঝা মনে করে ছুঁড়ে দিয়ে সুন্দরী প্রেমিকার ধনী-চর্বিপেটা-মুটকি মাকে খুব হালকা মনে করে মাথায় বয়ে বেড়ায়। এদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অভিন্ন– যারা নিজের ভাষাকে কঠিন মনে করে, বোঝা মনে করে; অথচ বিদেশি ভাষাকে মনে করে সহজ। আমার কথা হচ্ছে, আমি আমার জননীকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসব, রুগ্ণ হলেও, অসুস্থ হলেও, মুখ দিয়ে গন্ধ বের হলেও; তারপর যাব ধনী শাশুড়ির কাছে। যারা মাতৃভাষাকে কঠিন বলে তাদের উদ্দেশে কবি আবদুল হাকিম বলেছেন–
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
একজন লিখেছেন, “কঠিন লাগার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক কী?”
আমার উত্তর, এটি ঠিক বিরক্তির সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কের মতো। কঠিন-সহজের মধ্যেই ঘৃণা-ভালোবাসার সব সম্পর্ক নিহিত।যার কাছে দেশপ্রেমবোধ নেই তার কাছ দেশ ভালো লাগে না। তবে এর মানে এ নয় যে, আমি বিদেশ যাব না, বিদেশে চাকুরি করব না। এর মানে হচ্ছে– যে দেশেই যাই, দেশপ্রেম থাকলে স্বদেশের প্রতিই আমার টান থাকবে সবচেয়ে বেশি। যার মাতৃত্ববোধ নেই সেই কেবল নিজের ভাষাকে কঠিন এবং মাকে অচেনা বলতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন কথা। আমার সহপাঠিী হেকমত ছিল খুব ঘুমকাতুরে। শীতের ভোরে ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হতো, এগারোটার আগে ক্লাস করতে পারত না। প্রতিদিন প্রথম ক্লাস বাদ যেত। কিন্তু রাহেলার সঙ্গে প্রেমে পড়ার পর দেখলাম সবার আগে ঘুম হতে উঠে গোসলে ছুটছে।
বলতাম, কী ব্যাপার, এখন শীতের ভোরে উঠতে কষ্ট হয় না?
“না” হেকমতের পরিষ্কার জবাব, “রাহেলার ভালোবাসা আমার শীতের ভোরকে উষ্ণ মমতায় ভরিয়ে দিয়েছে। এখন আমি অপেক্ষায় থাকি রাহেলা আহ্বান কত ভোরে আসে।”
আর একজন এক বিদঘুটে মন্তব্য করেছেন, “একজন চায়নিজ, জাপানি, রাশান, পর্তুগীজ(পর্তুগিজ), ডাচ যত সহজে ইংরেজি আয়ত্ত করতে পারে, আমার মনে হয় বাংলা শিখতে গেলে অত সহজে তা আয়ত্ত করতে পারবে না।”
এমন অযৌক্তিক কথা অন্য কোনো ভাষাভাষীর কলমে আসবে না। অবাক হলাম, একজন বাঙালির কলমে কীভাবে এমন কথা আসে? মনে পড়ে গেল, জিন্নাহ আর নাজিমুদ্দিনের কথা। আমার জাপানি বন্ধু নাওমি ওয়াতানাবে বলেছেন- ইংরেজির চেয়ে বাংলা শেখা, বলা ও হৃদয়ঙ্গম করা সহজ। তিনি বাংলায় বেশ কয়েকটা বইও লিখে ফেলেছেন। অথচ, আপনি বাঙালি হয়ে জপানি, রাশান, পর্তুগিজ ডাচ হয়ে গেলেন, বাঙালি হতে পারলেন না। আগ্রহ, ভালোবাসা, আন্তরিকতা আর হার্দিকতা পেলে যে-কোনো শেখা বা কাজ মধুর হয়ে যায়। আগ্রহ যেখানে প্রবল, শ্রম সেখানে আনন্দ, কঠোর সাধনাও সেখানে মায়ের কোলের মতো বিভোর প্রশান্তিতে ভরে উঠে। টাকার জন্যই আমরা ইংরেজি ভাষার প্রতি এত আকৃষ্ট হই, প্রভুর ভাষার প্রতি প্রলুব্ধ হই- হোন, তবে নিজ ভাষাকে অবহেলা করে কেন? বাংলায় আর্থিক নিরাপত্তা ইংরেজির চেয়ে কম, তাই মাতৃভাষা হলেও আমরা অনেকে বাংলাকে অবহেলা করি। যেসব বিদেশে বাংলা শিখেন, তারা বাংলাকে ভালোবেসেই শিখেন, তাই তাদের কাছে বাংলা আপনার মতো কষ্টসাধ্য বিষয় নয়, যেমন সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য আমাদের অনেকের কাছে ইংরেজির মতো কঠিন ভাষা শেখাও সহজ হয়ে যায়। ।
আবেগের কথা বলছেন? মায়ের প্রতি আবেগ থাকবেই। আমার মাতৃভাষা আমার আবেগের সবচেয়ে বড়ো শ্রদ্ধার। মাতৃভাষার প্রতি যার আবেগ নেই, মায়ের প্রতি যার আবেগ নেই, তার মনুষ্যত্ববোধ থাকবে কীভাবে? আবেগের মধ্যে মনুষ্যত্ব বিরাজ করে। অনেকেই আছে, নিজের মাকে তাড়িয়ে ধনী প্রেমিকার আধুনিক মাকে জড়িয়ে ধরে– কুলাঙ্গার না-হলে এমন আচরণ কেউ করতে পারে না।
লিয়াকত আলী চৌধুরী লিখেছেন, নিজের ভাষার ব্যাপার আমি আবেগ পছন্দ করবো বর্তমান বিশ্ববাজার ব্যবস্হায়। নোয়াম চমোস্কি ঠিকই ধরছেন,সবভাষার একটি সর্বজনীন নিয়ম আছে। আর আমাদের মস্তিষ্ক :”language ready brain”। আমি বুঝি না কেন বলা হয় অন্য ভাষার তুলনায় বাংলা কঠিন । বলা যেতে পারে, কিছু ব্যাপারে আমাদের ভাষা ইংরেজির মতো সরলীকরণ করেনি; গভীরে ঢুকেছে। এটা ভালো লক্ষণ বলে মনে করি। এটা ঠিক, আমাদের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি হওয়া থাকা উচিত ।
বাবুল মুখার্জী মন্তব্য করেছেন, একজন ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে এটুকু অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি যে, ভালো বাংলা না জানলে ভালো ইংরাজি জ্ঞান লাভ হয় না। আর ভালো ইংরাজি শিক্ষার জন্য যে ইংরাজি মাধ্যম স্কুলেই পড়তে হবে তেমন যুক্তিগ্রাহ্য হেতু নেই।
রেবেকা চৌধুরীর মন্তব্য দিয়ে শেষ করি,
“মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা !
মাগো তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা…।
লেখাটি ভালো লেগেছে ।