ড. মোহাম্মদ আমীন
খ্যাতিমান কূটনীতিক মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। আমি তাঁর ব্যক্তিগত সচিব, মানে পিএস। খুব ভালো বাংলা জানতেন তিনি। বলা যায়, তিনিই আমার বাংলা শেখার অনুপ্রেরণা এবং গুরু। রাষ্ট্রদূত থাকাকালীন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসসমূহে তিনিই সর্বপ্রথম বাংলায় দাপ্তরিক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। সেদিন এক পৃষ্ঠার একটা পত্র স্বাক্ষরের জন্য তাঁর টেবিলে রেখে আমার কক্ষে চলে এলাম। চেয়ারে বসতে না বসতে ডাক দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। তাঁর সামনে বসে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান।
আমাকে দেখে মন্ত্রী মহোদয় বললেন, “বাবা আমীন পত্রটা দেখেছ?” প্রসঙ্গত, তিনি আমাকে অনানুষ্ঠানিক কথোপকথনে ‘বাবা আমীন’ ডাকতেন। একটু শিহরিত হয়ে বললাম, “জি, স্যার দেখেছি।” তিনি বললেন, “দেখলে বানানে ভুল কেন?”
তখন বয়স ছিল কম। স্মৃতিশক্তি ছিল বর্তমান সময়ের চেয়ে অনেক প্রখর। অধিকন্তু, তাঁর কাছে কোনো খসড়া উপস্থাপনের আগে অন্তত তিন বার ভালোভাবে দেখে নিতাম। এই চিঠি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবে। তাই পাঁচ বার দেখেছি। ভুল হওয়ার কথা নয়, এখন যেমন অহরহ ভুল হয়। কিন্তু মোস্তফা ফারুকের মতো জ্ঞানী লোকের প্রশ্ন আমার জন্য ধ্রিয়মাণ অভিজ্ঞান।
দ্বিধাদগ্ধ গলায় বললাম, কোথায় ভুল হলো?
“তা পরে পড়ে দেখো”, তিনি বললেন, “আগে বলো, ‘শিহরন’ বানানে দন্ত্য-ন, না কি মূর্ধন্য-ণ।”
বললাম, মূর্ধন্য-ণ।
তিনি বললেন, যে ‘ন’ই হোক, আজ থেকে শিহরন বানানে ‘দন্ত্য-ন’ দেবে। এত লম্বা পা শিহরন জাগাতে পারে না। যাও ঠিক করে নিয়ে এসো।
এরপর থেকে আমি যতই শিহরিত হই না কেন, ‘শিহরন’ বানানে আর লম্বা-পায়ের মূর্ধন্য-ণ দিই না।
২.
শুবাচে আমি লিখলাম, “এতদ্দ্বারা= এতদ্+দ্বারা= এত+দ্দ্বা+রা= (এত+দ্)+(দ্+ব্+আ)+রা= এত+দ্+দ্বা+রা।বাক্যে অব্যয় হিসেবে ব্যবহৃত ‘এতদ্দ্বারা’ শব্দটির অর্থ: ইহার দ্বারা।
একজন মন্তব্য করলেন, “এখানে ‘ব’ হবে না, ‘ধ’ হবে। বানান হবে: এতদ্ধারা।”
কীভাবে?
তিনি লিখলেন, “মাস্টার্স পাস করে এলাম ‘ধ’ দিয়ে। এতদিন পর আপনি ‘ব’ পেলেন কোথায়? সব তো দেখি বলদ।”
৩.
তখন আমি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। সালাম দিলেন পরিকল্পনা সচিব কবি গীতিকার ও রবীন্দ্র গবেষক ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম। অফিসে সালাম মানে ডাক। তাঁর কক্ষে গিয়ে দেখি চার জন সচিব আলাপ করছেন। তখনকার বিষয়- দাপ্তরিক বাংলা বানান। বুঝতে কষ্ট হলো না সালামের মাহাত্ম্য। সচিবদের অভিমত, বাংলায় তাঁরা কোনো ভুল করেন না। ভূইয়া সাহেব বললেন, “আমীন, তুমি কিছু বলো।” আমি চার সচিবকে কাগজে ‘এতদ্দ্বারা’ বানান লিখতে অনুরোধ করলাম। তাঁরা লিখলেন, ‘এতদ্বারা’। আমি দেখলাম: একটা ‘দ’ উধাও। তাঁরাও মাস্টার্স এবং বিসিএস।
৪.
অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) জনাব হক (ছদ্মনাম) গাড়ি থেকে নেমে সোজা আমার কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি আমার অফিস পরিদর্শনে এসেছেন। আমার কক্ষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন হঠাৎ। দরজায় লেখা, সহকারী কমিশনার (ভূমি)। বিড়বিড় করে কথাগুলো পড়ে বললেন, তোমরা কী লেখাপড়া করে বিসিএস পাস করেছ?
বিনয়ের সঙ্গে বললাম, কী হয়েছে স্যার?
তিনি বললেন, “বাংলা একাডেমি সব ‘ঈ-কার’ তুলে দিয়েছে। ‘নদী’ ও ‘নারী’ ছাড়া আর কোথাও ঈ-কার নেই। ‘সহকারী’ বানান ঈ-কার দিয়ে লিখলে কেন? ‘সরকারি’ বানানের ‘ঈ-কার’ পর্যন্ত তুলে দেওয়া হয়েছে। আর তুমি সামান্য সহকারী কমিশনার হয়ে ‘ঈ-কার’ ধারণ করছ। তোমাদের চাকুরি থাকাই উচিত না।”
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নাজির সাহেবকে ডাক দিয়ে বলেন, এক্ষুনি তোমাদের স্যারের নেইম-প্লেট বদলে নিয়ে এসো। দরকারি, তরকারি, সরকারি প্রভৃতি শব্দের বানানের মতো ‘সহকারী’ বানানেও আর কখনো ‘ঈ-কার’ দেবে না। (ক্রমশ:)
———————————————————————————–