গরীব নেওয়াজ
এর পূর্বে ‘বানানের জটিলতা ও তা সংস্কারের উদ্যোগ‘ শীর্ষক নিবন্ধে দেখিয়েছিলাম, কীভাবে উভয় বাংলার বিভিন্ন সংস্থা ও পণ্ডিতরা ভিন্ন-ভিন্নভাবে বানানের নিয়মনীতি প্রণয়ন করে শৃঙ্খলার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত আরও বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে চলেছেন। এ নিবন্ধে বিভিন্ন সংস্থা ও পণ্ডিতদের মধ্যকার বানান বিতর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে যে বিষয়ে তারা সবাই একমত তা সহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে কিছুটা আলোচনা করব। উল্লেখ্য যে, পণ্ডিতদের এই একমতের বিষয়ই আবার তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করেছে। একমতেই অনেক দ্বিমত। সে একমতের বিষয় হচ্ছে, সংস্কৃত হতে গৃহীত শব্দ অর্থাৎ তৎসম শব্দের বানানে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। মূলত এটাই বাংলা ভাষাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই সংস্কৃত শব্দের কিছু-কিছু

বানানে বিকল্প বানান থাকায় তার থেকে একটা গ্রহণ করার নীতি গ্রহণ করতে গিয়ে এবং কিছু-কিছু শব্দের বানান সংস্কার করতে গিয়েই পণ্ডিতদের মধ্যে যত মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। বস্তুত সংস্কৃত বানান অনুসরণ করতে গিয়েই আমরা যত জটিলতার মধ্যে পড়েছি। আর আমরা অতিমাত্রায় বানান ভুল করছি। সিন্দাবাদের কাঁধের যাদুকর বুড়োর মতো সংস্কৃত আদর্শ আমাদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসে আছে। এক পণ্ডিতের মত অনুযায়ী শুদ্ধ লিখলেও অন্য পণ্ডিতের মত অনুযায়ী তা অশুদ্ধ হচ্ছে। পণ্ডিতদের মতবিরোধ সম্পর্কে পরবর্তীকালে আরও বিস্তারিত আলোচনা করব।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলা বানানে কেন আমরা সংস্কৃত বানান বিধি অনুসরণ করব? বাংলা বানান কেন বাংলা নিয়মে না-চলে সংস্কৃত নিয়মে চলবে? এতে তো আমরা যা লিখি তা পড়তে পারি না, বা পড়ি না। রবীন্দ্রনাথ তো বলেইছেন, ‘আমরা লিখি এক, পড়ি আরেক। অর্থাৎ আমরা লিখি সংস্কৃত, আর ঠিক সেটি পড়ি প্রাকৃত বাংলা ভাষায়’। সংস্কৃত অনুসরণ করতে গিয়েই আমরা ই ঈ এবং তার কার, উ ঊ এবং তার কার, ঙ ং, জ য, ণ ন, ত ৎ, র ড় ঢ়, শ ষ স, এবং বিভিন্ন ফলার ব্যবহার সহ আরও কতক জটিলতা ও বিভ্রান্তির কবলে পড়ি। এসব দেখেই এক শ’ বছরেরও বেশি আগে (বৈশাখ, ১৩২১) সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী তাঁর ‘বঙ্গ ভাষার গতি’ প্রবন্ধে বলেছিলেন : ‘শব্দের অন্যায় বাড়াবাড়ি যেমন খারাপ, অক্ষরেরও তাই। বাংলায় যখন শ, ষ এবং হস্ত, স্রাব ইত্যাদি শব্দে ছাড়া স-এর, ণ, ন-এর ঙ, ঞ, ং-এর উচ্চারণের কোনো তফাৎ নাই, তখন সেগুলিকে রাখিয়া ছেলেপিলের অনর্থক মাথা খাওয়া কেন, তাহা বুঝি না। যখন প্রাকৃতে উচ্চারণ অনুসারে বানান হয়, তখন তাহার কন্যা বাংলায় কেন হইবে না।’
