কেবলমাত্র শুদ্ধ না অশুদ্ধ
ড. মোহাম্মদ আমীন
সংস্কৃত ‘কেবল’ শব্দের অর্থ অব্যয়ে একমাত্র (কেবল তিনিই দেখেছেন), শুধু (কেবল তু্মিই আমাকে বুঝতে পার), অবিরাম, নিরন্তর (কেবল বৃষ্টি), নিরবচ্ছিন্ন, অমিশ্র (কেবল সুখ) এবং ক্রিয়াবিশেষণে এইমাত্র (কেবল এলাম), অনবরত ( কেবল অভাব আর অভাব) ইত্যাদি। সংস্কৃত ‘মাত্র’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে পরিমাণ, মোট, সাকল্য (মাত্র পাঁচ টাকা); বিশেষণে— পরিমিত, নির্দিষ্ট (মাত্র এক ঘণ্টার পথ), কেবল, শুধু (মাত্র এক তিনটি); ক্রিয়াবিশেষণে সেইক্ষণে, সঙ্গে সঙ্গে ( দেখামাত্র নিয়ে এসো) এবং অব্যয়ে প্রত্যেক (জীবমাত্রই মরণশীল)।
‘কেবল’ ও ‘মাত্র’ শব্দদ্বয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রায় সমার্থক বলে অনেকে মনে করেন— ‘কেবলমাত্র’ শব্দটি বাহুল্য। আমিও তাই মনে করতাম। শিক্ষকবৃন্দ আমাকে ওভাবে শিখিয়েছেন। এখন দেখি — ‘কেবলমাত্র’ শব্দ বাহুল্য বা অসিদ্ধ হলে বাংলার আরও অনেক শব্দ বাহুল্য বা অশুদ্ধ হয়ে যাবে। ‘কেবলমাত্র’
শব্দটি বাহুল্য বা অসিদ্ধ করতে গিয়ে শত শত শব্দকে বাহু্ল্য করার ঝুঁকি বৈয়াকরণগণ কী নিতে পারবেন? মনে হয় না পারবেন এবং এমন ঝুঁকি নেওয়ারই বা কি দরকার? বহুলপ্রচলিত এই শব্দটির প্রতি এত ক্ষোভ না- দেখালে কী হয়?

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “এ আদেশ জারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধা-সরকারি অফিসসমূহে কেবলমাত্র বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে।” [রাষ্ট্রপতির সচিবালয়, গণভবন, ঢাকা; পত্র সংখ্যা :৩০/১২/৭৫; সাধারণ -৭২৯/১(৪০০) তারিখ :১২ই মার্চ, ১৯৭৫ ইং।] বঙ্গবন্ধুর এই একটি বাক্যে কয়টি সমার্থক শব্দদ্বিত্ব রয়েছে দেখুন।
‘কেবলমাত্র’ যদি বাহুল্য হয় তাহলে, বইপুস্তক, বসবাস, দাবিদাওয়া, জলপানি, অশ্রুজল প্রভৃতি শব্দ বাহুল্য বা অসিদ্ধ হবে না কেন? অথচ, এসব শব্দ আমরা হরহামেশা লিখে যাচ্ছি কাগজপত্রে। কথাবার্ত আর চিঠিপত্রের কথা নাই বা বললাম। ‘অশ্রুজল’ তো বাংলা একাডেমির অভিধানে প্রমিত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ‘জামবাটি’ বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। অথচ জাম শব্দের অর্থ বাটি। তাহলে ‘জামবাটি’ কেন অসিদ্ধ হবে না? পাউ বা পাঁউ শব্দের অর্থ রুটি, তো পাউরুটি বলি কেন? এটাও তো অশুদ্ধ!
