বাংলা ব্যাকরণ সমগ্র : অনুবাদ
ড. মোহাম্মদ আমীন
অনুবাদ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Translation। এর বাংলা অর্থ তরজমা, ভাষান্তর, পুনঃ পুনঃ কথন, অপবাদ প্রভৃতি। তবে আমরা এখানে অনুবাদ বলতে তরজমা এবং ভাষান্তরকে বুঝাবে। কোনো বক্তব্য বা রচনাকে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় রূপান্তরিত করাকে অনুবাদ বলা হয়।। তাই অনুবাদ হলো মূলত রূপান্তর বা পুনর্বিবৃতি। যেকোনো রচনায় বক্তব্যের বিষয়কে পরিবর্তন না করে ভাষাগত পরিবর্তন করকে বলা হয় অনুবাদ। তবে এটি আসলে সম্ভব নয়। কারণ এক ভাষার শব্দ ও প্রকাশ অনুভূতির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য থাকে। যা অনুবাদের সময় কিছুটা হলেও ভিন্নতা এনে দেয়। ইংরেজিতে you শব্দের অর্থ তুমি। সুতরাং ইউ আর মাই শিক্ষক বলতে ‘তুমি আমার শিক্ষক’ বললে যথার্থ হবে না। অনুবাদ করতে হবে : আপনি আমার শিক্ষক।
অনুবাদের সংজ্ঞার্থ : ‘অনু’ ও ‘বাদ’ শব্দের সমন্বয়ে ‘অনুবাদ’ শব্দগঠিত। ‘অনু’ অর্থ অনুরূপ এবং ‘বাদ’ অর্থ বক্তব্য। অতএব ‘অনুবাদ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ অনুরূপ বক্তব্য, অর্থাৎ যেটি অনুবাাদ করা হচ্ছে সেটির অনুরূপ ভাবের বা বাদ-এর প্রতিফলন ঘটানোই হচ্ছে অনুবাদ। সে হিসাবে, কোনো বক্তব্য বা রচনাকে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় রূপান্তরিত করাকে অনুবাদ বলা হয়।। তাই অনুবাদ হলো মূলত রূপান্তর বা পুনর্বিবৃতি। যেকোনো রচনায় বক্তব্যের বিষয়কে পরিবর্তন না করে ভাষাগত পরিবর্তন করাই হচ্ছে অনুবাদ।
অনুবাদের শ্রেণিবিভাগ :
অনুবাদের প্রকৃতি ও ভাষান্তরের লক্ষ্য অনুযায়ী অনুবাদ প্রধানত দুই প্রকার। যথা :
(১) আক্ষরিক অনুবাদ ও
(২) ভাবানুবাদ।
(১) আক্ষরিক অনুবাদ (Literal Translation) : মূল ভাষার প্রতিটি শব্দের প্রতিশব্দ ব্যবহার করে যে অনুবাদ করা হয় তাকে আক্ষরিক অনুবাদ বলে। আক্ষরিক অনুবাদের ক্ষেত্রে মূল ভাষায় যেমন আছে ঠিক তেমন করেই অনুবাদ করা হয়। এক্ষেত্রে মূল ভাসার বাক্যশৈলী, বাণী, ভঙ্গি, সুর ইত্রাদি হুবুহু অনুবাদ করা হয়। যেমন ও যধাব ধ পধৎ বাক্যটিকে যদি এভাবে অনুবাদ করা হয় যে, ‘আমার আছে একটি গাড়ি’ তাহলে একে আক্ষরিক অনুবাদ বলা যেতে পারে। আক্ষরিক অনুবাদ করার সময় ভাবার্থের প্রতি দৃষ্টি আরোপ করা হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সবসময়ই আক্ষরিক অনুবাদ করা হয়। যেমন আইন ও দলিল সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে আক্ষরিক অনুবাদই করা হয়। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পসাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ের ক্ষেত্রে আক্ষরিক অনুবাদ সফলতা বয়ে আনে না। তাই এসব বিষয়ে ভাবানুবাদই করা হয়।
