বাংলা শব্দভাণ্ডারের চৈনিক শব্দ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
মোজাম্মেল হক রিমন
জ্ঞানরাজ্য মূলত শব্দেরই বিস্তৃতি। তাইতো সংস্কৃত পণ্ডিতেরা বলতেন ‘শব্দই ব্রহ্ম’। শব্দ হাজার বছর ধরে অবিরাম ছুটে চলছে পৃথিবীর পথে পথে। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পাড়ি জমিয়েছে কখনো অনুবাদিত হয়ে কখনো নিজের অবয়ব অক্ষত রেখে। শব্দের এ পথপরিক্রমায় বাংলা শব্দভাণ্ডার ঋদ্ধ হয়েছে ৪.৫৫% বিদেশি ভাষার শব্দে। বিদেশি শব্দের এ মিছিলে হাতেগোনা কয়েকটি চীনা শব্দ (চা, চিনি, সাম্পান, লিচু ও লুচি। শব্দ আরো থাকতে পারে তবে আমি এখানেই সীমাবদ্ধ) বাংলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর শাসন, দেশি-বিদেশি বণিক/ পর্যটক ও প্রতিবেশী ভাষার গমনাগমনের মাধ্যমেই বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশের এত নিকটবর্তী হওয়ার পরও চীনা ভাষার শব্দ বাংলায় গমনাগমন বিস্ময়করভাবে কম। যুগযুগ ধরে চীনা পর্যটকেরা বাংলায় এসেছেন এবং বাংলার সৌন্দর্য উপভোগ করেছন। তাদের বিবরণীতে তৎকালীন বাংলার ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক অনেক তথ্য পাওয়া যায়। পঞ্চম শতকের সূচনায় (৩৯৯ খ্রি.) বাংলায় আসেন বিখ্যাত পর্যটক ফা-হিয়েন, সপ্তম শতকে হিউয়েন-সাং(৬৩৮ খ্রি.) ও ইৎসিঙ (৬৭২ খ্রি.) এবং মা-হুয়ান ১৪১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিন বার বাংলায় আসেন। তাদের ভ্রমণ বিবরণী বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। তাহলে চীনা শব্দের অন্তর্ভুক্তি বাংলায় এত কম কেন? চীনা ভাষার দুর্বোধ্যতা, একই সাথে শব্দের অর্থগত ও স্বরের উঠানামাভিত্তিক উচ্চারণ ( Tone) এবং এর ক্যারেক্টারভিত্তিক বর্ণমালার জন্যই বিদেশি শব্দে এর অন্তর্ভুক্তিটা কম হয়েছে বলে মনে হয়।
এখন আসা যাক বাংলা শব্দভাণ্ডারে আগত উল্লেখিত পাঁচটি চীনা শব্দের বর্তমান অবস্থা জানতে।
‘চা’ শব্দটি বাংলায় আমরা যেভাবে উচ্চারণ করি চীনা ভাষায় তার উচ্চারণ একই রকম নয়। চীনারা ‘চা’ কে বলে ছা cha (茶)। যার উচ্চারণটা চ এবং ছ মাঝামাঝি তবে ছ এর উচ্চারণ বেশি স্পষ্ট।
‘চিনি’ শব্দটি চীনা ভাষার বলে প্রতিষ্ঠিত মতামত থাকলেও আধুনিক চীনা ভাষায় চিনির অর্থ প্রকাশ করে এরকম কাছাকাছি শব্দ খুঁজে পাওয়া যায়নি। চিনি (sugar) কে চীনা ভাষায় বলা হয় táng (糖), এর উচ্চারণ হয় থাং। চিনি শব্দের অন্যান্য চীনা যে সমার্থক শব্দগুলো রয়েছে চিনি শব্দের কাছাকাছি উচ্চারণ রয়েছে এমন কোনো শব্দও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে হিন্দি ভাষার কিছু চিন্তকের মতামত ও অনলাইনের বিভিন্ন রেফারেন্স থেকে ধারণা করা হয় শব্দটি চীনা হওয়ার চেয়ে হিন্দি হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। রেফারেন্সসমূহ খুব একটা শক্তিশালী এবং অথেনটিক না হওয়ায় অামি প্রতিষ্ঠিত মতের বিপক্ষে যাচ্ছি না। Google Search এ চিনি শব্দের চীনা নামের একটি অপশনে যে অর্থ দেখাচ্ছে তা মূল অর্থের কাছাকাছিতো নয়ই বরং ভীতিকর (নমুনা- 奇尼/糖
