বাক্যে নাই নেই নি-এর প্রয়োগ
ড. মোহাম্মদ আমীন
একসময় (২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বেও) বাংলা একাডেমির নীতি ছিল: “ক্রিয়াপদের সঙ্গে ‘না, নাই ইত্যাদি ‘না-বাচক’ শব্দ যুক্ত হলে তা

পৃথক বসবে। যেমন: যাব না, খাব না, পাব না, হাসি না, দেখি নাই, বলি নাই, দেখি না, মারি না।” ‘নেই’ শব্দের চলিতরূপ ‘নি’। আনন্দবাজার অনুসৃত বাংলা বানান বিধিতে ক্রিয়াপদের সঙ্গে ‘নেই’ শব্দের চলিত রূপ ‘নি’ সংশ্লিষ্ট শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসানোর পক্ষে বলা হয়েছে । কিন্তু বাংলা একাডেমী পৃথক বসানোর পক্ষে। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা একাডেমীর এ নীতি বহাল ছিল। হঠাৎ একদিন বাংলা একাডেমির নজর পড়ল আনন্দবাজার অনুসৃত নীতির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা একাডেমি ‘নি’-কে শব্দের সঙ্গে সেঁটে লেখার ফরমান জারি করে দিল। যেমন: খাননি, দেননি, পাননি, বলিনি, খেলিনি ইত্যাদি।
না ও নি লেখার আধুনিক প্রমিত নিয়ম: না-বাচক ‘না’ এবং ‘নি’ এর প্রথমটি (না) স্বতন্ত্র এবং দ্বিতীয়টি (নি) সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। যেমন : করি না, কিন্তু করিনি।

এছাড়া শব্দের পূর্বে না-বাচক উপসর্গ ‘না’ উত্তরপদের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। যেমন: নাবালক, নাহক, নারাজ ইত্যাদি। অর্থ পরিস্ফুট করার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুভূত হলে ‘না’ এর পরে হাইফেন ব্যবহার করা যাবে। যেমন : না-গোনা পাখি, না-বলা বাণী, না-শোনা কথা। (বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম। সংস্করণ -২০১৬ খ্রি.)। অতএব, এখন প্রমিত হলো: খাননি, যাননি, বসেননি, বলেননি, করেননি, দেখেননি, চাননি, পাননি, বলিনি, করিসনি। কিন্তু ‘নাই’ হলে লিখতে হবে: লিখি নাই, করি নাই, বলি নাই, দেখি নাই, যাই নাই, দেখ নাই, লেখ নাই, করিস নাই, বলিস নাই ইত্যাদি।
নাই ও নেই কথন
তাহের আলমাহদি
নাই ও নেই বলতে সাধারণত কোন কিছুর অভাব বুঝায়৷ এছাড়া শব্দ দুটির আরও কিছু প্রয়োগ আছে বাংলা ভাষার কথ্য ও লেখ্যরূপে৷
নাই কথন: নাই শব্দটি মোটামুটি ছয় ধরনের অর্থ প্রকাশ করে৷