(২) ভাবানুবাদ (Faithful Rendering transcreation) : মূল ভাষার অর্থ ঠিক রেখে স্বাধীনভাবে অনুবাদ করাকে বলা হয় ভাবানুবাদ। এ ধরনের অনুবাদের ক্ষেত্রে মূল ভাষার ভাব ঠিক রেখে অপর ভাষার প্রয়োজনীয় শব্দ ব্যবহার করে অনুবাদ করা হয়ে থাকে। ভাবানুবাদ করার সময় মূল ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ, বাক্যগঠন ইত্যাদিকে উপেক্ষা করে অপর ভাষায় (নিজের ভাষায়) মূলভাবকে তুলে ধরা হয়। তবে অনেক সময় ভাবানুবাদে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় বলে মূল বিষয় থেকে দূরে সরে যেতে হয়। তাই ভাষা ও ভাবের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেই ভাবানুবাদ করতে হয়। আক্ষরিক অনুবাদে রসবোধ থাকে না বলে সাহিত্যের অনুবাদ সাধারণত ভাবানুবাদ হয়। যেমন: ‘Many men many mind’- এই বাক্যের অর্থ যদি করা হয় তো তা হবে -‘নানা মুনির নানা মত’ এভাবে তবে তাকে ভাবানুবাদ বলা যেতে পারে। অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাবানুবাদই শ্রেষ্ঠ বলে সর্বজনস্বীকৃত। ভাবানুবাদে শব্দ নয়, ভাবার্থের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। মূল রচনার প্রতিটি শব্দকে ভাবানুবাদে অনুবাদ করা হয় না। ভাবানুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুবাদক যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করেন। সৃজনশীল যেকোনো রচান অনুবাদে ভাবানুবাদই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এতে রচনার তাৎপর্যগত অর্থ যথাযথভাবে প্রকাশ পায়। এছাড়া ও অপেক্ষাকৃত জটিল ও আবেগপূর্ণ বক্তব্যের ক্ষেত্রে ভাবানুবাদ করা হয়ে থাকে। অনুবাদের মধ্যে ভাবানুবাদই অধিক গ্রহণযোগ্য।
অনুবাদ যথাযথ হওয়ার প্রয়োজনীয় শর্তাবলি :
অনুবাদ যেন যথাযথ হয় সেজন্য কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখা প্রয়োজন এ বিষয়গুলো নিম্নরূপ
(১) যে অংশটি অনুবচাদ করতে হবে সেটি বারবার ভালোভাবে পড়তে হবে, যেন এর সঠিক অর্থ বোঝা যায়।
(২) যে অংশটির অনুবাদ করা হবে সেখানকার একই শব্দ নানা ধরনের অর্থ প্রকাশ করতে পারে। এ কারণে কোন শব্দ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে তা আগে সঠিকভাবে বুঝে নিতে হবে।
(৩) আক্ষকির অনুবাদের চেয়ে ভাবানুবাদ করাই শ্রেয়। কেননা, ভাবানুবাদের ওপরই অনুবাদের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে। ভাবানুবাদ করলেও ভাষা যদি শুদ্ধ ও সহজসাধ্য না হয় তবে সে অনুদাব যথাযথ হবে না।
(৪) অনুবাদ সফল করতেহলে যে ভাষা থেকে অনুবাদ করা হবে এবং যে ভাষার অনুদিত হবে সে উভয় ভাষার অন্তর্নিহিত গঠনকৌশলসহ যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।
(৫) মূল ভাষা ও অনূদিত ভাষার গঠনশৈলী, শব্দভাণ্ডার, প্রবাদ-প্রবচন এবং ব্যাকরণিক নিয়ম-কানুন সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন।
(৬) অনুবাদ শেষ হওয়ার পর অনুবাদটি বারবার পড়ে দেখতে হবে যেন অনুবাদটির ভাষা পরিশীলিত, শুদ্ধ ও সুন্দর হয়।
ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করার নিয়মাবলি :
বাংলা ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রে অন্যান্য ভাষার তুলনায় ইংরেজি ভাষার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এ কারণেই আমাদের ইংরেজি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা নিয়মাবলি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। ইংরেজি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখা প্রয়োজন। এগুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো
(১) যে অংশটির ইংরেজি অনুবাদ করতে হবে সে অংশটিকে বারবার মনেযোগ সহকারে পড়তে হবে যেন মূল বক্তব্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
(২) ইংরেজি ভাষার শব্দভা-ার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও নির্ভুল ধারণা থাকতে হবে। ইংরেজি ভাষার শব্দভা-ার যত সমৃদ্ধ হবে অনুবাদ করাও ততটা সুবিধাজনক ও সফল হবে।
(৩) ইংরেজি ভাষার বিভিন্ন বাক্যের গঠন সম্পর্কে সঠিক ও নির্ভুল ধারণা থাকতে হবে।
(৪) ইংরেজি প্রবাদ বাক্যের আক্ষরিক অনুবাদ হয় না। তাই ইংরেজি প্রবাদ বাক্যগুলোর সঠিক অর্থ আয়ও করতে হবে এবং অনুবাদ করার সময় সে অর্থটিই প্রয়োগ করতে হবে। যেমন: ”Cut your coat according to your cloth’ ‘ প্রবাদটির ভাবানুবাদ হলো ‘আয় বুঝে ব্যয় কর’।
(৫) ইংরেজি ভাষায় সকর্মক ক্রিয়ার পর কর্ম বসলেও বাংলা ভাষায় কর্ম বসবে ক্রিয়ার পূর্বে। যেমন ও যধাব ধ ৎবফ পধৎ. (আসার আছে একটি লাল গাড়ি।) এর যথার্থ বাংলা অনুবাদ হবে আমার একটি লাল গাড়ি আছে।
(৬) বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত তুমি, তোমরা, আপনি আপনারা ইত্যাদি প্রত্যেকটি শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ইংরেজিতে কেবল ‘ুড়ঁ’ ব্যবহৃত হয়। অনুবাদের সময় বাংলায় ভাব ও অবস্থা অনুসারে নাম এর বিপরীতে তুই, তুমি, তোমরা, আপনি ইত্যাদি ব্যবহৃত হবে।
(৭) ইংরেজিতে সত্তাবাচক ক্রিয়াপদ থাকলেও বাংলায় তা থাকে না। যেমন She my sister.এখানে ‘is’ শব্দটির বাংলা অর্থ হলো হয় যা বাংলা অনুবাদের সময় উহ্য থাকবে। সেক্ষেত্রে বঙ্গনুবাদ হবে সে আমার বোন।
(৮) আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও ইংরেজি সরল বাক্যের অনুবাদ সবসময় সহজ হয় না। I am well এর অর্থ ‘আমি ভালো আছি’। কিন্তু I am going well- এর অর্থ ‘আমি ভালো যাচ্ছি’ করা হলে তা ভুল হবে। এক্ষেত্রে অনুবাদ করতে হবে এভাবে ‘আমি (লেখাপড়া পৃভৃতি কাজ) ভালোই করছি’ কিংবা ‘আমার লেখাপড়া প্রভৃতি কাজ) ভালোই চলছে’ অথবা, ‘আমার সময় ভালোই কাটছে’।
(৯) ইংরেজি ভাষার জটিল বাক্যগুলোকে বঙ্গানুবাদ করার সময় খণ্ড খণ্ড সরল বাক্যে রূপান্তর করা যায়।
(১০) ইংরেজি ভাষার ‘Introductory ‘It’ I ‘There’ ‘ এর প্রতিশব্দ বাংলা অনুবাদে ব্যবহৃত হয় না। যেমন There is a college in our village- এর বঙ্গানুবাদ হবে: আমাদের গ্রামে একটি কলেজ আছে।
(১১) ইংরেজি ভাষায় পাশাপাশি দুটি বহুবচনবাচক শব্দ ব্যবহৃত হতে পারে। তবে বঙ্গনুবাদের বেলায় এভাবে অনুবাদ করা হলে তা ভুল হবে। যেমন: Many people have come. . একে যদি আক্ষরিক অনুবাদ করা হয় তবে বলতে হবে ‘অনেক লোকগুলো এসেছে’ যা বাংলা ভাষায় ভুল। বাংলায় অনুবাদ করতে হলে বলতে হবে: ‘অনেক লোক এসেছে’।
(১২) ইংরেজিতে বহুল ব্যবহৃত ‘Please’ শব্দটি বাংলায় অনুবাদ না করাই শ্রেয়। যেমন: Give me some rice বাক্যটিক অনুবাদ ‘আমাকে দয়া করে কিছু চাল দিন’ না লিখে লিখতে হবে ‘আমাকে কিছু চাল দিন’।
(১৩) ইংরেজি ভাষায় শব্দ Who- এরপর যদি Singulat Verb থাকে তবে Who- ‘কে কে’ বা ‘কারা’ এভাবে অনুবাদ করতে হয়। যেমন: Who has come? কে এসেছে? Who have come? কারা এসেছে? বা কে কে এসেছে?