আমাদের পণ্ডিতরা শব্দের জাত অনুসারে বানানের ভিন্নতা সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র ইত্যাদি বিভিন্ন জাতে আমাদের শব্দ ভাগ করেছেন এবং জাত অনুযায়ী ভিন্ন-ভিন্ন বানানের নিয়ম নির্ধারণ করেছেন। আবার এক জাতের মধ্যেও নানা সূত্র দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বানানবিধি প্রণয়ন করেছেন। এটা নাকি বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতা ও পবিত্রতা রক্ষার জন্য করা হয়েছে। এ ভাগটা অনেকটা এরকম : খাঁটি আর্য ব্রাহ্মণের শব্দ, দেশি ব্রাহ্মণের শব্দ, ভ্রষ্টা ব্রাহ্মণের শব্দ, শূদ্রের শব্দ, যবন-ফিরিঙ্গির শব্দ ইত্যাদি। উনিশ শতকের প্রথম দিকে যখন গদ্য চর্চা শুরু হয়, তখন বাংলাকে সংস্কৃতির আদলে ঢেলে সাজানো হয়েছিল। যা লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ একে ‘আদি পাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। আজও বাংলা অভিধান ও ব্যাকরণ সংস্কৃতবাদী শুদ্ধতার জীবাণু বহন করেই চলেছে। আর তা রক্ষা করতে গিয়েই নানা জাত সৃষ্টি করা হয়েছে এবং বিদেশি শব্দ নামে এক অদ্ভুত বর্গ সৃষ্টি করা হয়েছে। শব্দ আবার কখনো বিদেশি হয় নাকি! কোনো ভাষাই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, খাঁটি ভাষা বলে কিছু হতেই পারে না। প্রত্যেক ভাষাই অন্য ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে থাকে। যা দীর্ঘদিন ধরে ধ্বনিতাত্ত্বিক-রূপতাত্ত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এ ভাষায় গৃহীত হয়ে থাকে। এভাবে গৃহীত হওয়ার পর তা আর বিদেশি থাকে না। সংস্কৃত শব্দ অনেক বেশি পরিমাণে গ্রহণ করেছি একথা সত্য। কিন্তু তার উচ্চারণ এমনকি অনেক অর্থও বদলে গিয়েছে। যেমন সংস্কৃতে ‘লক্ষ্মী’ শব্দের মূল উচ্চারণ ‘লকষমি’, বাংলা উচ্চারণ ‘লোকখি’।
‘যাহা ভক্ষণ করিয়া উদরস্থ করিয়াছি এবং যাহা দ্বারা আমার দেহ সংগঠনের কিয়দংশ পরিপুষ্ট হইয়াছে উহাই আমার শরীরের অংশ বটে। আমি পুণ্যার্জনের লক্ষ্যে তীর্থভূমি আরব দেশে পরিভ্রমণে গিয়া তদ্বেশীয় পবিত্র দুম্বার কিছু মাংস দ্বারা ক্ষুন্নিবৃত্তি করিলাম। উহা আমার দেহ অভ্যন্তরে পরিপাক হইয়া দেহের কিছু অণু সৃজন করিয়া শরীরের পুষ্টিসাধন করিল। এক্ষণে কোনক্রমেই ইহা কহতব্য হইতে পারে না যে, আমার দেহের এই অণুগুলি পুণ্যভূমি আরবের বিশুদ্ধ দুম্বার, আর বক্রি অংশ স্বদেশীয় অপবিত্র মৎস্য-মাংস ইত্যাদির।’