ক) নাই, এটি অব্যয়৷ সংস্কৃত নাস্তি বিবর্তিত হয়ে নাহি > নাঞি > নাই হয়েছে৷ এটি ক্রিয়ার অসমাপ্তি বা অভাবসূচক অর্থ প্রকাশ করে (যার নাই, ঘরে ফেরে নাই)৷ এছাড়া নাই প্রশ্নসূচক অব্যয় হিসেবেও ব্যবহৃত হয় (এখনও আসে নাই?)। নাই শব্দটির আরেক বিবর্তিত রূপ নি৷ নি-ও নাবোধক অর্থের পাশাপাশি প্রশ্নসূচক কি অর্থের প্রকাশ করে৷ (সে খায় নি?)
খ) নাই, এটি বিশেষ্য৷ আশকারা, লাই, প্রশ্রয় ইত্যাদি অর্থ প্রকাশ করে৷ (কুকুরকে নাই দিলে মাথায় ওঠে)। সংস্কৃত স্নেহ শব্দটি বিবর্তিত হয়ে নেহ > নেই শব্দ সৃষ্টি করেছে৷
গ) নাই, এটিও বিশেষ্য, সংস্কৃত নাভি শব্দের বিবর্তিত রূপ৷ এটি নাভি (নাইয়ের চারিদিকে ব্যথা); চক্র ইত্যাদির কেন্দ্রস্থল; কীলক; কামারের নেহাই ইত্যাদি অর্থ প্রকাশ করে৷
ঘ) নাই, সংস্কৃত নাপিত শব্দের বিবর্তিত রূপ, বিশেষ্য৷
ঙ) নাই, এটি ক্রিয়াবাচক শব্দ৷ সংস্কৃত স্নান শব্দের বিবর্তিত বাংলা √নাহ ধাতুর উত্তম পুরুষের রূপ। অর্থাৎ আমি স্নান করি।
চ) নাই, এটিও ক্রিয়াবাচক শব্দ৷ অভাবার্থক নেই অর্থে বর্তমান কালে ব্যবহৃত হয় (আমার টাকা নাই, সে এখানে নাই, ‘নাই নাই ভয়’: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)৷ এছাড়া অনুচিত অর্থেও নাই-য়ের ব্যবহার আছে (অমন কথা বলিতে নাই)। এর উৎসও সংস্কৃত নাস্তি৷
ছ) নাই, এটি বিশেষণ৷ অবিদ্যমান (নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো), অভাবে পীড়িত (নাইঘরে খাঁই) ইত্যাদি অর্থ প্রকাশ করে। এটি সংস্কৃত নাস্তি > প্রাকৃত নাত্থি > হিন্দী নাহি হতে বিবর্তিত হয়ে বাংলা নাই হয়েছে।
নেই কথন
ক) নেই নঞার্থক অব্যয় নাই-এর কথ্য ও চলিতরূপ (এখানে কেউ নেই)৷ এটি ক্রিয়াবোধক অব্যয় হিসেবেও ব্যবহৃত হয় (কিছুই নেই?)৷
খ) নেই ক্রিয়াবাচক শব্দ৷ লওয়া শব্দের বিবর্তিত উত্তম পুরুষের রূপ (আমি নেইনি), সর্বদা নঞার্থক নি-য়ের পূর্বে বসে৷
সূত্র: নাই ও নেই কথন, তাহের আলমাহদি, শুদ্ধ বানান চর্চা(শুবাচ)।
না বনাম নি
এবি ছিদ্দিক
বাংলা একাডেমির সর্বশেষ সংস্করণ হচ্ছে ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান'(১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। অভিধানটির শেষের দিকে পরিশিষ্ট অংশের ‘বিবিধ’ নিয়মে উল্লেখ রয়েছে যে, না-বোধক ‘না’ শব্দের শেষে সমাসবদ্ধভাবে না লিখে স্বতন্ত্র পদ হিসেবে এবং ‘নি’ সমাসবদ্ধভাবে লিখতে হবে। যেমন: করব না, পারব না; করিনি, পড়িনি ইত্যাদি।
কারণ: ‘না’ একটি স্বতন্ত্র শব্দ এবং এটি এককভাবে ব্যবহৃত হয়ে নির্দিষ্ট ভাব প্রকাশে সক্ষম। যেমন:
বাড়ি যাবেন কি?
— না।

এখানে কেবল ‘না’ লিখেই সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। অপরদিকে ‘-নি’ কোনো স্বতন্ত্র শব্দ নয়। তাই, এটি একক শব্দ হিসেবে কোনো ভাব প্রকাশে অক্ষম। তবে এটি কোনো শব্দের শেষে যুক্ত হয়ে ঐ শব্দের অর্থ না-বোধক করে দেয়। যেমন: করি > করিনি, পড়ি > পড়িনি, বুঝি > বুঝিনি ইত্যাদি। এবার নিচের উদাহরণটি লক্ষ করুন—
: কাজটি করেছেন?
— নি।
এখানে প্রশ্নটির উত্তরে কেবল ‘নি’ দিয়ে কোনো যথাযথ ভাব প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তাছাড়া কেউ এমনটি বললে শুনতেও বেশ অদ্ভুত লাগবে। যদি উত্তরে কেবল ‘নি’ না লিখে ‘করিনি’ লেখা হয়, তবে ভাব প্রকাশে এবং অর্থ অনুধাবনে কোনো সমস্যা হবে না।
উল্লেখ্য, না-বোধক ‘নি’ কেবল ক্রিয়াবাচক শব্দের শেষে যুক্ত হয়।
পরিসজ্জায়: রাশিদা আকতার মিশু।
সূত্র: না বনাম নি, এবি ছিদ্দিক, শুদ্ধ বানান চর্চা(শুবাচ)।
বিসিএস প্রিলি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল
ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা বইয়ের তালিকা
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/২
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন /৩
ইউরোপ মহাদেশ : ইতিহাস ও নামকরণ লিংক
কি না বনাম কিনা এবং না কি বনাম নাকি
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন
ভূ ভূমি ভূগোল ভূতল ভূলোক কিন্তু ত্রিভুবন : ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন
প্রশাসনিক প্রাশাসনিক ও সমসাময়িক ও সামসময়িক
লক্ষ বনাম লক্ষ্য : বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন
ব্যাঘ্র শব্দের অর্থ এবং পাণিনির মৃত্যু
যুক্তবর্ণ সরলীকরণ আন্দোলন : হাস্যকর অবতারণা