বিপরীতার্থক শব্দ বা বিপরীত শব্দ
ড. মোহাম্মদ আমীন
যে শব্দ বা শব্দসমষ্টি অন্য এক বা একাধিক শব্দের বিপরীত অর্থ প্রকাশ করে সে শব্দ বা শব্দসমষ্টিকে অন্য শব্দ বা শব্দসমূহের বিপরীত বা বিপরীতার্থক শব্দ বলে। মনের ভাব সুন্দরভাবে প্রকাশের এবং ভাষার শ্রুতিমাধুর্য ও সৌন্দর্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় এ ধরনের বিপরীতার্থক শব্দসমূহের ব্যবহার হয়ে থাকে। বিপরীত শব্দ প্রকাশের ভঙ্গিকে যেমন অর্থবহ করে, তেমন বক্তার উদ্দেশ্যকে করে তোলে সার্থক।
বাংলা ভাষার শব্দভা-ারে এমন অনেক শব্দ আছে যাদের বিপরীতার্থক শব্দও রয়েছে। সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ প্রকাশের জন্য এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়।
“মন আকাশেও উঠতে চায় আবার পাতালেও নামতে চায়।” এই বাক্যটিতে ‘আকাশ’ কথাটি যে অর্থ প্রকাশ করেছে, ‘পাতাল’ কথাটি তার বিপরীত অর্থ প্রকাশ করেছে। তাই এখানে আকাশের বিপরীত শব্দ পাতাল এবং পাতাল এর বিপরীত শব্দ আকাশ।
সংজ্ঞার্থ ” মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বিপরীত শব্দের সংজ্ঞার্থ দিতে গিয়ে বলেছেন, “একটি শব্দের বিপরীত অর্থবাচক শব্দকে বিপরীতার্থক শব্দ বলে।”
ড. সুকুমার সেন-এর মতে, “কোনো শব্দ অন্য একটি শব্দের বিপরীত অর্থ প্রকাশ করলে সে শব্দ দুটিকে পরস্পরের বিপরীতার্থক শব্দ বা বিপরীত শব্দ বলে।”
অশোক মুখোপাধ্যায়-এর মতে, “একটি শব্দ যে ভাব বা অর্থ প্রকাশ করে, অন্য একটি শব্দ তার বিপরীত ভাব বা অর্থবোধক বহলে শব্দ দুটিকে পরস্পরের বিপরীতার্থক শব্দ বা বিপরীত শব্দ বলে।”
উপরের সংজ্ঞার্থগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা একটা নতুন সংজ্ঞা দিতে পারি। যেমন : কোনো ভাষায় ব্যবহৃত এক বা একাধিক শব্দ যদি ভাষার অন্য এক বা একাধিক শব্দের চেয়ে ভিন্ন বা বিপরীত অর্থ প্রকাশ করে, তবে প্রথম শব্দ বা শব্দসমষ্টিকে দ্বিতীয় শব্দ বা শব্দসমষ্টির বা একটিকে আরেকটির বিপরীতার্থক শব্দ বলা হয়।
বিপরীতার্থক শব্দ গঠনের কতিপয় নিয়ম:
বাংলা ভাষায় বিপরীত শব্দের সংখ্যা যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি ব্যাঞ্জনময় তাদের প্রয়োগ। এ বিপরীত শব্দগুলো বাক্যকে যেমন করে সুন্দর তেমনি অর্থকে করে সুসংহত। কয়েকটি উপায়ে বিপরীত শব্দ গঠিত হয়। যেমন
(ক) উপসর্গ যোগে;
(খ) সম্পূর্ণ ভিন্ন শব্দ যোগে এবং
(গ) শব্দের শেষে অন্য শব্দ যোগে।
(ক) উপসর্গ যোগে : শব্দের পূর্বে সাধারণত অ, অন্, অপ, অব, দুর, ন, না, কু, নি, সু, বি, নির ইত্যাদি উপসর্গ যোগ করে বিপরীতার্থক শব্দ গঠন করা যায়। যেমন
মূল শব্দ বিপরীতার্থক শব্দ
নিয়ম অনিয়ম
উচিত অনুচিত
উপকার অপকার
উন্নত অবনত
সৌভাগ্য দুর্ভাগ্য
সার্থক নিরর্থক
(খ) সম্পূর্ণ ভিন্ন শব্দযোগে : মূল শব্দের সাথে কোনো উপসর্গ যুক্ত না হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন শব্দ দিয়ে বিপরীত শব্দ গঠন করা যায়। যেমন
