বাটপাড়: বাংলা ‘বাটপাড়’ শব্দের আভিধানিক ও প্রচলিত অর্থ (বিশেষণে) প্রতারক, ভণ্ড, ঠক, শঠ। ‘বাট’ ও ‘পাড়’ শব্দ

সহযোগে বাটপাড় গঠিত। সংস্কৃত বর্ত্ম থেকে বাংলায় বাট শব্দটি এসেছে। বাট শব্দের আভিধানিক অর্থ— পথ, রাস্তা এবং ‘বাটপাড়’ শব্দের অর্থ— যে বাটে পড়ে। ‘বাটে পড়ে’ কথার অর্থ— বাটে অর্থাৎ পথে আক্রমণ করে যে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়। আগেকার দিনে কিছু লোক পথিক সেজে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অনেক সহপথিকের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যেত। প্রতারণার মাধ্যমে হরণ করত বলে তারা ‘বাটপাড়’ নামে পরিচিতি পায়। এখনও বাটপাড় আছে। তবে বাটপাড় আর ছিনতাইকারী অভিন্ন নয়। ছিনতাইকারীরা জোরপূর্বক নিয়ে যায়, কিন্তু বাটপাড়েরা নিয়ে যায় প্রতারণার মাধ্যমে। এ বিবেচনায় যারা সহযাত্রী সেজে নেশার দ্রব্য খাইয়ে সর্বস্ব হরণ করে নিয়ে যায় তাদের ‘বাটপাড়’ বলা যায়।
ষোলোকলা: বাংলা ষোলো ও সংস্কৃত কলা সহযোগে গঠিত ষোলোকলা। অর্থ (ক্রিয়াবিশেষণে) সম্পূর্ণভাবে, পুরোপুরি; (বিশেষ্যে) চাঁদের ১৬ অংশ। প্রকৃতপক্ষে ‘চাঁদের ষোলোকলা’ থেকে বাংলা বাগ্ভঙ্গি ‘ষোলোকলার’ উদ্ভব। কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের পরিণতি কিংবা পূর্ণতা প্রকাশে বাংলায় ‘ষোলোকলা’ মনোরম একটি শব্দ। তবে মনোরম হলেও ষোলোকলা চম্পা বা সাগরকলার মতো মজা করে খাওয়ার যোগ্য কোনো কলা নয়— ষোলোটি চন্দ্রকলা। চন্দ্রকলা বলতে বোঝায়: পৃথিবী হতে দৃশ্যমান চন্দ্রের ক্ষয় এবং বৃদ্ধির সময়কাল। চন্দ্রকলাকে ষোড়শ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। চন্দ্রের বিভিন্ন আলোকিত অংশ বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়। শুক্লপক্ষে চন্দ্র প্রতিদিন একটু একটু করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে তার ষোড়শকলা পূর্ণ করে। চন্দ্রের এ ষোড়শবিধ কলা হলো: অমৃতা, মানদা, পূষা, তুষ্টি, পুষ্টি, রতি, ধৃতি, শশিনী, চন্দ্রিকা, কান্তি, জ্যোৎস্না, শ্রী, প্রীতি, অক্ষদা, পূর্ণা এবং পূর্ণামৃতা। বাংলা বাগ্রীতিতে সোজা কথায়, মানুষের কোনো ইতিবাচক বা নেতিবাচক দিক পূর্ণতায় পৌঁছানোর নামই ‘ষোলোকলা পূর্ণ হওয়া’।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনের বাসনা পূর্ণ হওয়াই ‘ষোলোকলা পূর্ণ হওয়া’। আবার কারও কারও বেলায় পাপেরও ষোলোকলা পূর্ণ হয়, মানে- পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। চাঁদের ষোলোকলা পূর্ণ হওয়া মানে পূর্ণতা অর্জনের মাধ্যমে জীবনের সফল পরিসমাপ্তি। অবশ্য ‘পরিপূর্ণ’ অর্থেও ষোলোকলার ব্যবহার দেখা যায়। শরৎচন্দ্র লিখেছেন: ‘‘বাপের স্বভাব একেবারে ষোলকলায় পেয়েছে।’’
হাবভাব: ‘হাবভাব’ শব্দের বর্তমান আভিধানিক অর্থ হলো চালচলন, ছলাকলা, আকার-ইঙ্গিত প্রভৃতি। ‘হাব’ ও ‘ভাব’ এ দুটো পৃথক শব্দের মিলনে ‘হাবভাব’ শব্দের শুভ জন্ম। তবে ‘হাব’ পৃথক শব্দ হলেও ‘ভাব’-এর সঙ্গ ছাড়া এর ব্যবহার লেখা বা মুখের ভাষায় একেবারেই নেই। বলা যায়— ‘ভাব’ ছাড়া ‘হাব’ অর্থহীন। ‘হাব’ শব্দের অর্থ— নারীর মনোহর লাস্য বা কলজে কাঁপানো বিলাসভঙ্গি। ‘ভাব’ অর্থ— অভিপ্রায়, অবস্থা, চিন্তা, মানসিক অনুভব, ধরন, প্রণয় প্রভৃতি। ‘হাব’ ও ‘ভাব’ জোড়া লাগার পর প্রাথমিক পর্যায়ে ‘হাবভাব’ শব্দটি কেবল নারীদের বেলায় ব্যবহার করা হতো। তখন শব্দটির মধ্যে ছিল রোমাঞ্চ, যদিও তা কিছুটা কামস্বভাবের বা কিছুটা অশালীন ছিল; তবে তা একদম লিলুয়া বাতাসের মতো ফুরফুরে ছিল। বর্তমানে ‘হাবভাব’ সম্পূর্ণ লিঙ্গ-নিরপেক্ষ শব্দ। এটি শুধু মানুষের ক্ষেত্রে নয়, প্রাণীদের বেলাতেও ব্যবহৃত হয়। হাবভাব এখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ব্যাপক অর্থ প্রকাশে ব্যবহার করা হয়। যেমন: দেশের রাজনীতির হাবভাব ভালো মনে হচ্ছে না। রোগীর হাবভাব দেখে মনে হয় সময় ঘনিয়ে আসছে। কুকুরটির হাবভাব বেশ আক্রমণাত্মক।