আসলে এটা আমাদের ভাষা পণ্ডিতদের ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তার ফসল। এই পণ্ডিতরাই একসময় নিজ ভাষার সেবা না করে সংস্কৃতের সেবা করেছে, তারপর ফারসি, পরে ইংরেজির সেবা করে তাদের সেবাদাস হয়েছে। আমাদের মতো কম শিক্ষিত, অশিক্ষিত ও গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষই বাংলাকে রক্ষা করে টিকিয়ে রেখেছে। বাঙালি জাতি অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোল, আর্য, শক, হুন, তুর্কি, পাঠান, মুঘল, আরব, পর্তুগিজ ইত্যাদির রক্তের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে। সব মিলে-মিশে একাকার হয়ে একটি সংকর জাতি গঠন করেছে। অন্যকথায় বাংলার হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান মিলে এক মিশ্রিত জাতি সৃষ্টি করেছে। বাঙালি জাতির মতো বাংলা ভাষাও একটি সংকর বা মিশ্র ভাষা। আজ যখন আর্য বা আরব বা অন্য কোনো রক্ত আমার দেহ থেকে পৃথক করার উপায় নেই, তেমনি তার ভাষাও বা ভাষার শব্দ পৃথক করার উপায় নেই। অথচ আমাদের পণ্ডিতরা বর্ণবাদী চিন্তায় মশগুল হয়ে শব্দের কৌলীন্যতা রক্ষার লক্ষ্যে তৎসম শব্দের জন্য পৃথক নিয়ম-কানুন তৈরি করেছেন। অন্যান্য বিভিন্ন জাতের শব্দের জন্য বিভিন্ন ধরনের আইন-কানুন তৈরি করেছেন। আর এসব করেই চলেছেন।
তাছাড়া প্রায় সোয়া লক্ষ বাংলা শব্দের মধ্যে কোনটা সংস্কৃত, কোনটা আরবি বা ফারসি, কোনটা দেশি বা বিদেশি তা জানবো কীভাবে? পণ্ডিতরা তো আজ পর্যন্ত সংস্কৃত বা অন্য ভাষার শব্দের কোনো তালিকা প্রকাশ করেন নি। অথচ বাংলা লিখতে হলে আমাকে প্রথমেই মুখস্থ করতে হবে এইগুলো সংস্কৃত শব্দ, আর সংস্কৃত অনুযায়ী সেসব শব্দের বানানের যে বিভিন্ন নিয়ম আছে তা জানতে হবে। এক কথায় সংস্কৃত ভাষা ও তার ব্যাকরণ জানতে হবে। নইলে বাংলা লিখতে গেলে ভুল হবে। আসলে আমাদের পণ্ডিতরা নিজেরাও জানেন না যে কতগুলো তৎসম শব্দ আছে আমাদের ভাষায়। তারা গবেষণা করে চলেছেন নিরন্তর। আর কিছুদিন পর-পর বলছেন এটা সংস্কৃত, এটা নয়। যেমন এতদিন বলেছেন পন্থি, দেশি–এগুলো সংস্কৃত শব্দ, কাজেই দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে লিখতে হবে পন্থী, দেশী। এখন আবার গবেষণা করে পেয়েছেন এগুলো সংস্কৃত শব্দ নয়, কাজেই হ্রস্ব ই-কার দিয়ে লিখতে হবে পন্থি, দেশি। তদ্রুপ বিদেশি। এরকম আরও বহু উদাহরণ রয়েছে।
আসলে যে সব শব্দ আমরা দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহার করে আসছি, তা মূলে কোন্ ভাষার তা নির্ণয় করা সাধারণভাবে সম্ভব নয়। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে সংস্কৃত, আট শ’ বছর ধরে আরবি-ফারসি, চার শ’ বছর ধরে পর্তুগিজ, আর আড়াই শ’ বছরব্যাপী ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করার পর সে সব শব্দ কোন্ ভাষা হতে ব্যবহারে এসেছে তা আমরা সাধারণ জনগণ কীভাবে বুঝব? এক লোক আরব দেশে গিয়ে সবকিছু আরবিতে দেখে বলছে, এদেশে সবকিছু আরবিতে শুধু আজান বাংলায়।
উৎস: বানান বিশৃঙ্খলা ও বর্ণবাদী মানসিকতা, গরীব নেওয়াজ, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)।