ড. মোহাম্মদ আমীন
বাংলা বানান যেন গরিবের পিতৃহারা ষোড়শী, জননীও যার মরমর। তার রূপ আছে, গুণ আছে, যৌবন আছে, আছে মোহনীয় চোখে হৃদয়কাড়া- মর্মর চাহনি; কিন্তু নেই কোনো অভিভাবক, যোগ্য পরামর্শক এবং নিজেকে রক্ষার করার মতো অর্থ, আশ্রয় বা কৌশল। তাই সবাই তাকে পেতে চায়, প্রভু হতে চায়- এজন্য তাকে নিয়ে টানাটানির শেষ নেই। অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ ‘খ্রিস্টাব্দ’ বানান সংশোধন করে লিখলেন, ‘খ্রিষ্টাব্দ’। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ‘খ্রিষ্টাব্দ’ বানান সংশোধন করে লিখলেন, ‘খ্রিস্টাব্দ’।
দুজনেই বাংলার অধ্যাপক ছিলেন। একজন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। দুজনেই খ্যাত। তাঁদের কাছে যদি বাংলা বানানের এ অবস্থা হয়, তো আমার আপনার কাছে কী হবে?
দুজনেই বানানটির বিষয়ে তাঁদের শুদ্ধতার যুক্তি দিলেন। হায়াৎ মামুদ বললেন, ‘খ্রিষ্ট’ বাংলায় আত্তীকৃত শব্দ এবং উচ্চারণে ‘মূর্ধন্য-ষ’ আসে। তাই বানানে ‘ষ্ট’ হবে। সে হিসেবে খ্রিষ্টাব্দ, খ্রিষ্টীয়, খ্রিষ্টান প্রভৃতি বানানই শুদ্ধ। এসব বানানে ‘দন্ত্য-স’ বিধেয় নয়।
আগে দিতেন কেন? জবাব নেই। আত্তীকৃত হলেই কি কোনো বিদেশি শব্দ ‘তৎসম’ হয়ে যায়? কোনো জবাব নেই।
আবুল কাসেম ফজলুল হক বললেন, ষত্ব-বিধান অনুযায়ী বিদেশি শব্দের বানানে ‘মূর্ধন্য-ষ’ বসে না। তাই আত্তীকৃত হোক বা অন্য কিছু হোক এগুলো বিদেশি শব্দ। তাই বানানে ‘স্ট’ হবে। সে হিসেবে খ্রিস্টাব্দ, খ্রিস্টীয়, খ্রিস্টান বানানই শুদ্ধ।এসব শব্দের বানানে ‘দন্ত্য-স’ বিধেয়।
কয়েক বছর আগেও বাংলা একাডেমি আগে লিখত ‘খ্রিস্টাব্দ’, এখন লিখে ‘খ্রিষ্টাব্দ’। আমার মতে ‘খ্রিস্টাব্দ’ হওয়া উচিত, কিন্তু লিখতে হয় ‘খ্রিষ্টাব্দ’।কারণ, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। কেউ লিখেন বাংলা, আবার কেউ বাঙলা,বাঙ্গালা; কেউ সাদা আবার কেউ শাদা।এসব আমি খ্যাতিমানদের কথা বলছি। দেয়া আর নেয়া বানান নিয়েও চলে এমন হরদম টানাটানি ও দেওয়া-নেওয়া। বানান নিয়ে প্রথম এমন টানাটানি শুরু করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কবিতার ছন্দ মেলানোর অজুহাতে ভাষা নিয়ে কতজন কত কিছু করে যাচ্ছে- তার সীমা নেই। এ টানাটানির শেষ হবে তখন, যখন বাংলা একজন যোগ্য অভিভাবক পাবে।
বাংলাকে নিয়ে যার যেমন ইচ্ছে তেমন করছে। বাংলা যেন বেওয়ারিশ রমণী, তার কল্যাণের দিকে কারো নজর নেই, সবার নজর তার যৌবনের দিকে, ধর্ষণ করার চোখ হাজার হাজার চেয়ে আছে লোলুপ দৃষ্টিতে; কিন্তু কারো চোখে লেশমাত্র ভালোবাসা নেই। বাংলার অভিভাবক ‘বাংলা একাডেমি’ অথর্ব স্বামীর মতো চেয়ে চেয়ে দেখছে তার প্রেয়সীর যন্ত্রণা। কখনো কখনো সে নিজে স্বেচ্ছায় বাংলাকে বিলিয়ে দিচ্ছে ধর্ষকদের ইচ্ছের কাছে। যে চাইছে তারই হাতে তুলে দিচ্ছে বাংলাকে। ধর্ষিত হচ্ছে বাংলা জননী– যার তার হাতে।