(১৪) ইংরেজি Conditional Sentence-এর বাংলা অর্থ হলো শর্তবাচক বাক্য। এ ধরনের বাক্যকে নানাভাবে অনুবাদ করা যায়। ইংরেজি Conditional Sentence-এর If clause-এর বঙ্গানুবাদে ‘যদি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় এবং এ ধরনের বাক্যের অনুবাদে সদি তবে’ রীতিটি অনুসরণ করা হয়। তবে অনেক সময় বাক্যের অর্থ সঙ্গতি রক্ষার্থে অসমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহার করেও অনুবাদ করা যায়। যেমন If you want to go, go। এর বঙ্গানুবাদ হবে তুমি যদি যেতে চাও, তাহলে যাও অথবা, তুমি যদি যেতে চাও, যাও। অভতা, তুমি যেতে চাইলে যাও।
(১৫) ইংরেজিতে ঠবৎন + রহম (মবৎঁহফ) যদি subject হিসেবে ব্যবহৃত হয় তবে বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে ‘ধাতু + আ’ বা ‘ধাতু + আ + নো’ দ্বারা গঠিত অসমাপিকা ক্রিয়া কর্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন Walking is a good exercise এর সঠিক বাংলা অনুবাদ হলো হাঁটা একটি ভালো ব্যায়াম।
(১৬) ইংরেজিতে Verb + ing (gerund) যদি (gerund) হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে Present Participle (adjective) হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং তা objective case এর পরে বসে তাহলে তার বাংলা অনুবাদ ‘ধাতু + তে’ এভাবে করা হয়। যেমনI saw him writing -এর বাংলা অনুবাদ হবে আমি তাকে লিখতে দেখলাম।
(১৭) ইংরেজি ভাষায় যেখানে I saw him writing ব্যবহৃত হয়, বাংলায় সেকানে সচরাচর অসমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। যেমন On hearing this, she cried out loudly. বাক্যটির বঙ্গানুবাদ হবে: এ কথা শুনে, সে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে উঠল।
(১৮) ইংরেজিতে Verb + ing দ্বারা গঠিত adjective (Present participle) যদি Noun-এর আগে attributive adjective হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তার আগে বাংলা অনুবাদ ‘ধাতু বা শব্দমুল + অন্ত/মান’ এভাবে যোগ করে অনুবাদ করা হয়। যেমন – Do not go on a running bus-বাক্যটির বঙ্গনুবাদ হবে: চলন্ত বাসে উঠো না।
(১৯) ইংরেজি Passive voice-এর অনুবাদ কখনো কখনো বাংলায় কর্তৃবাচ্যে অনুবাদ করলে শ্রুতিমধুর হয়। যেমন: We are seen বাক্যটির বাংলা অনুবাদ হবে ‘আমরা দেখছি’।
(২০) ইংরেজি বাক্যের Subject যদি কোনো Impersonal Pronoun হয় তবে তা দ্বারা সাধারণত সবাইকে বোঝায়। এ ধরনের বাক্যকে বাংলায় অনুবাদ করতে হয় পরোক্ষাভাবে কিংবা কর্মবিহীন কর্মবাচ্যে। যেমন: One should love one’s parents.–এর বঙ্গানুবাদ হবে: মা-বাবাকে ভালোবাসা উচিত।
বাংলা ব্যাকরণ সমগ্র : ব্যুৎপত্তি ও ব্যুৎপত্তিগত শব্দের অর্থ
পাণিনি বানান: বাংলা ব্যাকরণ সমগ্র
বাংলা বাঙলা বাঙ্গলা ও বাঙ্গালা : বাংলা ব্যাকরণ সমগ্র