বাংলা ব্যাকরণ সমগ্র : হাইফেন : হাইফেনের ব্যবহার

হাইফেন এর ব্যবহার
ড. মোহাম্মদ আমীন
বাংলায় বহুল ব্যবহৃত যতিচিহ্নের মধ্যে হাইফেন (-) অন্যতম। বাক্যের সঙ্গে নয়, মূলত শব্দের সঙ্গে শব্দের সম্পর্ক সৃষ্টি করে একাধিক শব্দকে এক শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করাই হাইফেনের কাজ। এর আর একটি উদ্দেশ্য সহজবোধ্যতা প্রদান। হাইফেন দেখতে ড্যাশের(—) মতো হলেও দৈর্ঘ্যে হাইফেন(-),

প্রকাশক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

ড্যাশের চেয়ে বেঁটে। এর ব্যবহার প্রকৃত অর্থে বিরামচিহ্নের মতো নয়। সাধারণত উচ্চারণের সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে শব্দকে সহজবোধ্য করার লক্ষ্যে সমাসবদ্ধ পদে বর্ণসমষ্টির সংযোগ প্রকাশের জন্য হাইফেন ব্যবহার করা হয়।যেমন: যে-কেহ। যে-কোনো। যে-কোনোটা। যে-কোনোরকম।যে-কোনোরকমে। যে-কে-সেই। আম-জাম-কাঁঠাল-কলা। এছড়াও হাইফেনের আরও অনেক ব্যবহার রয়েছে। হাইফেন তার অব্যবহিত পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উভয় শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে। যেমন: হাত- ফেরতা বা হাত -ফেরতা বা হাত – ফেরতা নয়; হাত-ফেরতা। তেমনি: হাত-পা। সদর-অন্দর।  নিচে যতিচিহ্নের  চৌদ্দটি ব্যবহার দেওয়া হলো:

১. যতিচিহ্নের অন্তর্ভুক্ত হলেও হাইফেনের জন্য কোনো বিরাম দিতে হয় না, বরং অভিন্ন শব্দের মতো বিরামহীনভাবে উচ্চারণ করে যেতে হয়।  এই চিহ্ন দিয়ে সমাসবদ্ধ পদ চিহ্নিত করা হয়। যেমন: আম-জাম-কলা। একটা-দুটো। তুমি-আমি-সে। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম।
২. অনুগামী ও অনুকার শব্দে হাইফেন বসাতে হয়। যেমন: মাল-পত্র। জামা-কাপড়। ডর-ভয়।শীত-গ্রীষ্ম। বাপে-পুতে। রাজায়-রাজায় লড়াই। যেখানে-সেখানে। ইনিয়ে-বিনিয়ে।আলো-কচু।আলো-আঁধারি।
৩. দুই বা ততোধিক পদের সমাসে সাধারণত হাইফেন বসে। যেমন: বাপে-পুতে লড়াই, কেউ-কারে না-ডরাই। আমি-তুমি-সে। টাকা-পয়সা-ধন-দৌলত। আম-জাম-লিচু-কলা। গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি। উল্লেখ্য, দ্বন্দ্ব সমাস ছাড়াও অন্যান্য সমাসবদ্ধ পদে হাইফেন বসানো যায়। যেমন: আল্লাহ-সৃষ্ট।প্রকৃতি-পদত্ত। সরকার-নির্ধারিত নীতি। রবীন্দ্রনাথ-গীত-গীতি।
৪. দুইয়ের বেশি শব্দ মিলিত হয়ে একটি শব্দ গঠন করলে হাইফেন বসানো যায়। শব্দের দ্বিত্ব ঘটলেও হাইফেন ব্যবহার করা হয়। যেমন: ঝগড়া-রত- বুড়ো-লোক, কেঁদে-কেঁদে দেখায় শোক। 
 ৬. যেখানে সন্ধি সম্ভব নয় কিংবা সন্ধি করা উচিত নয় সেখানে হাইফেন বসে। যেমন: মহা-প্রলয়ে যেন শেষ হয়ে যাবে ধরা। খেয়ালি-লোকটাকে কোনোভাবে থামানো গেল না।
৭. যৌগিক ক্রিয়া, বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হলে শব্দে হাইফেন বসে। যেমন: দম-বন্ধ-হয়ে আসা রোগী।আগুনে-পোড়া বাড়ি।ঝড়ে-বিধ্বস্ত বাড়ি।
৮. ক্রিয়া বিশেষণে শব্দের দ্বিত্ব হলে হাইফেন বসে। যেমন: যেতে-যেতে পথে, পূর্ণিমা রাতে-..। দেখে দেখে শেষ।
 
