ড. মোহাম্মদ আমীন
শিরোনাম দেখে অনেকে চমকে উঠবেন। কারণ, অনেকের অস্থিমজ্জায় ব্রাহ্মণ্য অনুবোধে এর উলটোটিই গেঁথে আছে। নিজেদের ঐতিহ্যকে দীন ভাবতে ভাবতে অনেকের মন দীন হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন এমন শিক্ষা পেয়ে আসায় আমার শিরোনামটিকে অনেকে বলবেন- হাস্যকর, বলতে পারেন বালখিল্য। এটি তাদের দোষ নয়, আমাদের অতীত ইতিহাস আর ঐতিহ্যিক সংরক্ষণের দুর্বলতা। বাংলাভাষী হয়েও যারা ইংরেজিতে পারিবারিক অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পত্র লিখেন, তাদের কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। তবে, যারা স্বকীয় ঐতিহ্যে আস্থাশীল তাদের কাছে শিরোনামটি হাস্যকর হওয়ার কথা নয়।
সংস্কৃত শব্দের অর্থ সংস্কার করা হয়েছে এমন, সংশোধিত, পরিমার্জিত প্রভৃতি। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষাসহ তৎকালে বিদ্যমান ভাষাসমূহকে নানাভাবে সংস্কার, সংশোধন ও পরিমার্জন করে একটি নতুন ভাষা সৃষ্ট্ করা হয়েছিল। সংস্কার করে সৃষ্টি করা হয়েছিল বলে ভাষাটি সংস্কৃত নামে পরিচিত। কাজেই সংস্কৃত কোনো মৌলিক ভাষা নয়। আর্যভাষাসহ উপমহাদেশে তৎকালে বিদ্যমান বিভিন্ন ভাষা থেকে সৃষ্ট একটি কৃত্রিম ও মৃত ভাষা।
আর্যদের আগমনের পূর্বেও এখানে জনবসতি ছিল, তাদের ভাষা ছিল। ওই ভাষা থেকে ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা ভাষার উদ্ভব। তাই বলা যায়, সংস্কৃত ভাষা গঠনে প্রাচীন বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। প্রাচীন বাংলা থেকে সংস্কৃত ভাষার সংস্কার শুরু হয়েছিল। দখলদার আর্যরা ভারত ভূমিতে আসার পর বুঝতে পারলেন, তাদের ভাষা ( প্রাচীন আর্যভাষা) স্থানীয় ভাষার চেয়ে অনেক দীন, হতশ্রী এবং দুর্বল। তাই তারা তাদের ভাষাকে সংস্কার করার প্রয়াস নেয়। এ বিষয়ে শ্রী সুভাশীষ চিরকল্যাণ পাত্রের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, “ সংস্কৃত কথাটি থেকেই বোঝা যায় যে সেটি প্রচলিত ভাষাকে সংস্কার ক’রে পণ্ডিতদের দ্বারা বিদ্যাচর্চ্চার জন্য সৃষ্ট একটি কৃত্রিম মানভাষা, সে তুলনায় বাংলা একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ভাষা এবং একটি কৃত্রিম ভাষা থেকে একটি প্রাকৃতিক ভাষার জন্ম হতে পারে না । অবশ্য সংস্কৃত থেকে বহু শব্দ গ্রহণ করে বাংলা ভাষা শক্তিশালী হয়েছে, একথা সত্যি। বাংলা ভাষা ক্রমাগত বিকশিত হলেও আজও মানুষের আদি ভাষার ঐতিহ্য বহন করছে। সংস্কৃত ভাষাটি শুধু বাংলা কেন, ভারতের বা পৃথিবীর কোনো ভাষারই জননী নয়।”
মানুষের আদলে সৃষ্ট পুতুল বা মূর্তি যেমন জীবিত মানুষ নয়, তেমনি ভাষার আদলে সৃষ্ট সংস্কৃত ভাষাও প্রকৃতপক্ষে জীবন্ত নয়। এজন্য সংস্কৃতে জীবন্ত ভাষার কোনো বৈচিত্র্য, প্রবহমানতা বা পরিবর্তনশীলতা ছিল না। সংস্কারকৃত ভাষা বলে এটি কোনোকালে জীবন্ত ভাষা ছিল না। তাই জীবন্তভাষার কোনো বৈশিষ্ট্য এখানে পরিলক্ষিত হয় না।
যেটি জীবন্ত ভাষা নয়, সেখান থেকে অন্যকোনো ভাষা সৃষ্টি হতে পারে না তবু অনেকে অজ্ঞতাবশত সংস্কৃতকে বাংলা ভাষার জননী বলে ভ্রান্তধারণা পোষণ করে থাকেন। বাংলা একটি জীবন্ত ভাষা। যারা চিরমৃত সংস্কৃতকে, বাংলার জননী বলে থাকেন, তাদের একটা বিষয় জেনে রাখা উচিত, মৃতভাষা থেকে জীবন্ত কিছু সৃষ্টি হয় না। সংস্কৃত থেকে যে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়নি সেটি জর্জ গ্রিয়ার্সন ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক আগেই জানিয়েছেন।
অতএব সংস্কৃত কখনো কোনো অবস্থায় বাংলার জননী নয়।রবি খান ও কলিম চক্রবর্তীসহ আরো অনেক পণ্ডিতের গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে। কলিম খান ও রবিচক্রবর্তী বলেছেন, সংস্কৃত নয় বরং বাংলায় সংস্কৃতের জননী।
সূত্র : শুবাচ
Total Page Visits: 394 - Today Page Visits: 1