এই প্রসঙ্গে শুবাচি ম্যানুয়েল ত্রিপুরার বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি শুবাচ গোষ্ঠীতে একটি মন্তব্যে লিখেছেন, “কিছুকিছু শব্দ ব্যাকরণবিধি তোয়াক্কা না করে বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে ভাষার শ্রী ও শ্রুতিমাধুর্য বাড়িয়ে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। যেমন- কামকাজ, হাবাগবা, মানইজ্জত, থালাবাসন, কচিকাঁচা, সরলসোজা, হাঁড়িপাতিল বা হান্ডিপাতিল ইত্যাদি। আবার কেউ কেউ একই শব্দকে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে বলেও থাকেন। যেমন- ভাইব্রদার, ফলফ্রুট, ওকে-ঠিক আছে, বাট কিন্তু ইত্যাদি। ওইসব শব্দব্যবহার বিবেচনায় ‘কেবলমাত্র’ বা ‘শুধুমাত্র’ শব্দকে কোনক্রমেই ভুল বলে আখ্যায়িত করা মোটেও সমীচীন নয়।
কেবলমাত্র শব্দটি কত নির্দেষ এবং স্নিগ্ধ তা নিচের অনুচ্ছেদটি পড়লে অনুধাবন করা যাবে।
পাড়াপড়শি, পত্রপত্রিকা আর কাগজপত্র নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিয়েছে। খবরাখবর ভালো নয়। লোকজন বলাকওয়া শুরু করে দিয়েছে- এমন কিছু দিন চললে কামকাজ, মানইজ্জত কিছুই থাকবে না। আমার থালাবাটির সঙ্গে জামাটিও বেচাবিক্রি করে দিতে হয়েছে। ইদানীং শরীর-স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না। খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক হচ্ছে না। মাথামুন্ডু কিছু বুঝছি না, জ্ঞানগরিমা শেষ। সর্দার-মাতবর এসে বাসাবাড়ির খানাখন্দ, গাছগাছালি, পাখপাখালি কেটেকুটে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছে। ভয়ডরে আর ডরেভয়ে শহরনগর কঁপাছে। ডেঙ্গু মশায় ভরে গেছে ঘরবাড়ি, বাড়িঘর আর ঝোপজঙ্গল।
ডাক্তারবৈদ্য হাওয়া। ধারদেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে। এখন কী কী করারআছে? চিন্তাভাবনা করেও কুলকিনারা পাচ্ছি না। টাকাকড়ি ও সহায়সম্বল শেষ। ধারাদেনা করে একটি গাড়ি কিনেছিলাম। দরদাম ভালোই ছিল। তাও কোর্টকাচারিতে আটকে আছে। বিয়েশাদি করতে পারব কি না জানি না। গরিবগুরবা মানুষ। জমাজমি যা ছিল ঝগড়াবিবাদ আর মারামারি করে শেষ। বাদবাকি কথা পরে হবে। অশ্রুজলে ভেসে যাচ্ছে মুখ।

‘কেবলমাত্র’ শব্দটি কেবল ‘কেবল’ ও ‘মাত্র’ দুটি অভিন্ন অর্থ-দ্যোতক শব্দ দিয়ে গঠিত একটি দ্বিত্ব শব্দ, তাই শব্দটিকে এরূপ অন্যান্য সঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা না করে সরাসরি বাহুল্য বলা সমীচীন নয়। এটি একটি নতুন শব্দ এবং সর্বপ্রথম, অশ্রুজল, বাসাবাড়ি প্রভৃতির মতো নতুন অর্থদ্যোতক শব্দ। ‘কেবলমাত্র’ একটি শব্দদ্বিত্ব বা দ্বৈতশব্দ বা দ্বিরুক্তি। সুতরাং এটি ভুল বা অসিদ্ধ কিংবা বাহুল্য নয়। বিশেষ অর্থ প্রকাশের জন্য যেসব শব্দ দুইবার ব্যবহৃত হয় তাদের মধ্যে ‘কেবলমাত্র’ অন্যতম একটি বিশেষ অর্থজ্ঞাপক।