৯.বহুবর্ণযুক্ত দুটি শব্দের মধ্যে সমাস হলে হাইফেন ব্যবহার করা হয়। যেমন: পুষ্পভারনত-বৃক্ষ। ক্ষত্রিয়সুলভ-আচরণ।ঘূর্ণায়মান-জলরাশি।ঘোড়ামুখো-মানুষ। সৌদিতে-নিপীড়িত বাংলাদেশি নারী।
 
১০.দপ্তর, অধিদপ্তর, প্রতিষ্ঠান ও পদের মধ্যে হাইফেন বসানো যায়। যেমন: প্রধান-মন্ত্রী। কৃষি-মন্ত্রী। শিক্ষা-সচিব। উপ-সচিব। যুগ্ম-সচিব। তবে, এখন বাংলায় এগুলো হাইফেন ছাড়া অসংলগ্ন সমাস হিসেবে লেখার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন: প্রধানমন্ত্রী,।কৃষিমন্ত্রী। উপসচিব। তবে শিক্ষা সচিব।
১১. সংখ্যা প্রকাশে অনেক সময় হাইফেন ব্যবহৃত হয়। জার্মানি ৮-০ গোলে সৌদি আরবকে হারিয়ে দিল। মহিলাটি ৬-ফুট লম্বা।
 
১২. স্থান, অনুষ্ঠান এবং দিক নির্দেশের ক্ষেত্রে শব্দে হাইফেন বসে। যেমন: সিমলা-চুক্তি, কাশ্মীর-সমস্যা, পূর্ব-পশ্চিম ইত্যাদি।
১৩.  দুটি পক্ষের দ্বন্দ্ব বা সম্পর্ক প্রকাশে  হাইফেন ব্যবহার করা যায়। যমন : ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট, বাংলাদেশ-মায়ানমার আলোচনা। ইংল্যান্ড-ফ্রান্স যুদ্ধ।
১৪। ক্রিয়াপদে ‘না’ অব্যয়: ক্রিয়া পদের পূর্বে ব্যবহৃত হলে ‘না’ অব্যয়ের পর হাইফেন বসবে। যেমন: না-দেখা, না-খাওয়া, না-যাওয়া। তবে ক্রিয়া ছাড়া অন্য কোনো শব্দের আদিতে ব্যবহৃত ‘না’ অব্যয়ের পর হাইফেন দেওয়া বিধেয় নয়। যেমন: নাবালক, নাহক, নাজায়েজ, নাপাক।
১৫. ‘না’ পদটি যখন ঋণাত্মক ভাব প্রদানের পরিবর্তে অনুরোধ-জ্ঞাপক ভাব প্রদানে ব্যবহৃত হয়, তখন না শব্দের আগে  হাইফেন বসানো যায়। যেমন: প্লিজ, যাবেন-না। ভাইজান, আর কয়টা ভাত খান-না।
অর্থ অনুধাবনে কিংবা যথাযথ উচ্চারণে সংশয় সৃষ্টির আশঙ্কা না-থাকলে অথবা দৃষ্টিকটু না-দেখালে কোনো শব্দে হাইফেন ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক নয়।
সূত্র: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
————————————————————————————————————————–
Language
error: Content is protected !!