মূল শব্দ বিপরীতার্থক শব্দ
আর্দ্র শুষ্ক
ঊষা সন্ধ্যা
কাঁচা পাকা
চঞ্চল স্থির
তিক্ত মধুর
দোষ গুণ
গ. শব্দের শেষে অন্য শব্দযোগে : শব্দের শেষে ছাড়া, হারা, শূন্য, হীন ইত্যাদি শব্দ যোগ করে বিপরীত শব্দ গঠন করা যায়। যেমন
মূল শব্দ বিপরীতার্থক শব্দ
লাগাম লাগামছাড়া
দিশা দিশাহারা
গৃহ গৃহহারা
হৃদয়বান হৃদয়হীন
সম্পদশালী সম্পদহীন
বুদ্ধিমান বুদ্ধিহীন
বিপরীতার্থক শব্দ গঠনে লক্ষণীয় বিষয়সমূহ
ব্যবহারিক দিক থেকে সুবিধা বৃদ্ধির জন্যই ভাষার শব্দের পরিবর্তন করা হয়। শব্দের এই পরিবর্তন কখনো গঠনের দিক থেকে আবার কখনো অর্থগত দিক থেকে সাধিত হয়ে থাকে। এই পরিবর্তনেরই একটি প্রক্রিয়া বিপরীত শব্দ গঠন। তবে বিপরীত শব্দ গঠনের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। যেমন
ক. বিপরীত শব্দ গঠনের ক্ষেত্রে তৎসম শব্দের বিপরীতে তৎসম শব্দ, তদ্ভব-দেশি ও বিদেশি শব্দের বিপরীতে তদ্ভব-দেশি ও বিদেশি শব্দই ব্যবহার করতে হবে। কোনো অবস্থাতে তৎসম শব্দের বিপরীতে তদ্ভব কিংবা দেশি-বিদেশি শব্দের বিপরীত তৎসম বা অর্ধতৎসম শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। যেমন‘জীবন’ শব্দের বিপরীত শব্দ হিসেবে মরণ-ই লিখতে হবে ‘মৃত্যু লেখা যাবে না। এরূপ কান্না-হাসি; পাস-ফেল; জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি।
খ. লিঙ্গের ক্ষেত্রে মূল শব্দটি পুংলিঙ্গ হলে বিপরীত শব্দটিও পুংলিঙ্গ এবং মূল শব্দ স্ত্রী লিঙ্গ হলে বিপরীত শব্দটিও স্ত্রীলিঙ্গ লিখতে হবে। যেমন নাবালক (পুংলিঙ্গ) সাবালক (পুংলিঙ্গ); লক্ষ্মী (স্ত্রীলিঙ্গ) অলক্ষ্মী (স্ত্রীলিঙ্গ) ইত্যাদি। তবে কিছু বিপরীত শব্দ লিঙ্গান্তরের সাথেও সম্পর্কযুক্ত। যেমন নারী – পুরুষ; স্বামী-স্ত্রী, বেটাছেলে-মেয়েছেলে ইত্যাদি।
গ. মূল শব্দ ও বিপরীত শব্দের ক্ষেত্রে কারক-বিভক্তি বজায় রাখতে হবে। যেমন ঘরে-বাইরে (অধিকরণ কারকে ৭মী বিভক্তি)
ঘ. মূল শব্দ ও বিপরীত শব্দে গঠনগত ও শ্রেণি সমতা বজায় রাখতে হবে। যেমন ঈদৃশ-তাদৃশ; কুবুদ্ধি-সুবুদ্ধি ইত্যাদি।
বিপরীত শব্দের প্রয়োজনীয়তা
অল্প পরিসরে মনের ভাবকে সার্থকভাবে বিপরীতার্থক শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। বাংলা ভাষার শব্দ ভা-ারকে সমৃদ্ধ করতে সমার্থক শব্দের মতো বিপরীত শব্দের ব্যবহার এবং চর্চা অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যুক্তিসঙ্গতভাবে বাক্য পরিবর্তনে বিপরীত শব্দ প্রয়োগে ভাষার সৌকর্য সাধনে পরিপূর্ণতা আসে। মনের ভাবের কখনো সংকোচন ও কখনো প্রসারণ ঘটাতে বিপরীত শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দের উপর নির্ভর করা যায় না। শব্দের বিপরীতে শব্দ ব্যবহারের এই চমৎকারিত্বের জন্য বাংলা ভাষায় বিপরীতার্থক শব্দের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।