Qí ní/táng)। হয়তো বিশদ কোন গবেষণা এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারবে।
‘সাম্পান’- বাংলা ভাষায় বিশেষ এক ধরনের নৌকা বুঝাতে ‘সাম্পান’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। চীনা ভাষায় একে বলা হয় shānbǎn (舢板)। শব্দ মধ্যস্থিত ‘b’ এর উচ্চারণ এখানে ব এবং প এর মাঝামাঝি কিন্তু ব বেশি স্পষ্ট। সে হিসেবে সান্বান অার সাম্পান উচ্চারণে অার অর্থে নিকটবর্তী।
লিচু ফলটির চীনা নাম lìzhī (荔枝)। শব্দটির উচ্চারণ লি্ ঝিই/ চিই তবে zh এ চ এর উচ্চারণ বেশি স্পষ্ট।
‘লুচি’ শব্দটির উচ্চারণ এবং অর্থের সাথে সামান্য সাযুজ্যপূর্ণ চীনা শব্দ যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে lǔzhī (卤汁〔滷-) এখানে উচ্চারণটা হবে লুও ঝি/চি, zh এ চ এর উচ্চারণ বেশি স্পষ্ট। তবে আমরা যে লুচি খাই তা সে লুচি নয় বরং gravy ধরনের কিছু।
চীনা ভাষাভাষী এবং আমরা কিছু অভিন্ন/ কাছাকাছি উচ্চারণের শব্দ ব্যবহার করি, এবার আসা যাক তাদের আলোচনায়-
বাংলা ভাষায় ব্যাবহৃত তুর্কি শব্দ ‘বাবা’। চীনা ভাষায় বাবা শব্দের সমরূপ শব্দ হচ্ছে bàba (爸爸)। এখানে b এর উচ্চারণ ব এবং প এর মাঝামাঝি এবং ব এর উচ্চারণ এখানে বেশি স্পষ্ট। বাংলা শব্দসম্ভারের তদ্ভব শব্দ ‘মা’ চীনা ভাষায় māma (妈妈) যার ডায়ালেক্ট হিসেবে mā (妈) শব্দটিও মুখেমুখে শোনা যায়। হিন্দি শব্দ ‘দিদি’ শব্দটি আমরা বড়বোন অর্থে ব্যবহার করলেও চীনা ভাষায় dìdi (弟弟) মানে ছোট ভাই। বাংলা ভাষায় অাগত মেক্সিকান শব্দ চকলেট এর চীনা শব্দ qiǎokèlì(巧克力) আর ওলন্দাজ শব্দ কফি এর চীনা রূপ kāfēi (咖啡) যার উচ্চারণ কা- ফেই।
এবার কিছু নামের প্রসঙ্গে আসা যাক, আধুনিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মাও সেতুং এর নাম আমারা সবাই জানি। কিন্তু চীনা লোকজন মাও সেতুংকে চিনে না। অদ্ভুত মনে হচ্ছে? হ্যাঁ, তাই। চীনারা মাও সেতুংকে চিনে Máo Zédōng (毛泽东) নামে। যার উচ্চারণ মাও জো-ডৌং। তাছাড়া তারা মাও সেতুংকে চেয়ারম্যান মাও নামেই সম্বোধন করে থাকে। একই ঘটনা বিখ্যাত দার্শনিক কনফুসিয়াসের ক্ষেত্রেও। কনফুসিয়াসকে চীনারা চিনে Kǒngzǐ (孔子) অর্থাৎ খৌং-জিই নামে। যদিও তাঁর পূর্ণনাম Kǒngfūzǐ (孔夫子) খৌং-ফু-জিই অর্থাৎ মাস্টার খৌং।
একটি ভাষার শব্দসম্ভারে যতবেশি শব্দ/ সমার্থক শব্দ থাকে সে ভাষার সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য ততবেশি হয়। সে বৈচিত্র্যে বাংলা আজ মর্যাদার আসনে আসীন। বিশ্বের অনেক দেশ পরদেশী ভাষায় কথা বলে, পরদেশী বোলে মায়ের গল্প শুনে। যখনি মনে হয় বাংলা আমার নিজের ভাষা, রক্তের দামে কেনা আমার মায়ের ভাষা, গর্বে বুকটা ভরে যায় আর শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় হৃদয়ের গহিনে আন্দোলিত হয় শহিদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউলের নাম।
সূত্র: মোজাম্মেল হক রিমন(Mozammel Hoq Rimon), শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)।